ধারণ পদ্ধতির
সংস্কার অত্যাবশ্যক
সংলাপ ॥ দৈনন্দিন জীবনে এমন কোন বস্তু নেই যা
মানুষ ব্যবহার করে কিন্তু সংস্কার করে না। বাড়ী, গাড়ি, কম্পিউটার ইত্যাদি
প্রতিটি বস্তুই ব্যবহার উপযোগি রাখতে প্রতিনিয়ত সংস্কার করতে হয়। ঠিক তেমনি
নিজেকে সময়োপযোগি করতে হলেও সংস্কার করতে হয়। নিজেকে সংস্কার করার অর্থ -
আচার, আচরণ ও কথাবার্তায় নিজেকে পরিবেশের কাছে আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য করে
তোলা। নিজেকে আরো উন্নত ও উদার করার লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে নতুন পথে যাত্রা
করা, নিজের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা।
নিজেকে সংস্কার করতে হলে সংস্কারের পদ্ধতিরও সংস্কার
অত্যবশ্যক। যুগে যুগে সাধকগণ সংস্কার পদ্ধতির সংস্কার করে আসছেন। সক্রেটিস
যে সব সংস্কার এনেছিলেন তার জন্য এখনও আধুনিক বিশ্বের মানুষ তাঁকে সম্মান
করে। কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগে যখন তিনি সংস্কার কর্মটি করছিলেন তখন লোকজন
তাকে বিষপানে হত্যা করেছিল। প্রায় একই কথা সত্য প্রত্যেক সংস্কারকের
ক্ষেত্রে। যীশু, মোহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে কোন সংস্কারকই মানুষের
অবহেলা ও অত্যাচার থেকে রেহাই পান নি। মানুষ সুদূর অতীতে যে সব সংস্কার
এনেছে তা মেনে নেয় কিন্তু বর্তমানে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে কেউ তা মেনে নিতে
চায় না। যে আরব জাতি নবী মোহাম্মদ (সা.)- কে পাথর ছুঁড়ে আঘাত করেছে সে আরব
জাতি তথা গোটা পৃথিবীতেই তিনি (সা.) এখন শ্রেষ্ঠ মানবের আসনে অধিষ্ঠিত।
কিন্তু এখন নবী (সা.)-এঁর অনুসরণে যদি কোন মানুষ রীতি-নীতি ও প্রথা সংস্কার
করতে চায়, তাহলেও একইভাবে তার ওপর অত্যাচার করা হবে। জগতে এমন কোন সংস্কারক
নেই যাকে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। তবু যুগে যুগে এসেছেন নূতন সংস্কারক
নিন্দা ও নির্যাতন উপেক্ষা করে। জীবনের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়ে
সংস্কারও চলছে সেই আদি কাল থেকেই বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে জীবনেরই
প্রয়োজনে।
মানুষ সর্বদাই চেয়েছে তার কায়িক শ্রম ও কষ্ট লাঘব করতে।
আদিম যুগে মানুষ ছিল কেবল পেশিশক্তি সর্বস্ব। কালের প্রবাহে মানুষ তার
সৃজনশক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে। মানুষ শিখেছে জীবনের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে
বাতাসের শক্তিকে। ধীরে ধীরে শিখেছে পানি, বাষ্প, আর পরমাণু শক্তির ব্যবহার।
শক্তির ব্যবহারে মানুষের কায়িক শ্রম লাঘব হয়েছে। ফলে মানুষ এখন পারছে তার
বুদ্ধি ও বিবেচনা শক্তিকে আরো উন্নততর উদ্দেশে কাজে লাগাতে। এই
বিবেচনা-শক্তিই মানুষকে মহৎ করেছে এবং একে অপরের সহযোগিতার ক্ষেত্রকে
প্রশস্ত করেছে, দিয়েছে সমাজ, সংস্থাকে দৃঢ়তা। মানুষ কতটা তার পেশি শক্তির
ব্যবহার কমাতে পেরেছে, কতটা প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে, তা দিয়ে
মানুষের সমাজে পিছিয়ে থাকা বা এগিয়ে যাওয়ার বিচার-বিশ্ল্লেষণ করা হয়। মানুষ
ব্যতীত আর কোন প্রাণী শক্তিকে ব্যবহার করতে শিখেনি তাই পারেনি নিজেদের
বিকাশ ঘটাতে। ধর্ম কাজ করে সৃজনশক্তির সহায়ক শক্তি রূপে। মানুষ এক
ব্যতিক্রমী প্রাণী। সে শুধুমাত্র বেঁচে থাকতে চায় না, আরো কিছু করতে চায়,
যা অন্য প্রাণীদের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি। এই অসীম সৃষ্টির প্রবাহে সে শুধু
প্রকৃতির অংশ ও প্রাণী জগতে সদস্য হিসাবে থাকতে চায় না। মানুষ এই জৈব
প্রবাহের তরঙ্গে জেগে ওঠা এক সচেতন সত্তা, যে সত্তা চায় এই প্রবাহকে
নিয়ন্ত্রণ করতে, সব কিছুকে আপন আশা-আকাঙ্খা দিয়ে গড়তে। এই গড়ার ইচ্ছা থেকেই
উদ্ভব হয়েছে মানুষের ধর্ম ও সংস্কৃতি। ধর্মের মাধ্যমে মানুষ চেয়েছে তার
জীবনকে অর্থময় করে তুলতে। মানুষ যেমন প্রকৃতির ধর্মকে বুঝতে শিখেছে তেমনি
বুঝতে শিখেছে নিজের ধর্মকে।
ধর্ম তো ধারণ
করা। যা ধারণায় ছিল এবং দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহে যা ধারণ করছি তা-ই তো ধর্ম!
কী ধারণ করবো আর কী ধারণ করবো না, কিভাবে, কতটুকু ধারণ করবো এইসব নিয়েই তো
ধর্ম! প্রযুক্তির উন্নয়নে বদলে গেছে ধারণের বিষয়বস্তু, গতি, গুণ ও পরিমাণ।
১৪০০ বছর আগে মানুষ যা ধারণ করতো এখন তা করে না। সুতরাং ধর্মজগতেও চলছে
সংস্কার অবিরাম। সংস্কার যত উন্নত ও সময়োপযোগিই হোক না কেন তাকে আবার
সংস্কার করতে হয়। সংস্কারের কোন শেষ নেই। সংস্কার এক অন্তহীন অভিযাত্রা।
সংস্কার শেষ হয়ে গেলো তো বিকাশ থেমে গেলো। পুরাতন ধারণ পদ্ধতিতে নূতনকে
ধারণ করা যায় না। তাই ধর্ম হয় না। ধার্মিক হতে হলে সংস্কার আনতেই হবে ধারণ
পদ্ধতিতে। ধারণ পদ্ধতির সংস্কার ব্যতীত কেউ ধার্মিক হতে পারবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন