বুধবার, ৪ জুন, ২০১৪

এক সত্য কর ধারণ একেই সরণ একেই তরণ

এক সত্য কর ধারণ
একেই সরণ একেই তরণ

সিদ্ধার্থ ॥ চিন্তাকে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ধরে রাখা হলো 'ধারণ'। সরণ হলো নির্দিষ্ট দিকে বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন। কোন বস্তুর সরণ হচ্ছে অর্থাৎ তা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তরণ হচ্ছে পার হওয়া অর্থাৎ লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া। তরণের উপায় হচ্ছে - এক সত্য ধারণ করে লক্ষ্যের দিকে অবস্থানের পরিবর্তন।
যখন চিন্তা কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ হয় তখন তাকে 'ধারণ' বলে। চিন্তাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে ধরে রাখার অর্থ হলো চিন্তাকে শরীরের অন্য সকল স্থান হতে বিশ্লিষ্ট করে কোন একটি বিশেষ অংশ অনুভব করা। যেমন, শরীরের অন্যান্য অবয়ব অনুভব না করে কেবল হাতটি অনুভব করার চেষ্টা করা কিংবা চিন্তাকে কোন একটি নির্দিষ্ট 'বিন্দুতে' 'ধারণ' করা। 'ধারণ' বিষয়টি কতটা সহজ তা বুঝতে হলে অন্তত ১০মিনিট চর্যা করতে হবে। আপনার সামনে একটি সাদা কাপড় স্থাপন করুন। কাপড়টির মধ্যস্থলে একটি কালো বিন্দু দিন এবং চিন্তা জগতে কেবলমাত্র সেই বিন্দুটিকে ধারণ করার চেষ্টা করুন।
কেবল ধর্ম কথা শুনলে কোন কাজ হয় না। যারা কোন একটা কিছুকে সত্য হিসেবে ধারণ না করবে তারা কখনো সত্য পথের যাত্রী হতে পারবে না। যারা কোন সত্যকে ধারণ করে না, যাদের চিন্তা একটি বিষয়ে কখনও স্থির হয় না, যারা কেবল আমোদ-ফুর্তির জন্য কিংবা সময় কাটানোর জন্য ধর্ম কথা শ্রবণ করে তাদের কাছে ধর্ম চিত্তবিনোদনের উপাদান মাত্র। তারা ধর্মকথা শুনে মন্তব্য করে বাহ্‌ বেশ বলেছেন তিনি, তাঁর কথায় যুক্তি আছে বটে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, তারপর বাড়ি গিয়ে সব ভুলে যায়।
অনেক সময় রাতের বেলা আকাশ থেকে এমন বৃষ্টি হয় যা থেকে ঝিনুক মুক্তা তৈরি করে। এ ধরনের বৃষ্টি যখন হয় তখন সেই বৃষ্টির জল ধারণ করার জন্য সমুদ্রের তলদেশে যত ঝিনুক আছে তা ওপরে ভেসে ওঠে এবং মুখ খুলে
হা করে থাকে। একটি ফোঁটা ভেতরে প্রবেশ করলেই ঝিনুক তা ধারণ করে মুখ বন্ধ করে দেয়। এক ফোঁটা বৃষ্টির জল ধারণ করে সে আবার নদীর তলদেশে চলে যায় এবং ধৈর্যসহকারে বৃষ্টিবিন্দুকে মুক্তায় পরিণত করার সাধনা করে। এমন ঝিনুকের পেটে যে মুক্তা হয় তা হয় অনেক বেশি বড়, উজ্জ্বল এবং মূল্যবান। সব ঝিনুকে মুক্তা হয় না। অধিকাংশ ঝিনুক এক ফোঁটা জলে তুষ্ট হয় না। হা করেই থাকে, বৃষ্টির জল পান করে আর ছেড়ে দেয়, যেসব ঝিনুক এমন করে তাদের পেটে কোন মুক্তা উৎপাদিত হয় না। অধিকাংশ মানুষই হা করে থাকা ঝিনুকের মতো। একটা ছেড়ে আর একটা ধরে কিন্তু কোন কিছুকেই ধারণ করে মুক্তা তৈরির সাধনা করে না।
নিজের মধ্যে মুক্তা উৎপাদন করতে হলে কোন একটা সত্যকে ধারণ করে ঝিনুকের মতো মুখ বন্ধ করে ডুব দিতে হবে। তারপর বহির্জগতের প্রভাব ও সর্বপ্রকার বিক্ষেপের কারণ হতে দূরে থেকে অন্তরে ধারণকৃত সত্যকে বিকশিত করার জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে। শুধু নতুনত্বের জন্য একটি ভাব ধারণ করে আর একটি নতুন ভাব পেলে আগেরটা ছেড়ে নতুনটা ধরলে আমাদের শক্তি বৃথাই ক্ষয় হবে। যা ধারণ করে আছ তা নিয়েই থাকো, প্রচেষ্টা কর। যা ধারণ করে আছো তার শেষ পর্যন্ত দেখ। এইভাবে স্থিত হয়ে যে এক নিয়ে থাকে, এক নিয়ে পাগল হয় কেবল সেই সত্যকে দেখতে পায়। যারা এখানে একটু, ওখানে একটু আস্বাদ করে বেড়ায়, তারা কখনই কোন কিছু লাভ করতে পারে না। কিছুক্ষণের জন্য তাদের স্নায়ু উত্তেজিত হয়, বিনোদন হয় কিন্তু ঐ বিনোদন পর্যন্তই শেষ।
যারা ধার্মিক হতে চান তাদেরকে সবকিছুর স্বাদ ধারণ করার কৌতুহল অবশ্যই বর্জন করতে হবে। একটি সত্যকে ধারণ করে তাকেই জীবনের ব্রত কর, শয়নে স্বপনে জাগরণে সর্বদা তা-ই চিন্তা করতে থাকো। ধারণ অনুযায়ী জীবন যাপন কর। তোমার মস্তিষ্ক, স্নায়ু, পেশী, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ধারণে পূর্ণ হয়ে যাক। অন্য সমুদয় চিন্তা দূরে থাকুক। এটাই সত্য লাভের উপায়। যারা এরকমটি করতে সমর্থ তারাই সাধনায় সফল হয়েছেন, বাকীরা কেবল কথক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

যে যা ধারণ করে আছে তাই তার ধর্ম। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবকিছুরই ধারণশক্তি বা ধর্ম আছে। পৃথিবী ধারণ করে আছে মধ্যাকর্ষণ শক্তি, জল ধারণ করে আছে সিক্ততা, আগুন ধারণ করে আছে দাহ্যতা। বস্তু জগতে যে যা ধারণ করেছে সে তা নিয়েই আছে হাজার হাজার, লাখো লাখো, কোটি কোটি বছর ধরে। কোন একটি বস্তু যদি তার 'ধারণ' ত্যাগ করে তাহলে ঘটে যাবে মহাজাগতিক বিপর্যয়। যেমন - জল যদি সিক্ত না করে, আগুন যদি দহন না করে তাহলে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকবে না। ধারণ কর এবং ধরে রাখো তবেই তুমি ধার্মিক হতে পারবে। এক সত্য কর ধারণ, একেই সরণ একেই তরণ।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন