বুধবার, ২৫ জুন, ২০১৪

সালাতের তাৎপর্য



সালাতের তাৎপর্য

শামস্‌ ॥ সালাত একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। আরবি ভাষায় একটি শব্দ গড়ে দশটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। সালাত শব্দটিরও অনেক অর্থ থাকতে পারে। একজন সব অর্থ বুঝতে সক্ষম হবে এমন কোন কথাও নেই। পরম করুণাময় যাকে যতটুকু জ্ঞান দান করেছেন তিনি ততটুকুই বুঝতে পারেন।
পারিভাষিক অর্থে সালাত শব্দের অর্থ কোনো কিছু সোজা করার জন্য পোড়ানো।  বাঁকা বাঁশের কঞ্চি সোজা করার জন্য প্রথমে আগুনের তাপে একে উত্তপ্ত করা হয়। তারপর ধীরে ধীরে একে কাঙ্খিত আকৃতিতে রূপায়িত করা হয়। মানুষ বাঁকা কঞ্চির মতো। না পুড়িয়ে তাকে সোজা করা যায় না। মানুষের বক্রতাকে সোজা করার প্রচেষ্টাকে সালাত বলে। সোনা পুড়লে খাঁটি হয়। আগুনের উত্তাপে সোনার খাদগুলো সোনাকে ত্যাগ করে তাদের উৎসে ফিরে যায়। মানুষের মধ্যে যেসব ভেজাল আছে সেসব ভেজাল বিষয়গুলোকে দূর করার আগুন হচ্ছে সালাত।  কর্মকার ধাতব পদার্থকে তপ্ত ও গলিত করে হাতুড়ির আঘাতে কিংবা নিজের তৈরি ছাঁচে ঢেলে আপন চিন্তার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটান। সালাতকারীও কর্মের আঘাতে উত্তপ্ত হয়ে বিকশিত করেন নিজেকে।
সালাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের পদ্ধতি, আল্লাহর সাথে বান্দার তথা প্রেমাস্পদের সাথে প্রেমিকের সংযোগ। সালাত মানব দেহে সুপ্ত পরমাত্মাকে উপলব্ধির সাধনা, ভক্তের সাথে ভগবানের, গুরুর সাথে শিষ্যের সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা। এক কথায় ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে যে কোন প্রচেষ্টাই সালাত। ধর্মজীবনের সকল দিক এবং দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সালাত ব্যাপ্ত।  স্ব-রূপ অন্বেষণও সালাত। মানুষ স্ব-রূপত আল্লাহ। নিজেকে যত সুক্ষাতিসুক্ষ্ণভাবে বিশ্ল্লেষণ করা যাবে সালাতের গভীরতা ততই বৃদ্ধি পাবে। সালাত জীবনের রহস্যকে উন্মোচন করার সাধনা। আল্লাহর প্রেমে তন্ময়তার একটা অবস্থায় উন্নীত হবার অনুশীলন। সালাতের উদ্দেশ্য হলো নফস্‌কে সকল আবিলতা হতে নিষ্কলুষ করা। নিজেকে নিরাসক্ত করা। তাই সালাত রিপুর তাড়না থেকে, কাম-লোভ-মদ-মাৎসর্য ইত্যাদি রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করার যুদ্ধ। ইমাম জাফর সাদেকের সংজ্ঞায় - ‘সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে সম্যকভাবে সম্পাদনের নাম সালাত'।
কুরআনে সালাতকারীকে মুসল্লি বলা হয়েছে। সালাত মুসল্লির বিরামহীন কর্ম। কুরআন, যারা পাঁচবার নামাজ পড়ে তাদেরকে মুসল্লি বলে না। মুসল্ল্লি তারাই - ‘যারা তাদের সালাতের উপর সর্বক্ষণ অধিষ্ঠিত থাকে। যাদের ধন সম্পদে যারা চায় এবং যারা চাইতে পারে না তাদের হক নির্ধারিত রয়েছে।  যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে। যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। যারা সাক্ষ্যদানে অটল।' (৭০:২৩-৩৫)। কুরআন মুসল্লির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আবার বলছে -‘মানুষ অতিশয় অস্থিরচিত্ত, বিপদে তারা হা-হুতাশকারী, আবার কল্যাণে তারা কৃপণ; শুধুমাত্র মুসল্লি ব্যতীত যারা তাদের সালাতে নিষ্ঠাবান।' (৭০: ১৯-২৩ ও ৩৪)। উক্ত আয়াতগুলোতে মুসল্লির যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে - তার মূলে রয়েছে - স্থিরতা, বিপদে ধৈর্য ধরা ও মানবতার সেবায় উদারতা প্রকাশ করা। সুতরাং, ব্যক্তি যতক্ষণ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে তাঁর দিকে স্থির থাকে, বিপদে ধৈর্য ধরে এবং মানবতার সেবায় কর্ম করে ততক্ষণ সে সালাতে থাকে।
সালাত আল্লাহর সাথে বান্দার সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা। সংযোগ স্থায়ী হলে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পর্ক একটা অবিচ্ছিন্ন সংযোগ। সত্যের সাথে একাত্ম হয়ে গেলে সত্য থেকে  ব্যক্তির পৃথক কোন অস্তিত্ব থাকে না। আল্লাহ বলছেন - ‘তোমাকে একীন না দেয়া পর্যন্ত তোমার রবের এবাদত কর।' (১৫:৯৯)। একীন এমন একটা উচ্চস্তরের বিশ্বাস যা উপলব্ধির মাধ্যমে সৃষ্ট আত্মপ্রত্যয়। যাদের একীন হয়েছে তাঁরা দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছেন। তাদের চোখ থেকে বস্তুমোহের পর্দা অপসারিত হয়েছে। তাই উন্মোচিত হয়েছে সত্য। তাঁরা সালাতের উপর দণ্ডায়মান বা সালাতে প্রতিষ্ঠিত।
সালাতের মূল উপাদান ধৈর্য, বিনয় ও সাবধানতা।  বিনয়ের সাথে আল্লাহকে স্মরণও সালাত।  আল্লাহ্‌ বলেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে বিশ্বাসীরা, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়-নম্র।' (২৩: ১-২)। বিপদ আল্লাহ থেকেই আসে। তাই বিপদে ধৈর্য ধরাও সালাত। আল্লাহ বলেন - ‘তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।' (২:১৫৩)। অর্থাৎ, ধৈর্য ও সালাত একই পর্যায়ভুক্ত। তোমার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হোক, তোমার শরীর থেকে মাংস খসে যাক্‌ কিন্তু তুমি সালাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। ধৈর্য ধরবে। সালাতের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে কিন্তু কোন কিছুর জন্য সালাত ত্যাগ করবে না। ভয়, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, সম্পদহানি, প্রাণহানি, ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কোনকিছুতেই যেন ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে। ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, আর ধনে-প্রাণে বা ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করব।' যারা সমস্ত বিপদ আপদকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ধৈর্যের সাথে পরীক্ষা দিতে থাকেন তাদের জন্যই সুখবর দিতে বলা হয়েছে (২:১৫৭)। একইভাবে সাবধনতাও সালাত। তাই আল্লাহ কুরআনে বারবার বলেছেন - ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সাবধানিদেরকে ভালোবাসেন।' (৯:৪,৭)। ‘আল্লাহ সাবধানিদের সঙ্গে আছেন্তু (৯:৩৬ ও ১২৩)। সাবধানিদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে জান্নাতুন নঈম। (৬৮:৩৪)। তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান যে সাবধানি।' (৪৯:১৩)। সুতরাং, সাবধানতাও সালাত।
পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাদির সমাধান করার প্রচেষ্টাও সালাত। এইক্ষেত্রে সালাত শব্দের অর্থ মিটিং বা সভা। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য যখনই সভা আহ্বান করা হবে তখনই যেন সবাই তার ব্যক্তিগত কাজ থেকে সামাজিক কাজকে অধিক গুরুত্ব দেয় এবং সভায় উপস্থিত হয়। আলোচনার বিষয় পূর্বেই জানা থাকলে এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে যেন সভায় যোগদান করে। আলোচ্য বিষয় নিয়ে নিজস্ব প্রস্তাব গঠন সালাতের প্রস্তুতি। সভায় আদব রক্ষা করা সালাতের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই কুরআন যথার্থ আদব রক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলছে -‘সালাতে (সভায়) স্বর উচ্চ করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না; এ দুয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করো।' (১৭: ১১০)।  ‘প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক পড়বে।' (৭:৩১) ।  সভায় শান্তভাব বজায় রেখে যেন সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করা হয়। এরকম সভার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে শান্তি স্থাপন। শান্তি স্থাপনের উদ্দেশে আহুত সভায় যেন কোন রকমের অশান্তির সৃষ্টি না হয়। এইভাবে সমাজে শান্তি স্থাপনের জন্য সমবেত হলে পৃথিবীতে ইসলাম বা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যথায় পৃথিবী জাহান্নাম বা নরকে পরিণত হবে। তাই সালাতে অংশগ্রহণ না করলে জাহান্নামের বাসিন্দা হতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘সালাত কর দিবা ভাগের দু'প্রান্তে ও রাতের প্রথমাংশে। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়।' (১১: ১১৪)। আয়াতটির তিনটি তাৎপর্য আছে এবং তিনটি তাৎপর্যই গুরুত্বপূর্ণ। ১. সকাল সন্ধ্যার এমনভাবে সালাত করতে হবে যেন সৎকর্ম অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়। সকালের সালাতে সারাদিনের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। দিনের শুরুতে আজ কি কি কাজ করতে হবে তার তালিকা প্রস্তুত করা দিবাভাগের প্রথম প্রান্তের সালাত। এই সালাত একাকি করলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিকল্পনা থাকবে। সকালের সালাত প্রয়োজনে জামাতে করলে সামাজিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। কর্মপরিকল্পনা (সালাত) শেষে সালাতকারীগণ তা বাস্তবায়নে লেগে যাবেন। সন্ধ্যার সালাত হবে পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তার মূল্যায়ন। রাতের প্রথমাংশে নিজের বিচার নিজে করার কাজ শেষ করতে হবে। এভাবে সালাত করলে নিঃসন্দেহে সালাত মন্দ কাজ থেকে সালাতকারীকে বিরত রাখবে। যারা এভাবে সালাত  করেন নিশ্চয়ই তারা সফলকাম।  ২. দ্বিতীয় তাৎপর্যটি আধ্যাত্মিক। সকালে সূর্য উঠে, সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যায়। আলোর আগমন এবং প্রস্থানের সাথে সমগ্র প্রকৃতিতে, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে পরিবর্তন ঘটে। তাই এই বিশেষ দু'টি সময় সম্পর্কে বিশেষভাবে সাবধান থাকতে হয়। আলোর আগমন ও প্রস্থানে নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটে এই পরিবর্তন সম্পর্কে সাবধানতাকে সকাল সন্ধ্যার সালাত বলা হয়েছে। ৩. আলো জ্ঞানের প্রতীক আর অন্ধকার অজ্ঞানতার প্রতীক। তাই সকাল সন্ধ্যার সালাতের অপর তাৎপর্য হলো, অজ্ঞানতাকে দূর করে আলোর জগতে প্রবেশ চেষ্টা। সকালের সালাতে জ্ঞান রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা এবং সন্ধ্যার সালাতে অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত থাকার প্রচেষ্টা এই দুটি প্রচেষ্টা ক্রিয়াশীল থাকলেই সৎকর্ম অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়। জ্ঞানী কখনও কোন মন্দ কাজ করতে পারেন না।
কুরআনের নির্দেশ হলো ‘সালাতকে দাঁড় করাও' অর্থাৎ সালাতের পতন হতে দিও না। দাঁড়িয়ে থাকা শুয়ে থাকার  বিপরীত। তাই সালাতে দাঁড়াও অর্থ সজাগ থাক। ঘুমিয়ে পড়ো না। যেখানে যে অবস্থায় আছো সর্বত্র সতর্ক থাকো। যখন যেখানে থাকবে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে। পক্ষান্তরে, সালাত থেকে পতিত হওয়া মানে কুরআনিক আদর্শ ও নীতি থেকে পতিত হওয়া। সালাতে অর্থাৎ তোমার নীতি ও আদর্শে তুমি এতটাই অবিচল থাকবে যেন মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন কিছু তোমাকে টলাতে না পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন