সুখ
সুখ করি আমি সুখ কি আমার রবে চিরদিন
কালে
কালে সুখ হবে কালেতে বিলীন
দিগন্ত ॥ সুখ অর্জনের প্রচেষ্টা সবাই করে। মানুষ জীবনের
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুঃখ মুক্তির আন্দোলনে ব্যস্ত থাকে। দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন
হলে মানুষ দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করে এবং দুঃখ অপনোদনের প্রয়াস করে। মানুষ দুঃখ কিছুতেই
চায় না, চায় সুখ, সুখের অনুভূতি। প্রতিদিন পাগলের মতো আমরা সুখের পশ্চাতে ধাবিত হই।
সুখের নাগাল পাওয়ার পূর্বেই দেখি সুখ কালেতে বিলীন হয়েছে। সুখ ধরে রাখা যায় না। আঙ্গুলের
ফাঁক দিয়ে যেমন পানি পড়ে যায় তেমনি হারিয়ে যায় সুখ। তবুও আমরা উন্মত্তভাবে সুখ সুখ
করি। কত মোহান্ধ ও নির্বোধ আমরা!
ক্ষুধার্ত মানুষ সুখ চায় না। ক্ষুধার্ত মানুষ চায় খাদ্যবস্তু।
খাদ্য গ্রহণ করার সময় মানুষ যে তৃপ্তি পায় তাকে সুখ বলা চলে। অর্থাৎ সুখ হলো কাম্য
বস্তু ভোগের অনুভূতি। অর্থাৎ বাস্তবে মানুষ কামনা করে বস্তু। কারণ কোনরূপ বিচার বিবেচনা
ব্যতীত যে কর্ম অধিকতর সুখ প্রদান করে তা-ই যদি মানুষ করতে থাকে তবে পরিণামে মানুষ
দুঃখই প্রাপ্ত হবে। যেমন, ভোজনে যে সুখ আমরা পাই তা যদি বিচার বিবেচনা না করে বাড়াতে
থাকি তবে অচিরেই তা অসুখ সৃষ্টি করবে। তাই সুখের ঊর্ধ্বে বিচার বিবেচনার স্থান।
সুখ বা দুঃখ আমরা অনুভব করি। ইন্দ্রিয় অনুভূতি তীব্র তাই
ইন্দ্রিয় সুখও তীব্র। কবিতা পাঠের চেয়ে সুস্বাদু ভোজন তীব্র ইন্দ্রিয় সুখানুভূতি দেয়।
আমরা সুখ সুখ করি কিন্তু সুখই যদি লক্ষ্য হয় তবে তুলনামূলকভাবে যে সুখ তীব্র তা-ই কাম্য
হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে মানুষ যদি ইন্দ্রিয় সুখকেই সর্বদা প্রাধান্য দেয় তবে তা
অতি দুঃখের কারণ হবে। অন্যদিকে, ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তিতে যে সুখ হয় তার প্রবলতা ক্রমশঃ
বিলুপ্ত হয়। যে জীবনে কোনদিন আপেল খায় নাই সে প্রথম আপেলটির জন্য যে মূল্য দিতে প্রস্তুত
দ্বিতীয় আপেলের জন্য তার চেয়ে কম মূল্য দেবে। অর্থনীতিতে একে বলা হয় ক্রমহ্রাসমান উপযোগ
বিধি। বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় সুখে অভ্যস্থ হয়ে গেলে তা শিথিল হয়ে যায়।
দৈনন্দিন জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই হয় যখন একা
কোন সুখ ভোগ করলে অনেকের দুঃখ হয়। সে ক্ষেত্রে কেবল নিজের সুখ ভোগ করলে পরিণামে দুঃখের
অনুভূতি হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে এক ব্যক্তিকে কষ্ট দিলে অনেক লোকের সুখের
অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে সুখই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে বিত্তবানের বিত্ত বলপূর্বক
অধিগ্রহণ করে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা ন্যায় বিবেচিত হবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটি করা
অপরাধ। এসব ত্রুটির কারণে সুখ জীবনের লক্ষ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। সুখ-দুঃখ, ভালো
লাগা-খারাপ লাগা এসব আবেগাত্মক বিষয়কে ধর্ম অধর্মের মানদণ্ড করা যায় না।
ধর্মীয় বিবেচনায় সুখের অনুভূতিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া যায়
না। কারণ সুখের পরিমাণগত এবং গুণগত পার্থক্য আছে। কবিতা পাঠের সুখ আর ভোজনের সুখ এক
নয়। জ্ঞানীর সুখ আর মূর্খের সুখ এক নয়। কখন কোন্ বস্তু কাকে কতটা সুখ দেবে তা পরিমাপ
করা যায় না। চিন্তার বিকৃতিও মানুষের মধ্যে সুখ উৎপন্ন করতে পারে। অন্যকে কষ্ট দিয়ে,
অন্যের উপর অত্যাচার করেও অনেকে সুখ পায়। হিংসা, ঈর্ষা, পরনিন্দাও মানুষকে সুখ দেয়।
এ জাতীয় সুখ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অকল্যাণকর। কোন বস্তুর স্বাদ যেমন নির্ণয় করে না
যে বস্তুটি স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ভালো ঠিক তেমনি সুখের অনুভূতিও প্রমাণ করে না যে
কাজটি বিচার-বিবেচনায় ভালো।
এ জগতে সুখী মানুষের সংখ্যা খুব কম। প্রত্যেকেরই কোন না
কোন দুঃখ রয়েছে। কোন ব্যক্তি হয়তো খুব বিত্তবান, প্রচুর সুস্বাদু খাদ্য তার কাছে মজুদ
আছে কিন্তু সে খেতে পারে না, ডায়াবেটিস কিংবা পরিপাক যন্ত্রের ত্রুটির কারণে। অন্যজন
সম্পূর্ণ সুস্থ, পরিপাক যন্ত্রও উত্তম কার্য করে কিন্তু তার হয়তো মুখে দেয়ার মতো খাবার
জোটে না। কারো অনেক সন্তান। সন্তানদের কি খাওয়াবে, কি পড়াবে, এ নিয়ে তার দুঃখের শেষ
নেই। অন্যজনের অনেক বিত্ত কিন্তু নিঃসন্তান।
সুখ-দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দুঃখ ব্যতীত সুখ এবং সুখ
ব্যতীত দুঃখকে গ্রহণ করা যায় না। দুঃখ চাওয়া যেমন মর্যাদার নয় তেমনি সুখ চাওয়াতে কোন
মর্যাদা নেই। যাদের সম্যক বিচারবুদ্ধি আছে তারা সুখের পশ্চাতে যেমন ছুটবে না তেমনি
ছুটবে না দুঃখের পশ্চাতেও। যে সত্যকে নিয়ে আছে সে তো কেবল সত্যকে নিয়েই থাকবে। সুখ
কিংবা দুঃখ যে কোন পরিস্থিতিতে সে সাম্যে স্থিত, পরিতৃপ্ত শুধু এই কারণেই যে সে সত্যের
সঙ্গে আছে। যে সত্যের সঙ্গে আছে, সত্যও যার সঙ্গে আছে তার চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোন কারণই
নেই। তাই সুখ বা দুঃখ নয়, সত্যকে নিয়ে থাকাই হলো মানুষের জীবনে মূল কাজ।
যে মানুষ সত্য নিয়ে কাজ করে তার মধ্যে স্থূল সুখ প্রাপ্তির
তাগিদ থাকে না, থাকে আনন্দ সমপ্রাপ্তির এষণা। সুখ ও আনন্দ এক নয়। কুকুর হাড় চিবোতে
থাকে, তাতেই তার সুখ, কিন্তু মানুষ হাড় চিবোবার আগে ভাববে, চিবোনোটা উচিত কিনা; সে
ভেবে দেখে ওটা তার ক্ষুধা নিবারণ করবে কি-না। মানুষ বিচার করে কাজ করবে, কারণ মানুষের
লক্ষ্য আনন্দ প্রাপ্তি, সুখ প্রাপ্তি নয়। মানুষ যদি সুখের পেছনে দৌড়োতে থাকে তাহলে
ধীরে ধীরে সে পশুর দশা প্রাপ্ত হবে। পশুর জীবন নিছক ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের জন্য আর মানুষের
জীবন আধ্যাত্মিক আনন্দানুভূতির জন্য।
সুখ একটি অনুভূতি।
অনুভূতি চেতনার একটি অবস্থা মাত্র। চেতনার রূপান্তর মানুষের আয়ত্বে। ইন্দ্রিয়
সুখের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যই শ্রেয়। বিলোপে ও সংযমে অনেক প্রভেদ। ইন্দ্রিয়ের বিলোপ ধর্ম
নয়। ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রের সামঞ্জস্যই ধর্ম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন