মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০১৩

সময়ের কান্ডারী



সময়ের কান্ডারী

সংলাপ ॥ আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে বলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মন্তব্য রাজনীতিতে বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, একই সঙ্গে তার রাজনীতিতে আগমনকে বিতর্কিত করছে । রাজনীতির শুরুতেই তার এই বক্তব্য দুষ্ট রাজনীতিকদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তিনি রাজনীতি শুরু করেছেন যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, যে রাজনীতিকে সত্যের পথে চাঙ্গা করে তুলতে হবে আগামী চার মাসের মধ্যে তবেই দেশবাসী তাকে আপন করে নেবে। জয়ের এখন সময় তৃণমূলে যাওয়া তারপরে রাজনীতিতে নিজস্ব মেধায় রূপরেখা প্রনয়ণ করা। রাজনীতিতে তার  আগমন তরুণ সমাজ ও নেতৃত্বের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করুক এটাই জাতির কামনা।
রাজনীতিতে জয়ের আগমন আকস্মিক নয়। গত নির্বাচনের আগেও গুঞ্জন উঠেছিল তিনি রাজনীতিতে আসছেন। এবার তিনি এসেছেন কিন্তু  রাজনীতির মাঠটি কর্দমাক্ত। আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থায় নেতৃত্বে তরুন প্রজন্মের বিকল্প নেই । রাজনীতিতে আসার আগে জয়ের যে রাজনৈতিক শিক্ষা নেয়া হয়েছে তার প্রতিফলনের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে যাওয়া সময়ের দাবী। বছরের পর বছর রাজনীতি করে আওয়ামী নেতৃত্ব আদর্শিক যায়গায় দিশেহারা হওয়ার পথে, তাই এখন নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির নিশ্চয়তা করনের পথ ধরে জনতাকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামতে হবে তবেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। সংকীর্নতা আর মিথ্যাচার পরিহার করে সত্যের ঝান্ডা ধরে সাংষ্কৃতিক আন্দোলনের পথই এখন জাতীয় জীবনে কাম্য। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। জয় যে বলেছেন, তার কাছে তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। সেই তথ্য উপাত্ত কী তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘূর্নিঝড় উঠেছে। তার এই বক্তব্য নতুন করে বিরোধী মহল ভয়ে বিচলিত হয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করছে।
জয়কে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতিতে তিনি কী ভূমিকায় থাকবেন-বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজ পরিবর্তন না শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দৌহিত্র? বঙ্গবন্ধু ছিলেন হৃদয়বান এবং বাঙালি মনষতার শীর্ষে। বঙ্গবন্ধুর নাতি হিসেবে জনমনে যে উচ্ছাস রয়েছে তা নিয়েই রাজনীতিতে তার যাত্রা হোক শুরু। জয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখতে চায় জাতি। 
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর মতো একটি বিশাল ভুমিকা রাখার সুযোগ এখন জয়ের সামনে। নির্বাচন ব্যবস্থা কী হবে কার অধীনে হবে এমন বিতর্ক চলছে। রয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জয় নতুন প্রজন্মের কান্ডারি হয়ে একটি জাতীয় গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নিক এবং বঙ্গবন্ধুর মতোই বাঙালির ভালোবাসা পাক এটাই সময়ের প্রত্যাশা।

ধর্মের নামে মিথ্যাচার জনগণকেই বন্ধ করতে হবে



ধর্মের নামে মিথ্যাচার
জনগণকেই বন্ধ করতে হবে

সাদিকুল হক ॥ যা সত্য নয় তাই মিথ্যা। কারো কারো মতে শুধুমাত্র জেনেশুনে মিথ্যা বললেই তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে; ভুলবশত, কিংবা অনিচ্ছায় প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কিছু বললে তা মিথ্যা বলে গণ্য না করে অজ্ঞতা হিসেবে গণ্য করা উচিত। কথা বলার আগে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা বক্তার দায়িত্ব। যে যা বলে তার দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়, অন্যের উপর চাপানো যায় না। বক্তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অজ্ঞতা বা অন্য কোনো বিষয় এখানে ধর্তব্য নয়। সুতরাং ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছাকৃতভাবে, অজ্ঞতার কারণে বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক বাস্তবের বিপরীত কোনো কথা বলাই মিথ্যা। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত যে কোন কালের কথা বাস্তবের বিপরীত হলে তা মিথ্যা বলে বিবেচিত হবে। ভবিষ্যত সম্পর্কেও যদি কেউ বলে - ‘আজ বৃষ্টি হবে’, বৃষ্টি না হলে সে মিথ্যাবাদী হিসেবে গণ্য হবে। ধর্ম, জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে মিথ্যাকে পাপ, অন্যায় ও ঘৃণিত মনে করা হয়। কুরআনে মিথ্যাচারকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষকে সর্বাবস্থায় সত্যপরায়ণ হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে মিথ্যাকে ঘৃণিত পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তজ্জন্য ভয়াবহ শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। সত্যই ধর্ম, সত্যই পুণ্য, সত্যই শান্তি দাতা। যিনি সত্য বলেন তিনি আল্লাহর কাছে ‘সিদ্দীক’ হিসেবে সম্মানীত হন।
কুরআন সর্বাবস্থায় ও সার্বক্ষণিক সত্যবাদিতার নির্দেশ দিয়ে বলছেন -
“হে আমানুগণ! তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।” (সুরা তওবাঃ ১১৯)। “যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ন্যায্য বলবে স্বজনের সম্পর্কে হলেও।” (সুরা আন’আমঃ ১৫৩)। “সত্যবাদী পুরুষ এবং নারী...এদের জন্য আল্লাহ্‌ ক্ষমা ও মহা প্রতিদান রেখেছেন।” (সুরা আহজাবঃ ৩৫)। “হে আমানুগণ! আল্লাহ্‌কে ভয় কর এবং সত্য কথা বল, তাহলে তিনি তোমাদের কর্মকে ত্রুটিমুক্ত করবেন ও তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেবেন।” (সুরা আহজাবঃ ৭০-৭১ )।
অন্যদিকে, কুরআনে মিথ্যাকে ভয়ঙ্কর পাপ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাপ মানুষকে দুঃখ ও দুর্দশার দিকে পরিচালিত করে। যে মিথ্যা বলে বা মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে সে এক পর্যায়ে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মিথ্যা বলা মুনাফিকীর অন্যতম চিহ্ন। তাই কুরআনিক মুসলিম অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু কখনো মিথ্যা বলতে পারে না। কুরআন নির্দেশ দিচ্ছে -
“মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাক।” (সুরা হজঃ ৩০)। “হে ঈমানদার লোকেরা যা কার্যত তোমরা করছ না, তা কর বলে মুখে দাবি কর কেন? যা কর না, তা করো বলে প্রচার করা তো আল্লাহ্‌র নিকট খুবই জঘন্য কাজ। (সুরা সাফ ঃ ২-৩)। “নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মিথ্যাবাদী ও অকৃতজ্ঞকে হেদায়েত দান করেন না।” (সুরা আজ যুমা : ৩)। “যে মিথ্যাবাদী, তার উপর আল্লাহ্‌র অভিশাপ বর্ষিত হোক।” (সুরা আলে ইমরানঃ ৬১)। “আর যে ব্যক্তি নিজে কোন অন্যায় বা পাপ করে, অতঃপর কোন নির্দোষ ব্যক্তির উপর তার দোষ চাপিয়ে দেয় সে তো নিজের মাথায় বহন করে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য গোনাহ।” (সুরা নিসাঃ ১১২)। “আল্লাহ্‌র লা’নত তার উপর যদি সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।” (সুরা নূরঃ ৭)।
মিথ্যার প্রভাবে মানুষ ধর্মের নামে এমন সব কর্মে লিপ্ত হয় যা পার্থিব জীবনে হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি করে। পূর্ববর্তী ধর্মগুলির দিকে তাকালে আমরা বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। যেমন,  বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ী  হযরত ঈসা (আ.) তাঁর অনুসারীদের এক আল্লাহর ইবাদত করতে, পূববর্তী ধর্মের ১০ মূলনির্দেশ পালন করতে, খাতনা করতে, তাওরাতের সকল বিধান পালন করতে এবং অন্যান্য কর্মের আদেশ নিষেধ উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু সাধু সন্তদের বাণী ও ব্যাখ্যার চাপে বাইবেলের আদেশ উপদেশ নিষেধ চাপা পড়ে গেছে। ফলে ক্রমান্বয়ে বিশ্বের কোটি কোটি মানব সন্তান ত্রিত্ববাদের ব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়েছে। আমরা অন্যদের দোষ দেখি, কিন্তু নিজেদের দোষ সচরাচর দেখি না। ইসলাম অনুসারীরাও যে এখন মিথ্যা হাদীসের চাপে পড়ে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ধ্বংস এবং শিরকের মধ্যে পতিত হচ্ছে তা আমাদের নজরে পড়ে না।
মিথ্যা সর্বদা ঘৃণিত। মিথ্যা যদি ওহীর নামে হয় তাহলে তা আরো বেশি ঘৃণিত ও ক্ষতিকর। সাধারণ মিথ্যা মানুষের বা মানব সমাজের জন্য জাগতিক ক্ষতি বয়ে আনে। আর ওহীর নামে মিথ্যা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ধ্বংস ও ক্ষতি করে। ওহীর নামে মিথ্যাচার সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা হওয়ার কারণে কুরআনুল কারীমে ওহীর নামে বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) নামে মিথ্যা বলতে কিংবা সন্দেহ জনক কিছু বলতে কিংবা আন্দাজে কিছু বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআনের নির্দেশ -
“যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তা অনুসরণ করো না। কান, চোখ, মন প্রত্যেকের কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (সুরা বনি ইসরাইলঃ ৩৬)।
“হে আমানুগণ তোমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুমান থেকে দূরে থেকো। কারণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কল্পনা বা           অনুমান করা পাপ।” (সুরা হুজুরাতঃ ১২)।
কুরআনের নির্দেশ উপেক্ষা করে ‘ওহী’র নামে মিথ্যাচার চলছে সকল প্রচার মাধ্যমে। ওহীর নামে মিথ্যা প্রচারের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত, নিজে ওহীর নামে মিথ্যা বলা ও দ্বিতীয়ত, অন্যের বলা মিথ্যা গ্রহণ ও প্রচার করা। উভয় পথ রুদ্ধ করার জন্য কুরআনে আল্লাহর নামে মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। অপরদিকে কারো প্রচারিত কোনো তথ্য বিচার ও যাচাই না করে গ্রহণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)-এঁর নামে যে কোন কথা বলার আগে নির্ভুলতা যাচাই করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয। জাগতিক সকল বিষয়ের চেয়েও বেশি সতর্কতা ও পরীক্ষা করা প্রয়োজন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এঁর বাণী গ্রহণের ক্ষেত্রে। কারণ জাগতিক বিষয়ে ভুল তথ্য বা সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করলে মানুষের সম্পদ, সম্মান বা জীবনের ক্ষতি হতে পারে কিন্তু আল্লাহ, রাসূল (সা. )-এঁর নামে মিথ্যা বললে ইহকাল ও পরকালের অনন্ত জীবনের জন্য ধ্বংস নেমে আসবে।
ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার বিকৃতি, ভুল বা মিথ্যা থেকে ওহীকে রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব। প্রত্যেক মুসলিমকে স্মরণে রাখতে হবে, “যে ব্যক্তি রাসূলের (সা,) নামে মিথ্যা বলবে তার আবাসস্থল জাহান্নাম”। অথচ রাসুল (সা.)-এঁর নামে মিথ্যাচার চলছে হিজরি তৃতীয় শতক থেকে। ধর্ম প্রচারের নামে জাল হাদীস প্রচারের জঘন্য মিথ্যাচার শুধু যে অব্যাহত রয়েছে তা নয়, দিন দিন তা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাহাবীগণ হাদীস রচনা করেন নি এবং তাঁরা হাদীসের নামে সকল মিথ্যাচারকে প্রতিরোধ করতেও সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা না  থাকার কারণে অনেক ধর্মভীরু মানুষ ও ধর্মবেত্তারা না জেনে হাদীস বলেন, প্রচার করেন বা লিখেন। এভাবে সমাজে কুরআনের বদলে প্রাধান্য লাভ করছে হাদীস। আর আল্লাহর হাদীস বা কুরআন ক্রমেই চাপা পড়ে যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে অগণিত বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা কথা হাদীস নামে আমাদের সমাজে প্রচারিত হয়েছে ও হচ্ছে। ফলে আমরা দুইদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। একদিকে, এ সকল বানোয়াট হাদীস আমাদেরকে কুরআনের শিক্ষা, চর্চা ও আমল থেকে বিরত রাখছে। অন্যদিকে, এগুলির উপর আমল করে আমরা আল্লাহর কাছে পুরস্কারের বদলে শাস্তি পাওনা করে নিচ্ছি। ধর্মভীরু মানুষ মিথ্যাচারে        বিশ্বাস করে কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত  হচ্ছে।
প্রায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্‌ আজ হাদীসের খপ্পরে পড়ে গেছে। হাদীসের প্রচারে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত  হচ্ছে ইসলাম। একদিকে আল্লাহ তায়ালা একবারও যা করতে বলেন নি তা হয়ে গেছে এখন মুসলমানের মানদন্ড (যেমন - দাড়ি রাখা, টুপি পড়া ইত্যাদি আরো অনেক কিছু)। অন্যদিকে মানুষ মনোযোগ দিতে পারছে না কুরআনের প্রতি। ফলে কুরআনের উদার, মানবিক আহ্বানের প্রতি সাড়া দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ তৈরী হচ্ছে না। আমাদের দেশে একদিকে যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসের পঠন, পাঠন ও চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে কমছে কুরআন চর্চা। কুরআনের প্রতি বিশেষ অবহেলা পরিলক্ষিত হচ্ছে সর্বত্র।
হাদীস সংক্রান্ত নানারকম মারাত্মক বিভ্রান্তিতে আছে মুসলিম উম্মাহ। অনেকে হাদীসবেত্তারাই মনে করেন ‘হাদীস’ মানেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এঁর বাণী, কাজেই কোনো হাদীসকে দুর্বল বলে মনে করার অর্থ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এঁর কথা বা বাণীকে অবজ্ঞা করা। তাদের মতে - যত দুর্বলই হোক, যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এঁর কথা, কাজেই তাকে গ্রহণ ও পালন করতে হবে। কিন্তু কথাটি প্রকৃতই রাসূলুল্লাহ (সা.) -এঁর কি-না, কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কি-না তা তারা যাচাই করে দেখতে চান না।
মুসলিমের দায়িত্ব হলো কুরআন অধ্যায়ন, বুঝা এবং কুরআন দর্শনকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করা, লালন করা, পালন করা। প্রত্যেক মুসলিমকে আল্লাহর দরবারে তার নিজ কর্মের হিসাব দিতে হবে। অন্যে কারো কর্মের জন্য আমাদের দায়ী করা হবে না, হিসেবও চাওয়া হবে না। তাই কথায় কথায় হাদীসের ব্যবহার থেকে প্রত্যেক মুসলিমকে সতর্ক হতে হবে। কোন অজুহাত দেখিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকেই বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। প্রত্যেককেই দিয়েছেন চিন্তা করার ক্ষমতা, সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার ক্ষমতা। পৃথিবীর অনেক মানুষ মিথ্যা বললেও মিথ্যা বলা বৈধ হয় না। জেনে বা না জেনে অধিকাংশ মানুষ মিথ্যা বলছে তাই বলে আমিও মিথ্যা বলব এটা কোন যুক্তি হতে পারে না। যে কোন বিষয়ে বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা করে সত্যের অন্বেষণ করা প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। আমার আহার যেমন অন্য কেউ গ্রহণ করতে পারে না ঠিক তেমনি আমার স্থলে কেউ সত্য অন্বেষণ করে তৈরি সত্য আমার কাছে সরবরাহ করতে পারে না। আমার সত্য আমাকেই আবিষ্কার করতে হবে। যে কোন বিষয়ে হাদীসের উদ্বৃতি দেওয়ার আগে জেনে নিতে হবে যা বলা হচ্ছে তা কি সঠিক? কারো কথায় প্রভাবিত না হয়ে প্রত্যেককে অনুসন্ধ্যিৎসু হতে হবে এবং প্রয়োজনে গবেষণা করে সত্য আবিষ্কার করতে হবে। নতুবা হাদীস বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ যদি জীবনে একটি হাদীসও না বলে তাহলে তার কোন পাপ হবে না কিন্তু রাসুল (সা.)-এঁর নামে একটি কথাও যদি মিথ্যা বলা হয় তা হলে তা হবে মহাপাপ। এমনকি ধর্ম প্রচারের জন্য কিংবা অন্য কোন সৎ উদ্দেশেও যদি কেউ রাসুল (সা.)-এঁর নামে মিথ্যাচার করে তবে তা কঠিনতম পাপ। মুসলিম উম্মাহ একমত যে, রাসুল (সা.)-এঁর নামে মিথ্যা বলা হারাম। যে ব্যক্তি রাসুল (সা.) -এঁর নামে মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতে পারে না তার পান ও আহারের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম বিচার মূল্যহীন।
মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের এই মহাপাপ থেকে রক্ষা  করেন। আমাদের জীবন আবর্তিত হোক কুরআনকে             কেন্দ্র করে।

কুরআনের আলোকে সময়ের সাফ কথা....নারী পুরুষ সম্পর্কে শফীর চাতুরালী সাফাই



কুরআনের আলোকে সময়ের সাফ কথা....
নারী পুরুষ সম্পর্কে শফীর চাতুরালী সাফাই

- আল্লামা মোহাম্মদ সাদেক নূরী

বিগত ২০ জুলাই বাংলাদেশ প্রতিদিন সংখ্যায় জনাব আহমদ শফীর বহুল সমালোচিত নারী-পুরুষ সম্পর্কিত তথ্যের একটি সাফাই প্রকাশিত হয়েছে; সাফাইটি প্রবঞ্চনাকর এবং চাতুরালী। হেফাজত নেতা আহমদ শফী তাতে কুরআনের বদলে যে আমেরিকায় ‘নিউড্‌ পার্কে' শত সহস্র নর-নারীর বিবস্ত্র বিচরণ বৈধ, সে দেশের বেনামা বরাত দিয়ে প্রথমে তিনি তার সমালোচিত উক্তিটি বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবি করেন; অপরদিকে, ‘যে ভিডিওচিত্রের কথা বলে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে তা আমার কিনা বুঝতে পারছি না, বলে তিনি প্রবঞ্চনামূলক চাতুরালীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাওহিদি জনতা তথা দেশবাসি কথিত কোন ইসলামী নেতার অনুরূপ চাতুরালী, কুরআনের ভাষায় মুনাফেকি মানসিকতা বা বক্তব্য মেনে নিতে ও বরদাশ্‌ত করতে মোটেই রাজি নন। তিনি নিজেই নিজেকে সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যস্পদ করে তুলছেন।  তার এরূপ চাতুরালী সাফাইতে সচেতন দেশবাসি চরমভাবে ক্ষুব্ধ। আমেরিকায় কে কবে কি বলেছে, তা তার মনে আছে, আর নিজের কণ্ঠ তিনি বুঝতে পারেন না, এটাও জনগণের বিশ্বাস করতে হবে!
হায়রে, ইসলামজীবীদের তথাকথিত শিক্ষা, চরিত্রদশা আর মানসিকতা! অপরদিকে মেয়েদের শিক্ষা এবং বাইরে না যাওয়া তথা ঘরের মধ্যেই থাকা সংক্রান্ত তার বক্তব্যের ব্যাপারে উক্ত সাক্ষাৎকারে তার নিরবতা, বক্তব্যটির প্রতি তার সম্মতি ও স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে, যা কুরআনের এ বিষয়ক নীতি-নির্দেশনাদির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এবং মনগড়া ও পরিত্যাজ্য। নিজের, সমাজের, দেশ ও জাতির স্বার্থ, উন্নয়ন ও উন্নতির প্রয়োজনে এ সম্প্রদায়ের ধর্মজ্ঞানহীনদের শোধন করার এখনই সময়; স্মরণীয় যে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না

রমজান



রমজান

সংলাপ ॥ রমযান মাসে আল্লাহর রহমতের দ্বার অবারিত করা হয়। রহমত মানে আল্লাহর অনুগ্রহ। অনুগ্রহ ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এর তা?পর্য ব্যাপক। আল্লাহ আমাদের যতো কাজের যোগ্যতা দিয়েছেন, শারীরিক সুস্থতা দিয়েছেন, ভাববার মতো চেতনা দিয়েছেন, উদ্ভাবন করার শক্তি দিয়েছেন, কথা বলা, কাজ করা, চিন্তা-ভাবনা করার সামর্থ দিয়েছেন, মেধা দিয়েছেন, মনন দিয়েছেন, সেগুলোকে ব্যবহার করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদায় উন্নীত করার সুযোগ দিয়েছেন-এ সবই আল্লাহর অনুগ্রহ। আবার অনুগ্রহ মানে ক্ষমা।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে,  রমযান মাস আসলেই কেবল কুরআনের মাহাত্ম্য বা মর্যাদা নিয়ে আমরা কথা বলি,  কুরআন পাঠ করি, ইফতার পার্টি করি বা যোগ দিই কিন্তু কুরআনিক মূল্যবোধগুলো চর্যা করি না আবার মিথ্যাও বলি বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বাকি মাসগুলোতে কুরআনকে নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে ভুলে যাই। আর রমযান আসলে আমরা নিজেদেরকে লোক দেখানো সংযত রাখার চেষ্টা করি, রমযান চলে গেলেই আমরা পুনরায় উদ্ধত হয়ে পড়ি। ফলে এগারো মাস কাউকে ভুলে থেকে একটি মাত্র মাসে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার চেষ্টা করলে যে কতোটা তুষ্ট হবেন - তা কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়। তবুও চেষ্টা করতে হবে রমযানের মাসটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সর্বাধিক অর্জন করার এবং রমযানের সময়কার ইবাদত চর্চাকে অন্যান্য মাসেও অব্যাহত রাখার। তবে রমযান মাসকে যেহেতু আল্লাহ নিজের বলে ঘোষণা দিয়েছেন, সেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ মাসকে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে হবে। আল্লাহ যেহেতু রহমান এবং রাহীম, সেহেতু তিনি সন্তুষ্ট হলে তাঁর রহমতের বারি দিয়ে মানুষ জাহান্নামের আগুনকে নিজের জন্যে নিভিয়ে দিলেও দিতে পারেন। এই সুযোগটাও  আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট একটা রহমত।
হিজরী পঞ্জিকার বারোটি মাসের মধ্যে একটি মাসের নাম হলো রমযান। পবিত্র কুরআনে কেবলমাত্র এই রমযান মাসেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেই বিশ্লেষকমহল বলছেন যে, আল্লাহর কাছে এ মাসটির অসামান্য মর্যাদা রয়েছে। যেমনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেন, ‘আস সাওমু লি, অ-আনা আজযি বিহী' অর্থা? ‘রোযা আমার জন্যে রাখা হয়।

আদর্শিক জননীতি হোক রাজনীতি



আদর্শিক জননীতি হোক রাজনীতি

সংলাপ ॥ রাজনীতি একটি আদর্শিক বিষয় যার মধ্যে আছে জননীতি প্রত্যেকে আমরা পরের তরে এবং সুষ্ঠু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, শুধু ক্ষমতা ভোগ আর শোষণের জন্য নয়। তার জন্য স্বশিক্ষা এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ আর উচ্চ পর্যায়ের জনজীবন নিয়ে সাধনার প্রয়োজন হয়। ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিকের ছেলে-মেয়েরা যখন ওই পথ ধরে রাজনীতি অঙ্গনে আসেন তখন বলার কিছু থাকে না। কিন্তু এখন যারা আসছেন বা আসতে চাচ্ছেন  তাদের ভেতর রক্তের উত্তরাধিকার ব্যতীত আর কোনো সারাংশ নেই। এই প্রক্রিয়ায় দেশ জুড়ে রাজনৈতিক শক্তির আধার তারুণ্যের জন্য আশার কিছু নেই । যারা একান্তই নিজের জীবন, শক্তি আর মেধার ওপর ভর দিয়ে বাঙালির জন্য একটি স্বতন্ত্র দেশের জন্ম দিয়ে গেছেন, তাদের রক্তের উত্তরাধিকাররাই যোগ্যতা অর্জন করে দলের একজন সাধারণ কর্মী হয়ে সর্বত্র বিপুল প্রতাপে বিরাজ করবে এটাই দেশবাসী দেখতে চায়। একই সঙ্গে দলের কর্মীদের যোগ্যতা অর্জন করতে দিয়ে যথাস্থানে নিয়োজিত না করলে কোন দলের ক্ষমতায়ন হবে সাময়িক যা বাঙালি জাতির জন্য ধারাবাহিক কোন মঙ্গল আনবে না।
অনেকেই শুধুমাত্র রক্তিয় সংযোগের পথ ধরে যোগ্যতা অর্জন না করে দেশ শাসনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তারা নিজেরাতো ডুবলেনই, দেশ ও দল সব ডুবিয়ে এখন মামলার আসামি এবং তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ ছাড়া। এতকিছুর পরও আমাদের দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক দূর্নীতিবাজ মানুষ এদের পৃষ্ঠপোষক। এই শ্রেণীর রাজনীতিকরা এই যুবকদের ধামা ধরে নৈতিকতা আবর্জনা স্তুপে ফেলে দিয়ে মন্ত্রিত্ব বা পদ পেতে সদা আগ্রহী। এতে গণতন্ত্রের ‘গ-ও অবশিষ্ট থাকছে না। বাংলার মানুষ চায় প্রতিযোগিতামূলক নেতৃত্ব। সে জায়গায় যে বিজয়ী হবেন তাকেই আগামী দিনের নেতা বানাতে তারা প্রস্তত তা সে যেই হোন    না কেন ।
রাস্তায় রাস্তায় মাথা কুটে মরছে গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতির আশা ভরসা। রক্তের সূত্র ধরে এসে রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠা? এসে কেউ মিথ্যাচারের রাজনীতির পথ ধরে বাংলাকে লুঠ করে বিদেশে পাচার করবেন তাতে বাঙালি জাতি আপ্লুত হয়ে তাদের মাথায় তুলে নাচবেন তা আর এখন বাংলার মাটিতে হবে না। ওই রাজনীতি  প্রগতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দেশের জন্য খারাপ খবর। সময়ের সাথে সাথে তাদেরকে সামলানো না গেলে এদেশে মানুষ মানুষের মত থাকতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই।  বাঙালি হিসেবে টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পড়বে-এজন্য দেশের মানুষ আতংকিত ও চিন্তিত। অথচ সেটাই রাজনীতিকরা  জানেন না বা ব্যক্তি স্বার্থে দলের মধ্যে জানান দেন না। সেজন্যই বাংলার মাটির কাছাকাছি কান পেতে থাকতে হয় সত্যের পথে তৃনমূল পর্যায়ের রাজনীতিকদের মধ্যে নতুন কারো পদধ্বনি শোনার আকাঙ্খায়। দলত্যাগী আর বহিষ্কৃত - বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই শব্দদ্বয়ের ব্যবহার যথেষ্ট না থাকলেও ২০০৫-০৬ এর পরিপ্রেক্ষিতে  রাজনৈতিক দলগুলোতে বেশ চালু হয়ে গিয়েছিল। আলোচনায় আসতো - ভাই, দল আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে, না আপনি দলকে ছেড়ে দিয়েছেন।
সমাজ-প্রগতি নিয়ে যারা ভাবেন, তারা নিশ্চয়ই এ নিয়ে গবেষণা করবেন। তবে বাংলাদেশ ভূখন্ডের সংগ্রামী মানুষের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে জনমানুষের ফুঁসে উঠার বহু অবিস্মরণীয় গৌরবগাথা আমরা খুঁজে পাব। ভারত উপমহাদেশে একমাত্র  বাংলাদেশের মানুষই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা শুধু করেনি, তাতে জয়ী হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
একদিকে উর্বর খনিজ ভূমি, উত্তাল নদী, গভীর সবুজ বনভূমি, প্রাণময় প্রকৃতি অন্যদিকে বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডোর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে অবতীর্ণ এ ভূখন্ডের মানুষজন দীর্ঘ সংগ্রামী শক্তি অনুশীলনের  মধ্য দিয়ে এক অবিনাশী চেতনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠার জাতিগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। তাই প্রগতিবিরোধী ধর্মান্ধ মিথ্যাচারী রাজনৈতিক শক্তি ও সমাজের কর্তৃত্বকারী রাজনীতিজীবী শ্রেণী তাদের স্বার্থরক্ষায়  রাষ্ট্রের আনুকূল্যে সত্য চাপা দেয়ার এবং অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে চালিয়ে দেয়ার যতবার চেষ্টা করেছে ততবারই সংগ্রামী মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। এটাই বাংলাদেশ এবং বিবর্তনবাদী বাঙালি চিন্তার চারিত্রীক বৈশিষ্ট।