মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০১৩

নির্বাচনঃ ধর্মের নামে রাজনীতি কোন পথে....


নির্বাচনঃ ধর্মের নামে রাজনীতি কোন পথে....

 
সংলাপ ॥ ব্যক্তি জীবনে মানুষ শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পায়  তার ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করে-নিজ নিজ ধর্মকে ব্যক্তি জীবনে ধারণ, লালন ও পালন করে। অপরদিকে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জীবনে কল্যাণ, তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার যে নীতি তা-ই হচ্ছে রাজনীতি। ধর্ম ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, রাজনীতি সমষ্টিকে ঘিরে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। ধর্ম যখনই রাজনীতির ঘাড়ে বে আইনীভাবে সওয়ার হয়েছে তখনই তা মুষ্টিমেয় নাগরিকের সংকীর্ণ স্বার্থের অনুকূলে গেছে, আর বিপক্ষে গেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্মীয় হানাহানিতে পৃথিবীতে যত মানুষের জীবন গেছে এবং ধর্মের নামে রাজ্য দখলের যুদ্ধ বিগ্রহে প্রাণ হারিয়েছে তার চেয়ে অনেক কম মানুষ প্রাণ হারিয়েছে স্বাভাবিকভাবে। এই ধর্মীয় হানাহানি যতটা না এক ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে অপর ধর্মের অনুসারীদের, তার চেয়ে বেশি হয়েছে একই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অন্তঃকলহে।  অভিজ্ঞতা এও বলে যে ধর্মের এই অ-ধর্মদশা তখনি দেখা গেছে যখন ধর্মব্যবসায়ী - মতলববাজরা ধর্মান্ধতার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মানুষকে আচ্ছন্ন করে ধর্মকে টেনে এনেছে রাজনীতিতে-ধর্মকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে নিছক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের প্রয়োজনে।

এই উপমহাদেশের-এমনকি এই দেশের গত ৬০ বছরের ইতিহাস দেখলেই তা টের পাওয়া যায় হাড়ে হাড়ে। ধর্মের নামে, স্বঘোষিত ইসলামের নামে ১৯৪৭ সালে ‘ঐতিহাসিক প্রতারণার মধ্য দিয়ে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরা সৃষ্টি করেছিল রাষ্ট্র ফাঁকিস্তান (কাগজে-পত্রে দলিলে যা পরিচিত ছিল পাকিস্তান বলে)। ধর্মের দোহাই দিয়েই বাংলার মানুষকে চরম শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছিল এই ফাঁকিস্তান রাষ্ট্রের মদ্যপ-মাতাল দুশ্চরিত্র পাকি জেনারেল  আর শঠ রাজনীতিকরা। যার পরিণতিতে ঘটেছিল ১৯৭১ সালে মহান  মুক্তিযুদ্ধ  যে যুদ্ধে  মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠন করা হয়েছিল ইসলামের নামে, ঘৃণিত তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র   ফাঁকিস্তান রক্ষার নামে।

যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে ঠকে, ঠেকে আর উচ্চমূল্যে কেনা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নীতি নির্ধারকরা তাই দেশের সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন  নীতিটি তা প্রতিফলিত হয়েছিল যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে। এতে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়, ‘জনশৃঙ্খলা ও?নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। তবে শর্ত থাকে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা পক্ষানুযায়ী কোন সামপ্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী  ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করায় বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোন প্রকারে তার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকবে না।

কিন্তু জাতির চরম দুর্ভাগ্য ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে ১৯৭৮ সালে সেনানায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের এ-বিধানটি সংশোধন করে ধর্মের ভিত্তিতে সংগঠন করার অধিকার দেন। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, জিয়ার কেটে দেয়া এই খাল দিয়ে তিন হাজার বছরের অসামপ্রদায়িক এই বাংলার জনপদে ঢুকে পড়ে ধর্মান্ধতার সন্ত্রাসীরা, একে একে - যা অব্যাহত আছে আজও। এরই অনিবার্য পরিণতিতে সামপ্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে আচ্ছন্ন হতে থাকে গোটা দেশ, ধর্মান্ধতার বিষাক্ত নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হয় বাংলার সবুজ জমিন, ধর্মব্যবসায়ীদের চক্রান্ত ষড়যন্ত্র কবলিত হয়ে পড়ে দেশের রাজনীতি, আর তারই উপসর্গ হিসাবে ঘুষ, দুর্নীতি, কালো টাকার স্রোতে ভাসতে থাকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি।

সুযোগ এসেছে আইন, নীতি-?নৈতিকতা আর মূল্যবোধ ভিত্তিক দেশ-সমাজ গড়ে তোলার। রাজনীতির জটিল অংকে পড়ে সব সম্ভাবনা যদিও আজ ‘হওয়া-না-হওয়ার দোলাচালে দুলছে, তথাপি হাতে এসে যাওয়া পরিস্থিতি ও কতক অর্জনকে কিন্তু সত্যের পথ ধরে সহজেই দেয়া যায় স্থায়ী রূপ। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কিছু অর্জন আজ জাতির সামনে এসে গেছে। প্রয়োজন তাকে অনতিবিলম্বে মুঠোবন্দী করে কাজে লাগানো সহজ ও সরল পথে।

সামপ্রদায়িকতার রাজনীতি বন্ধে কমিশন ইতোমধ্যে যে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ নিয়ে এসেছে তার ৯০-সি (১/এ), ৯০ সি(১/বি), ও ৯০-সি (১/সি) ধারাসমূহ মুক্তিযুদ্ধের লুন্ঠিত চেতনা পুনরুদ্ধারে হয়ে উঠতে পারে মোক্ষম হাতিয়ার। এই গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৯০-সি (১/এ) ধারায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তে বলা হয়েছে যে, দলীয় গঠনতন্ত্রের উদ্দেশ্যসমূহ সংবিধানের পরিপন্থী হতে পারবে না। ৯০-সি (১/বি) ধারায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও লিঙ্গভেদে কোন বৈষম্য থাকতে পারবে না। ৯০-সি (১/সি) ধারায় বলা হয়েছে দলীয় নাম, পতাকা, চিহ্ন বা অন্য কোন কর্মকান্ড দ্বারা এমন কিছু করা যাবে না, যার মাধ্যমে ধর্মীয় বা সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি নষ্ট হওয়ার কিংবা দেশকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যাবার আশংকা থাকে।

উল্লেখ্য, ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলো এই অধ্যাদেশ-এর বিরুদ্ধে স্বাভাবিক কারণেই এখনো মারমুখি।

নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-এর যে উদ্যোগ নিয়েছে  দেশবাসীর সামনে আজ তা এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও অপরাপর শক্তিসমূহকে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে সবরকম ঝুঁকি নিয়েই। বিষয়টি কেবল প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তির কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না, দেশের সিংহভাগ ধর্মভীরু ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মকে বার বার রাজনীতির প্রয়োজনে, ক্ষমতার স্বার্থে যে ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, টেনে আনা হয়েছে রাজনীতিতে, তা ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, তাতে ধর্মই  কেবল বিতর্কিত হয়েছে। কলুষিত হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা; পবিত্র ধর্ম পরিচিত হয়ে পড়েছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের হাতিয়ার রূপে।  আজ তাই সময় এসেছে ধর্মকে ধর্মের স্থানে, ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ধারণ-লালন ও পালনের বিষয় রূপে স্থান দিয়ে রাজনীতিকে ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত করার। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার পথ বন্ধ করার আজ তাই একটা মোক্ষম সময় এসেছে জাতির সামনে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একবিংশ শতাব্দীর পথে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন