বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

স্বদেশের হেফাজত না করতে পারলে - ধর্মের হেফাজত করা যায় না


স্বদেশের হেফাজত না করতে পারলে

ধর্মের হেফাজত করা যায় না

 
সংলাপ ॥ প্রকৃতিগতভাবে মানুষকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রত্যেক মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানিত করেছেন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। তাই স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি তথা দেশ-জাতির প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ জন্মগতভাবেই তার পরিবার-পরিজন ও দেশকে ভালোবাসে। জীবন চলার পথে প্রত্যেকের কাছেই তার মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি মহামূল্যবান হয়ে ওঠে। তাই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বিদেশে বসবাস করলেও মানুষ জন্মভূমির কথা ভুলতে পারে না। মাতৃভূমির মায়া তাকে টানতে থাকে দেশের মাটিতে। জন্মভূমির প্রভাব প্রতিটি মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে বিদ্যমান থাকে। মাতৃভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ, ভালোবাসা, ভালো লাগা, গভীর অনুভূতি ও মমত্ববোধই হলো দেশপ্রেম। দেশপ্রেম একধরনের পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ-যা মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্ব সচেতন করে তোলে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করে এবং জনগণের সেবায় উৎসাহী করে তোলে। দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখে। তাই দেশকে ভালবাসা, দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় স্বচেষ্ট হওয়া একজন ঈমানদারের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ইসলামে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। রাসূল (সা.) তাঁর জন্মভূমি মক্কাকে ভালোবাসতেন। মক্কাবাসীদের ভালোবাসতেন। স্বজাতীয়দের নির্মম অত্যাচারে এক সময় তিনি হিজরত করেছিলেন কিন্তু মক্কার সীমান্তে দাঁড়িয়ে জন্মভূমির দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন- ‘হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন জাতি যদি ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে-তাবেয়িন, আওলিয়ায়ে কেরাম এবং বজুর্গানে দ্বীন স্বজাতি, স্ব-ভূমিকে ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তারা জন্মভূমি মক্কার  দৃশ্যাবলী স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌম রক্ষায় রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আহ্‌বান করেছেন সাহাবায়ে কেরাম সর্বোতভাবে এ ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তারা জানতেন, নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ড প্রয়োজন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায়। রসুল (সা.) এর বাণী রয়েছে - ‘আল্লাহর পথে এক দিনের সীমান্ত প্রহরা দুনিয়া ও এর মাঝে যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘এক দিন ও এক রাতের সীমান্ত পাহারা ক্রমাগত এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারা রাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম। তাফসিরে মাজহারিতে বলা হয়েছে - ‘যে ব্যক্তি এক দিন ও এক রাত সীমান্ত প্রহরায় থাকবে, সে বাড়িতে বসে এক মাস সিয়াম সাধনার সমান সওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি সীমান্ত প্রহরায় থাকা কালে ইন্তেকাল করবে (কিয়ামত পর্যন্ত) তার জন্য সওয়াব জারি করে দেওয়া হবে। শহীদদের মতো সে রিজিক পেতে থাকবে। সে কবরের সব ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে।

স্বজাতি, স্বভাষা, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের ব্যাপারে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের চরম অবজ্ঞা ও উপেক্ষার কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। সে জন্য ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল জালিমদের বিরুদ্ধে মজলুমের জিহাদ। সে জিহাদে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা তাদের জানমাল-ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষার দায়িত্ব সবার ওপর বর্তায়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, ৪২ বছর পরও আমরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাইনি। স্বদেশে স্বজাতীয়রা একতাবদ্ধ হয়ে, রাজনৈতিক হানাহানি ও বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করার যে প্রত্যাশা ছিল তা এখনো পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক হানাহানি, অরাজকতা, হত্যা-ধর্ষণ ও দুর্বৃত্তায়নে বাঙালি জাতি আজ ভারাক্রান্ত।

দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা বিষয়ে ইসলাম ও বিশ্বনবীর প্রতি চরম উপেক্ষা লক্ষ্যণীয়। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের স্থলে এখন জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা মাটি দখল করতে চাইছে দেশের শত্রু ও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি।

দেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের মানুষের প্রতি যার মায়া-মমতা নেই, যে দেশের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে না, দেশের জন্য কোনো কিছু ত্যাগ করতে পারে না সে এখনও মানুষ হিসেব বেড়ে ওঠেনি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মান-সম্মান, স্বাধিকার ও ঈমান-আমল রক্ষা করা যায় না। স্বদেশকে হেফাজত না করতে পারলে ধর্মকে হেফাজত করা যায় না, দেশের মানুষকে রক্ষা করা যায় না, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা যায় না। তাই ঈমানের মতো দেশপ্রেমও মুমিনের অস্তিত্বের অংশ। আরবি প্রবাদে বলা হয়, ‘হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ঈমান অর্থাৎ ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। যে দেশকে ভালবাসে না, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকে না সে প্রকৃত ঈমানদার নয়।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশকে ভালোবাসা, দেশের জনগণের যার যার ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, আমাদেরকে প্রকৃত ইমানদার মানুষে পরিণত করতে পারে এবং সমাজ-জীবনে বয়ে আনতে পারে শান্তি। বিত্তশালী বিত্তহীন সকলেই দেশের জন্য কল্যাণকর কিছু করতে পারেন। দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধে গণজাগরণ ব্যতীত কোনো দেশের স্বাধীনতা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। তাই দেশের স্বার্থবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অন্যথায় ঈমান আমল সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, হচ্ছেও তাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন