বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন বাঙালি জাতির প্রেরণা


বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন

বাঙালি জাতির প্রেরণা

 
[১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে যোগ্য ও সফল নেতৃত্ব যিনি দিতে পেরেছিলেন তাঁর নাম বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। দুর্ভাগ্য জাতির, স্বাধীন দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগ এই মহানায়কের সাথে যথার্থ সম্পর্ক রাখতে ব্যর্থ হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকেই অপসারিত হতে হয়। আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের ষড়যন্ত্রের জন্য তৎকালীন সরকার সত্য জানতে চায়নি। ক্ষমতার মোহ, স্বজনপ্রীতি এবং সামপ্রদায়িকতা নেতৃত্বকে কুরে কুরে খাওয়া আরম্ভ করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ পথ হারিয়ে চলতে থাকে মূলত তখন থেকেই। স্বাধীনতার পর আজ পরিবর্তীত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাই আবারও ভেবে দেখার সময় এসেছে দেশ গঠনে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনের চিন্তাচেতনাকে ধারণ করার। মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটাতে তাজউদ্দীনের অবদানকে স্মরণ করার পাশাপাশি যে আরো একটি নাম বাঙালির ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে তাঁর নাম এম এ জি ওসমানী - মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। পাঠ্যপুস্তকে, ইতিহাসের বইয়ে শুধু কোনো ব্যক্তি বিশেষকে যোগ্য স্থান দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও জয়ের জন্য তাজউদ্দীন এবং ওসমানীকেও যথাযথ মর্যাদায় আগামী ও বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাজউদ্দীন ও ওসমানী ’৭১-এ সে দিন ছিলেন পথিকৃৎ। তাদের অনন্য ভূমিকা ও নেতৃত্ব ব্যতিরেকে দেশকে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত করতে কোনোভাবেই সম্ভব হতো না, এমনকি ভারতের সমর্থন নিয়েও নয়। বাঙালি জাতি যতদিন বিশ্বের বুকে টিকে থাকবে তার স্বাধীনতার ইতিহাসে তাজউদ্দীন-ওসমানী চিরস্মরণীয় থাকবেন।]

সংলাপ ॥ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক ও সাধক পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে বি.এ.অনার্স এবং ১৯৬৪ সালে জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ল পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকেই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি চল্লিশের দশকে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন।

তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৪ আগষ্ট ১৯৪৭) পর মুসলিম লীগ সরকারের গণবিরোধী নীতির প্রতিবাদে মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ - ১৯৪৮ ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ - ১৯৫২ উভয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে গ্রেফতার হন ও কারা নির্যাতন ভোগ করেন। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ (এপ্রিল ১৯৫১)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৫১-১৯৫৩ পর্যন্ত এ সংগঠনের কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে কাপাসিয়া অঞ্চল থেকে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং এবং একই বছর জুন মাসে ৯২-ক ধারায় গ্রেফতার হন। তিনি ১৯৫৫-র ২৭ অক্টোবর কাউন্সিলর সভায় আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবা সম্পাদক নির্বচিত হন। ১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৯ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পরিচালিত এনডিএফ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)-এর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। একই বছর ৮ মার্চ কাউন্সিল সভায় দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি এপ্রিল (১৯৬৪) মাসে গ্রেফতার হন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২ জানুয়ারি ১৯৬৫) সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি  লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। এ সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন। ১৯৬৬-র ১৯ মার্চ কাউন্সিল সভায় তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং প্রায় ছয় বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তিনি ৬-দফার প্রচারাভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৮ মে (১৯৬৬) দেশরক্ষা আইনে পুনরায় গ্রেফতার হন। গণ-আন্দোলনের চাপে ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সরকার কর্তৃক তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। অতঃপর গণ আন্দোলনে (জানুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। বিরোধী দল ও সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠকে (২৫ ফেব্রুয়ারি, ১০, ১১ ও ১২ মার্চ ১৯৬৯) তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৫ আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের তিনি অন্যতম পরিচালক ছিলেন। ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর সশস্ত্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করলে তিনি ঢাকা ত্যাগ করে ভারত গমন করেন। ১২ এপ্রিল (১৯৭১) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৭ এপ্রিল (১৯৭১) মুজিবনগরে এ সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য তাঁর সরকার কর্তৃক সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেয়া হয়। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে ছাত্র-জনতা, ইপিআর, পুলিশ ও বাঙালি সৈনিকেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। এদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ব্যাপারে তিনি কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভারত, রাশিয়া, পূর্ব জার্মান ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ তাঁর সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেন। বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের কৌশল চালিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে তোলে। ৩ ডিসেম্বর (১৯৭১) পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ড কর্তৃক তিনি বাংলাদেশে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উক্ত যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। ২৩ ডিসেম্বর (১৯৭১) তাজউদ্দীনের সরকারের মুজিবনগর থেকে বিমান যোগে ঢাকায় আগমন এবং তেজগাঁ বিমান বন্দরে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে তাজউদ্দীন আহমদের অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ হয়। তিনি ১৯৭২-এর ১১ এপ্রিল শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য নিযুক্ত ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (১৯৭২) রচনায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ ঢাকা-২২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪-এর ২৬ অক্টোবর মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্ট সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের হাতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক আইন জারি করলে ২৩ আগষ্ট তিনি গ্রেফতার হন। তিনি অসামপ্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগকে বাঙালির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক-প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘকাল সংগ্রাম পরিচালনা করেন। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন উজ্জীবনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে খ্যাত। তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রচলিত নিয়ম অগ্রাহ্য করে প্রবেশকারী সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় ব্যক্তির হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

কার্যত সকল অর্থেই যারা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগের  মধ্যে  যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও লালন করে না তারা তাঁর জন্মদিন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে না এটাই স্বাভাবিক। মানুষ কি কালক্রমে বিবেক বর্জিত হয়ে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন  কালক্রমে মুছে যাবে ইতিহাস থেকে?  তাজউদ্দীন শুধু নয় তার পরিবারসহ গোটা পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে রাজনীতিকরা যে কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যে নির্যাতন সহ্য করেছেন তা এ জাতি কোনদিন ভুলে যাবে না। অথচ স্বাধীনতার পর এক বছর যেতে না যেতেই তাজউদ্দীনই প্রথম মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত হন। আবার তাজউদ্দীনের ভাই-ও ছেলে হাসিনা মন্ত্রিসভা থেকেও অপসারিত হন। হায়রে নিষ্ঠুর নিয়তি। যে মানুষ বলতে গেলে আওয়ামী লীগের একমাত্র নেতা, যিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে পরিবারের সাথে এক রাত্রিও যাপন করেননি, সে স্বাধীনতার এক বছর পরই তিনি মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত হলেন। রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য শেখ মুজিব চিনতে পারলেন না কে তার বন্ধু কে তার শত্রু? আজও ঠিক তাই। শেখ হাসিনা সত্যিকারভাবে শত্রু-মিত্র চিনতে পেরেছেন বলে মনে হয়ে না। তা যদি পেরে থাকেন তবে বলবো তিনি যখন শৈশবে এবং তার বাবা যখন জেলে তখন এমনকি তাজউদ্দীনও যখন জেলে তখন আওয়ামী লীগ অফিসে যার চেষ্টায় মোমের প্রদীপ জ্বলতো সেই জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী রাজনীতিতে উপেক্ষিত কেন।

শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরা যাবে না। কেননা তাতে শেখ মুজিবই ছিন্নমূল হয়ে যাবেন যতই কথায় কথায় বঙ্গবন্ধু বলা হোক। নিশ্চয়ই শেখ মুজিবের অতীত-বর্তমান ছিল। তাই শুধু শেখ মুজিবের নাম নিলে কাজ হবে না। আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে শেখ মুজিব নিশ্চয়ই মাষ্টার দা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম থেকে প্রেরণা পেয়েছেন। তাদের কথাও দুএকবার বলা দরকার। মাওলানা ভাসানী আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ছিলেন তাঁর কথাও বলা দরকার। তাজউদ্দীন, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল কামরুজ্জামানের কথাও বলা দরকার। আওয়ামী লীগকে বলতে বাধ্য করা হয়নি বলেই কালক্রমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম পরিণত হয়েছে রাজনীতির দাবাখেলার গুটি।

ইতিহাস নিশ্চয়ই একদিন কথা বলবে। ইতিহাস নিশ্চয়ই বলবে আওয়ামী লীগ রাজনীতি গড়ে তোলার প্রশ্নে তাজউদ্দীনের নিরলস নিভৃত, সুদক্ষ নেতৃত্বের কথা, স্বাধীনতা যুদ্ধে তাজউদ্দীনের মুজিবনগর সরকার গঠন করতে ক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারার কথা; তাজউদ্দীনের উপর আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রকারী নেতা মোস্তাক গংদের সীমাহীন অসহযোগিতাকে মোকাবেলার কথা। নিশ্চয়ই আগামী প্রজন্ম উপলব্ধি করবে তাজউদ্দীন বাংলার জন্য কতটুকু করেছেন। তারা আজকাল যেসব নেতা মন্ত্রী আছেন তাদের সাথে তাজউদ্দীনের পার্থক্য তৈরি করতে পারবেন। বর্তমান মন্ত্রী নেতা হন দেশের আর কাজ করেন ব্যক্তিস্বার্থ ও এলাকার জন্য। কার্যত তারা আঞ্চলিক নেতাই থেকে যান। তাজউদ্দীন জাতির নেতা ছিলেন বলেই আঞ্চলিক সমস্যাকে তিনি কখনো প্রাধান্য দেননি। দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি কাপাসিয়ার কোন কাজই করেননি আলাদাভাবে। অথচ সে নেতার সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তাজউদ্দীন আজ আর কোন স্বার্থ হাসিলের কেন্দ্রবিন্দু নন। বঙ্গবন্ধুর নাম বললে রাজনৈতিক কেরিয়ার হয়, মন্ত্রীত্ব নিশ্চিত হয়। তাজউদ্দীনের নাম বললে এসব কিছুই হয় না সুতরাং তার নাম দিয়ে কি লাভ। ওটা মুক্তিযোদ্ধা আর গবেষকদের চিন্তা-চেতনায় শুধু থাক। দেশ স্বাধীন হবার পর ওই মানুষটিই চেয়েছিলেন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে। কখনো তিনি বিদেশী সাহায্য নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাননি। সে জন্যই তিনি জাতির আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। দেশ শাসনের সময়গুলোতে তার সততা প্রশ্নাতীত। মুজিবনগর সরকারে প্রধানমন্ত্রী হবার পরও নিজ হাতে নিজের কাপড় কেঁচেছেন তাজউদ্দীন। আর পরবর্তীতে যারা সেদিনের আওয়ামী লীগকে ভাঙ্গিয়ে নেতা-মন্ত্রী হয়েছেন তাদের বা হচ্ছেন তাদের পেট্রোল-পাজেরো ছাড়া রাজনীতি চলে না। ত্যাগের মানসিকতা নেতৃত্ব থেকে এদেশে বলতে গেলে উঠে গেছে। দলের যারা ত্যাগী কর্মী তারা সুবিধাবাদীদের ভীড়ে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। দল আস্তে আস্তে নীতিহীন ক্লাবে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। যে মন্ত্রী হয় সে তার ব্যক্তি স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেয়। জাতীয় সংকীর্ণতা নেতাদের পেয়ে বসেছে। এ অবস্থার অবসান নিশ্চয়ই একদিন হবে। নিশ্চয়ই একদিন বাংলার মাটিতে তাজউদ্দীনরা প্রতিষ্ঠা পাবে। এ বিশ্বাস পোষণ করেই স্মরণ করুক দেশবাসী তাঁর জন্মবার্ষিকী। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলার মাটিতে তাজদের রক্ত বৃথা যায়নি এবং যাবেও না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন