মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৩

একটি ইমাম - একটি আন্দোলন - এখনো আনতে পারে সংস্কৃতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন

একটি ইমাম - একটি আন্দোলন
এখনো আনতে পারে সংস্কৃতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন

সংলাপ ॥ গণ আদালতের রায় ঘোষণা হয়েছিল কিন্তু ওই রায় বাস্তবায়ন হয়নি। সব সরকারকে বাধ্য করাতে আন্দোলন চলেও ঝিমিয়ে পড়েছে। সূতা ছিঁড়ে আন্দোলনের টান জট পাকিয়ে ক্রমেই যখন শেষ হওয়ার পথে তখন গর্জে ওঠে নতুন প্রজন্ম গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগ হতে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দীর্ঘদিন কর্কট রোগে ভুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই থেকে আন্দোলনের শরীরেও ক্যান্সারের চিহ্ন ধরা পড়ে।
তখনকার সরকার ও তার অ্যাটর্নি জেনারেলের অনীহায় ঢিলেঢালা আইনী লড়াইয়ে ঘাতকদের নেতা নরঘাতক গোলাম আযম নাগরিকত্ব মামলায় জিতে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে প্রথমেই জনসভা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। চট্টগ্রামে গোলাম আযমের জনসভার পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হয়। জনসমাবেশের তারিখ ছিল ২৬ জুলাই ১৯৯৪। বিশ্বাসী মানুষের পূণ্য শহর, আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল চট্টগ্রামের মাটিতে স্বাধীনতার প্রধান শত্রুর প্রথম প্রকাশ্য জনসভার খায়েশ।
ঘাদানির নেতাদের গলায় ছিল হতাশার সুর,- ‘বিএনপি সরকার তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে ফেললো, এখনতো অনেক কিছুই হবে।গোলাম আযমের পরিকল্পিত জনসমাবেশ প্রতিরোধ করার আন্দোলনে নেতৃত্ব এবং সাংগঠনিক তৎপরতায় অনেকেই জ্বলে উঠেছিলো। কিন্তু কি হলো! শুধু খবর হয়েছে- দলীয় কোন্দল, নেতৃত্বের সঙ্কট, ব্যক্তিত্বের লড়াই, চট্টগ্রামে কমিটি গঠন, শিবিরের নিষ্ঠুরতা! ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে স্বাধীনতা বিরোধী উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটে, ’৭১ এর ঘাতক দালাল রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দিকে যায়, তখন জাতির সামনে অনিবার্য হয়ে পড়ে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের। ওই পর্বের মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম-এঁর নেতৃত্বে। জাহানারা ইমামের মতো জীবন বাজী রেখে ও  মৃত্যুর হুমকি উপেক্ষা করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওই পর্বের মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জেলায় রক্ষণশীল সমাজে ঘাতক ধর্মান্ধদের শক্ত অবস্থানের মধ্যে ওই আন্দোলন কতটা দুরূহ ছিলো জাহানারা ইমাম তিলে তিলে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
তিনি জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে একাত্তরের মতোই একাত্তরের দেশীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে স্বামী হারানো, আত্মীয়-স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষতে জাহানারা ইমামের আহ্বান প্রজ্জ্বলিত দহনে ঘিয়ের মতো কাজ করে। দলীয় রাজনীতিমুক্ত দেশবাসী একান্তভাবে আজও চায় ঘাতক দালালদের বিচার, ঘাতকদের ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ। ওই যুদ্ধে জাহানারা ইমামের কিছু চাওয়ার ছিলো না। তিনি রাজনীতি বুঝেন না বলেই প্রথমে বুঝতে পারেননি গোলাম আযমের জনসমাবেশ প্রতিরোধের আন্দোলনে শত অনুরোধ সত্ত্বেও  কোনও রাজনৈতিক নেতা ঢাকা থেকে কেন চট্টগ্রামে আসতে রাজি হননি। চট্টগ্রামের স্থানীয়  রাজনীতিকরা কেন ছিল গরহাজির! সফলভাবে গোলাম আযম প্রতিরোধ করার বেশ পরে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় বিভিন্ন দলের নেতারা নিশ্চিন্ত করে দিয়েছিলো গোলাম আযমের চট্টগ্রামের সভা তারা প্রতিরোধ করবে না- গোলাম আযমকে লালদীঘি মাঠে মিটিং করতে দেয়া হবে। কিন্তু   ছাত্রলীগের সাধারণ নেতা কর্মী, বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের হাজারো কর্মী স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে এই ঘাতক প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। এমনকি স্থানীয় রাজনীতিতে শিবিরের সঙ্গে শক্তির পরীক্ষায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও ঘাতক প্রতিরোধে শরীক হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়াই প্রথম জনসভার সর্বাত্মক প্রতিরোধ করার ইতিহাস চট্টগ্রামের ইতিহাসে আরও একটি বিজয়ের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। তখন নেতাকর্মীরাই ভালো বুঝতে পারে, গোলাম আযমের বিচার কতটুকু চায় রাজনৈতিক দলগুলো। ওই  আন্দোলনের পিঠে ছুরি মেরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কয়েকটি দল শুধু সেই সময় সরকার বিরোধী আন্দোলনে যায়। তখন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে বুঝতে পেরেছিলেন আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে না পারলে জামাত আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। কারণ রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা জামাতের নড়বড়ে আসনটিকে বৈধতার পেরেক ঠুঁকে শক্ত মজবুত পাকাপোক্ত করে দিয়েছিল।
সেখানে জয়বাংলা শ্লোগান ওঠেনি। কেন জয়বাংলা শ্লোগান নয় কেন! স্বাধীনতা যুদ্ধের মন্ত্রবাণী, শত্রুর শিবিরে ত্রাস সৃষ্টিকারী এই অমর শ্লোগান নয় কেন!  স্বাধীনতার পর এটা কোন দলীয় শ্লোগান হতে পারে না। বামদলসহ সবাই এই শ্লোগান ভুলে গেলো সংকীর্ণতার জন্য।  স্বাধীনতার পরপর এই শ্লোগানতো গোটা জাতির শ্লোগানই ছিলো। একইভাবে বাঙালির ইতিহাসের অদ্বিতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকেও দলীয়করণ করা হয়। একাত্তরের দালাল ঘাতকদের বিচার ও শাস্তি দলমত নির্বিশেষে সকলের একান্ত দাবি কোনও দলের নয়। ঘাতক দালাল বিচারের দাবির সঙ্গে অন্য কোন দাবী এক হতে পারে না। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সতর্কতার কারণে এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে  নির্মূল সমন্বয় কমিটির ব্যানারে ৭২টি সংগঠন একত্রিত হয়েছিলো তখন।
গণ আদালত বসেছিল মার্চ ২৬, ১৯৯২ তারিখে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢলে উদ্যান বিলীন, গণ আদালত অনুষ্ঠানের আইনী দিক নিয়ে বিচারকদের সঙ্গে জাহানারা ইমাম সহ প্রধান নেতারা ছিলেন ব্যস্ত। গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে বিশাল বিশাল রঙিন ব্যানারসহ দেশের সকল প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ওই সমাবেশ ঘটে। মাইক ছাড়াই ট্রাকের মঞ্চের উপর শহীদ জননী গণ আদালতের রায় ঘোষণা করেন।  ওই উদ্দীপনাময় প্রতি মুহূর্তের ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক।
ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের  সঙ্গে স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় শক্তির সংকীর্ণতা ও বিভ্রান্তির কথাও স্পষ্ট করে ধরা পড়ে সেদিন। একদিকে ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের মুখোশ, অন্যদিকে ওই আন্দোলনের কিছু সংগঠন, নেতৃবৃন্দের স্বার্থকেন্দ্রিক আচরণ ও ভূমিকা। ওই পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। ঘাতক রাজাকার জামাতিদের কাছে দিনে দিনে রাজনীতিকদের সেবাদাস ও বিক্রি হওয়ার মাধ্যমে ধর্মান্ধতার কাছে ধর্মভীরু দেশবাসীর পরাজয় হলো।? স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিকরা ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে সংকীর্ণতার পথে চলে। আন্দোলনের নিঃস্বার্থ সৈনিক জাহানারা ইমামকে তারা পছন্দ করেনি। ঠিক আজকের গণজাগরণ মঞ্চকে যেমন বর্তমান সরকার ও কিছু সংখ্যক রাজনীতিক সংকীর্ণতার দৃষ্টিকোন থেকে দেখছে, সরাসরি সমর্থন করছে না। অন্যদিকে চিরকুটরাজনীতির জন্ম হলো। জাহানারা ইমাম বুঝেছিলেন ওই রাজনীতি। একদিকে ধর্মান্ধ, অন্যদিকে দলীয় স্বার্থে অন্ধ দলীয় রাজনীতিকরা বুঝাতে চেয়েছেন এটা তাদের স্ব স্ব দলীয় আন্দোলন।
ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের এক সংগঠক এবং তৎকালীন রাজনীতিকদের ভূমিকা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকে স্তিমিত করায়, জামাতিদের ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করে। স্বার্থান্ধ ওই রাজনীতিকদের  মুখোশ উন্মোচন হয় জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিকতা ও সাংগঠনিক তৎপরতা প্রশ্নে। অল্প সময়ের মধ্যেই - ওই স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের অপতৎপরতা পরিস্কার হয়ে ওঠে। ১১ জন নেতাকে নির্মূল কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। কারণ ওরা ১১ জন ওই নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে বাধা হয়ে?উঠেছিলো।
অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্খী, ধূর্ত, আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর রাজনৈতিকদের কারণেই  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলন আর জনসম্মুখে এলেও বার বার সুরাহা হচ্ছিল না। চলেছে তালবাহানার পালা। মুক্তিযোদ্ধা চিন্তাবিদদের অভিমত হলো, ‘এটা ছিল একটা গভীর ষড়যন্ত্র। কমিটি থেকে ওই ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ আরও অনেককে সরিয়ে নির্মূল কমিটিকে  উগ্র ধর্মান্ধ বিরোধী একটা প্রকল্প হিসেবে দাঁড় করানো হলো। বিদেশী অর্থ লাভের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এবং স্বার্থপর রাজনীতকদের ক্ষমতার স্বার্থের যূপকাষ্ঠে ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলন স্তিমিত হতে লাগলো।
ক্ষমতান্ধতায় জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি হাতে ধরে জামাত-রাজাকারকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়েছিলো। মুক্তচিন্তার প্রকাশ ও সংস্কৃতি চর্চা তখন যেমন ভয়াবহ হুমকির মুখে ছিলো আজো তেমনই আছে এবং থাকবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে; আদালত, শিক্ষাঙ্গন, শিল্প-কারখানায় বিপন্নতা বিরাজ করেছে ও করছে। এই চরম মুহূর্তে জাতি যে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের ওপর ভরসা করে বুকে সাহস সঞ্চয় করতে পারে তাদের ভিতরের অন্ধকারের এবং অদূরদর্শিতার খবর হতাশ করে দিচ্ছে, আবার সতর্কও করেও দিচ্ছে জাতিকে। স্বাধীনতা স্বপক্ষশক্তির ভিতরের ক্ষমতালোভ আর সংকীর্ণতাই জামাত-বিএনপি চক্রের বারবার ষড়যন্ত্র করার পথ করে দিয়েছে। ক্ষমতালোভ সংক্রামক গোপন ভাইরাস নিয়ে আন্দোলন বেশি দূর যেতে পারে না। হচ্ছেও তাই। তাই বারবার স্মরণ করতে হয় জাহানারা ইমামকে। সত্যিই তিনি ইমামতি করে গিয়েছেন। সত্যের কান্ডারি হয়ে ইমামতির পদাঙ্ক অনুসরণ করা না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে কিনা তা সময় বলে দেবে।
ধর্মান্ধরা ইতোমধ্যে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এখনো সত্যের পথ ধরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে গণজাগরণ?মঞ্চতেই নতুন প্রজন্মই একমাত্র পারে সুনামীহয়ে বাংলাদেশকে ৭১ এর জয় বাংলাধ্বনিতে তে বলীয়ান করতে জাতিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন