বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

বীরোত্তম তাহের - সংস্কার আন্দোলনের এক অনুপ্রেরণা

বীরোত্তম তাহের
সংস্কার আন্দোলনের এক অনুপ্রেরণা
 
[১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর কর্ণেল আবু তাহের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নেত্রকোণা জেলার কাজলা গ্রামে। পিতা মহীউদ্দীন আহমেদ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর মাতার নাম আশরাফুন্নেসা, স্ত্রী লুৎফা তাহের। তিনি ছিলেন একাধারে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক। ১৯৫৯ সালে সিলেট এম.সি. কলেজ থেকে তিনি বি.এ. পাস করেন এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. প্রথম পর্বে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬১ সালে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে (কমান্ডো বাহিনী) যোগদান করেন। একই বছরে সেপ্টেম্বর মাসে পাক-ভারত যুদ্ধে প্রথম কাশ্মীর ও পরে শিয়ালকোট রণাঙ্গনে অংশগ্রহণ করেন এবং আহত হয়ে বীরত্বের জন্য খেতাব লাভ করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সেনানিবাসে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নে কর্মরত থাকাকালে কর্ণেল তাহের বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গোপনে বাঙালি সৈনিকদের রাজনৈতিক সামরিক প্রশিক্ষণ দান করেন। ১৯৬৯ সালে আমেরিকার ফোর্ট ব্রাগ ও ফোর্ট বেনিং থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও উচ্চতর সমরবিদ্যায় অনার্স গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। ১৯৭০ সালে কোয়েটার স্টাফ কলেজে যোগদান করে সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা চালাবার প্রতিবাদে স্টাফ কলেজ পরিত্যাগ করে গ্রেফতার বরণ করেন। ১৯৭১র ২৫ জুলাই অ্যাবোটাবাদ থেকে পলায়ন এবং সীমান্ত অতিক্রম করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর কামালপুর শত্রু ঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালনাকালে আহত হলে হাঁটুর উপর থেকে তাঁর বাম পা বিচ্ছিন্ন করতে হয়। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বিদেশ থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে যোগদান করেন। ১৯৭২-এর জুন মাসে ৪৪তম ব্রিগেডের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। কুমিল্লা সেনানিবাসের অধিনায়ক থাকাকালে তিনি প্রচলিত ‘ব্যারাক আর্মির স্থলে উৎপাদনশীল ‘পিপলস্‌ আর্মি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭২র সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপারে নীতি-নির্ধারণের প্রশ্নে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়ায় সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ এবং গণবাহিনী (গোপন) গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ড্রেজার সংস্থার পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘সিপাহী গণঅভ্যুত্থানকে সংগঠিত করেন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে সে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দান করেন। একই বছরের ২৪ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের  অভ্যন্তরে এক সামরিক আদালতে তাঁর গোপন বিচার শুরু হয়। একই বছর ১৭ জুলাই সামরিক আদালত কর্তৃক তাঁর ফাঁসির রায় প্রদান করা হয়। জাতির মাথায় চাপলো আর একটি কলঙ্কের বোঝা। আজও জাতি কলঙ্ক মুক্ত হয়নি তবে স্বস্তি পেয়েছে।]
২১ জুলাই ১৯৭৬। ভোরের আলো বাংলাদেশের দিগন্তকে উদ্ভাসিত করার পূর্বেই এক ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রহসনমূলক ফাঁসির রায় কার্যকরী করে বাংলাদেশের ক্ষুদিরাম লেঃ কঃ আবু তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। যে বিশেষ ট্রাইবুনাল কারা অভ্যন্তরে গঠন করা হয়েছিল তাতে বিবাদির উকিল নিযুক্ত করার কোনো উপায় ছিল না। সরকার নিজেই বাদির উকিল এবং সাক্ষী গোপাল বিবাদির উকিল নিযুক্ত করেছিল। আবু তাহের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধাই কেবল নন ১১নং সেক্টরের একজন সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সম্মুখ সমরে একটি পা হারিয়েছিলেন। কোনো পঙ্গু মানুষকে ফাঁসি দেয়া আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। সেসব আইন কানুনের তোয়াক্কা সেদিন জিয়াউর রহমান করেননি। অথচ এই জিয়াউর রহমান সাহেবকেই কর্ণেল তাহের খালেদ মোশাররফের অন্তরীণ অবস্থা থেকে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ মুক্ত করে তার জীবন রক্ষা করেছিলেন সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান করার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু চরাই-উৎরাইয়ের মধ্যেও তাহেরের সাহসী আত্মদান ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলজ্বল করবে। মানুষটি ফাঁসিতে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে জাতির উদ্দেশ্যে যে কথাটা বলেছিলেন তা হলো “নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে বড় আর কিছু নেই।” আজ আমাদের দেশে নেতা-নেত্রীদের মাঝে যে জিনিসটার বড় অভাব তা হলো সাহস। এমন উদাহরণ ভুরিভুরি আছে যে আমাদের দেশে নেতা-নেত্রীরা সাহস করে সত্য কথা বলে না, জনমত বিপক্ষে যাওয়ার ভয়ে। সাহস করে পদক্ষেপ নেয় না যদি সিভিল আমলা, সামরিক আমলা, অসন্তুষ্ট হয়। তারা সাহস করে পদক্ষেপ নেয় না যদি দাতা দেশ বিগড়ে যায়। বোঝা সত্ত্বেও সাহস করে পদক্ষেপ নেয় না যদি মহল্লার মাস্তানরা বিগড়ে যায়।  তাই ‘সাহস কর্ণেল তাহেরের জীবন থেকে শেখার সবচেয়ে বড় বিষয়। ঠিক-ভুল যাই করুন না কেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাহাড় সমান জনপ্রিয়তার সামনেও নতি স্বীকার করেননি। আজকাল নিরবচ্ছিন্ন চামচাগীরিই হচ্ছে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের মূল বৈশিষ্ট্য। যাক, কেন কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিতে হলো ?
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই অকুতোভয় বাঙালি অফিসার দেশের স্বাধীনতার ডাকে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে দেশের জন্য স্বাধীনতার যুদ্ধে সম্পৃক্ত হন। তখন আর দশটা বাঙালি মানুষের চোখে যেমন স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হলে সত্যিকারভাবে গরীব দুঃখী মানুষের কল্যাণ হবে এরকম ভাবনা ছিল তাহেরের চোখেও। কিন্তু স্বাধীনতার পর ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে যদিও মুজিব সরকার নারায়ণগঞ্জে একটা চাকুরীও দিয়েছিল কিন্তু দেশের মানুষের দারিদ্র্য, অনাহার, দুর্ভিক্ষ, দেশ জুড়ে অনাচার-অরাজকতা, আওয়ামী লীগের অপরিপক্কতা কর্ণেল তাহেরকে জাসদ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে। এই জাসদ রাজনীতিই কর্ণেল তাহের তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। আজ সেই জাসদ রাজনীতি আর সেই উদ্দীপনা নিয়ে নেই। কর্ণেল তাহের সহ আরও কয়েক হাজার যুবক নানাভাবে হত্যা ও মৃত্যুর শিকার হয়েছিল যে রাজনীতির জন্য তা আজ বহুধা বিভক্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ এবং দলছুট হতে হতে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে উপনীত। সুতরাং সঙ্গতভাবেই সকল সচেতন মানুষের কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় যে জাসদ রাজনীতি কি ছিল যা একাধারে মানুষকে এত বড় শৌর্য-বীর্য, সাহসিকতায় উজ্জীবীত করেছিল আবার কেনই বা তা তুলার মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে অবশেষে বিলুপ্ত প্রায় পর্যায়ে এসে পৌঁছালো?
জাসদ রাজনীতির গোঁড়ার দিকে তাকালে দেখবো ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবরের সিদ্দিক মাষ্টারের লাশ সামনে নিয়ে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে গড়ে উঠেছিল আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদ। তার প্রেক্ষাপট হলো ওই বছরের ১০ই জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার পর তাকে আওয়ামী সরকার কায়েম না করে সর্বদলীয় বিপ্লবী জাতির সরকার কায়েম করতে বলেছিলো তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সব রাজনৈতিক দলগুলো এবং আওয়ামী লীগেরই একটা রেডিক্যাল অংশ। তিনি তা মানেননি। ফলে ছাত্রলীগ (রব-সিরাজ) আ.স.ম. আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজ এবং ছাত্রলীগ (সিদ্দিকী-মাখন) নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন - এই দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে আর দ্বিতীয় অংশ মুজিববাদকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে। পরবর্তীকালে ওই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী ছাত্র সংগঠনের মূল নায়কদের প্রত্যক্ষ চেষ্টায় গড়ে উঠেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ‘জাসদ
কিন্তু একটি প্রশ্ন এখানে এসে যায় দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে কীভাবে এবং কেন এতো তাড়াতাড়ি দেশের সর্ববৃহৎ বিরোধী দল তারই দল থেকে গড়ে উঠতে পারলো? কোনো দায় কি তার ছিল না? সত্যের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, আমাদের দেশের স্বাধীনতার পূর্বকথা কি? স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি কি আমাদের কারো ছিলো? স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তীকালে জাতি গঠনে নেতৃত্ব দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্যর্থ হয়েছিলেন কেন? আমাদের উপমহাদেশের নির্মম ইতিহাস হলো এই যে, আদি থেকে আজ অবধি নেতাদের যেখানে জনগণকে অগ্রসর করার কথা সেখানে জনতা নেতাদের ধাক্কা মেরে সামনে অগ্রসর করেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, সূর্যসেন, প্রীতিলতা সহ অসংখ্য মানুষ জীবন দিতে দিতে যখন সুভাষ বোসের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমে পড়েছে, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন হয়ে গিয়েছে, তখন নেতারা আলোচনার টেবিলে গিয়ে মাউন্ট ব্যাটেন সাহেবের সঙ্গে রফা করলেন নেতৃত্ব দিলেন সর্দার বল্লব ভাই প্যাটল, মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহেরু, জিন্নাহ প্রমুখেরা। ভাল করে বলতে গেলে জনতার স্বাধীনতার যুদ্ধকে তারা আপোষের চোরাপথে ঠেলে দিলেন। একইভাবে মুসলিম সামপ্রদায়িক বিক্ষোভ যখন নানা কারণে ধূমায়িত হতে হতে একটা সর্বাত্মক ভাঙ্গন পরিস্থিতি জনতা সৃষ্টি করলো তখনো জিন্নাহ্‌ সাহেব কংগ্রেসেই ছিলেন। পরে সময় বুঝে হঠাৎ এসে একটা কিস্তি টুপি মাথায় দিয়ে পাকিস্তানের জাতির পিতা হয়ে নেতা বনে গেলেন মুসলমানদের, কিন্তু দাড়ি রাখার আর সময় পেলেন না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। ১৯৭১ সনে মানুষ যখন মারমুখী হয়ে উঠলো, প্রকৃত সত্য হচ্ছে নেতৃত্ব তখনও স্বাধীনতা চায়নি। চেয়েছেন পাকিস্তানের ক্ষমতার তখতে বসতে। তাই দলকে সাজাতে পারেননি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার উপযুক্ত দল হিসেবে। স্বাধীনতার পূর্বেই দলের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ, নেতৃত্বের কোন্দল এগুলি ছিল। ঐতিহাসিক ৭ মার্চেও এক দল চাইলো স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া হোক, অন্য দল চাইলো আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হোক। তিনি দুইই করলেন। ফলে ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী সৈন্যদের মার খেয়ে দিশেহারা নেতারা সীমান্ত পার হয়ে নিজেরা মারামারি শুরু করে দিলেন। একাংশ মোশতাক, তাহের ঠাকুর গংদের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন চক্রান্ত ও মুজিব মুক্তির নামে জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে লাগলেন। অন্য অংশ আবার তাজউদ্দিন গংদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হলেন। আর একটি অংশ শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খানদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হলেন। তাদের তিন গ্রুপের মধ্যস্থতাই হলো দায়। যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ জনতার বিষয়ে পরিণত হলো তখন গড়ে উঠলো আলাদা আলাদা বাহিনী - একদিকে ফ্রিডম ফাইটার, অন্যদিকে বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনী নাম নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ চললো। অতএব আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন পরিস্থিতি এবং জাসদ গড়ে ওঠার পরিস্থিতি সেদিনই ছিল, পরে যা হয়েছে তা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
যাক, জাসদ একঝাঁক তরুণকে সংঘবদ্ধ করে যদিও অসাধারণ সাংগঠনিক যোগ্যতা ও সাহসের পরীক্ষা পদে পদে দিতে পেরেছিল কিন্তু পারেনি যা দিতে তা হলো - অর্জন করতে সঠিক রাজনৈতিক দর্শন যা দিয়ে তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে এবং তার পরিপূরক রাজনৈতিক কর্মী চরিত্র। বলতে গেলে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কারো মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলতে তারা কি কায়েম করতে চায় তার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ধারণা বলতে দলটি যে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ নেতৃত্বে নির্ভরশীল ছিল সেই সিরাজুল আলম খান ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রশ্নে যে বোধ-বিশ্বাস রাখতেন দলে তারই চর্চা হতো। তিনি ষাটের দশকের গোড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে তিনি আদমজীতে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন দাঁড় করান। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার এই মানুষটি ছাত্র-রাজনীতির পর থেকে আর কখনো প্রকাশ্যে সাংগঠনিক দায়িত্ব নেননি। কিন্তু নেপথ্যে তিনি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সহ আওয়ামী রাজনীতির নানা পর্যায়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী তারই চিন্তার ফসল। যুদ্ধ উত্তর জাসদ রাজনীতি পুরো তার একক  চিন্তার ফসল। তারপর তিনি হলেন বিদেশী আধিপত্যবাদীদের হাতের ক্রীড়ানক। তিনি জাসদ গড়ে তোলার লগ্নে জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ এগুলোকে সামাজিক বিপ্লবের সহায়ক হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন। এর পাশাপাশি তিনি সেনাবাহিনীতে “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নাম দিয়ে সংগঠন দাঁড় করালেন এবং সেই গোপন সংগঠনের নেতৃত্বে নিয়োগ করলেন কর্ণেল তাহেরকে। বিপ্লবের মূল সংগঠন প্রশ্নে তিনি নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্পষ্ট ধারণা রাখলেন। তিনি ধারণা দিলেন যে প্রচলিত গণ সংগ্রাম, গণ আন্দোলনকে একটা পর্যায়ে ছেদ ঘটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। ওই বিপ্লবী আন্দোলন থেকেই পরীক্ষিত কর্মী বের হয়ে গড়ে তুলবে বিপ্লবী সংগঠন। তার এই তত্ত্বের ভিত্তিতে তিনি গণ আন্দোলন  করতে করতে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচী দিলেন। সেটাই ছিল জাসদ রাজনীতির গণ আন্দোলনের সর্বোচ্চ পর্যায়। সেখান থেকেই তিনি ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করলেন যেখানে বহু রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস যোগ দিয়েছিলো নিজেদের পরিচয় গোপন করে। অবশ্যই এ কথা ঠিক যে জাসদ এত তাড়াতাড়ি গণ আন্দোলন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে পারতো না  যুদ্ধাপরাধীদের প্ররোচনায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা সীমাহীন অত্যাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি সৃষ্টি না করলে অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় ও দল পরিচালনায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ  অদূরদর্শিতার পরিচয় না দিলে। জাসদ গণ বাহিনী গড়ে তুলে তাদের ভাষায় গণ আন্দোলন ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তর করলো। ১৭ থেকে ২৭ বছর বয়সের যুবকদের হাতে তুলে দিল আগ্নেয়াস্ত্র, লুঠ করার নির্দেশ দিল থানা-ফাঁড়ি। মোকাবেলা করার নির্দেশ দিল আওয়ামী রক্ষী বাহিনীকে। কিন্তু দিতে পারলো না কোনো আদর্শ বা নীতির প্রাথমিক ধারণা। পারলো না জনগণকে পুনরায় সম্পৃক্ত করতে। ফলে যা হবার তাই হলো। কোথাও কোথাও অস্ত্র দিয়ে শুরু হলো পুলিশ - রক্ষী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ। কোথাও কোথাও লুটতরাজ, হুমকি, লাল চিঠি দিয়ে চাঁদাবাজি, কোথাও বা বিপ্লবের অস্ত্র ব্যবহৃত হতে লাগলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল কিংবা স্বার্থের কাজে। সারাদেশ ছেয়ে গেল অরাজকতায়। আতঙ্কগ্রস্ত হলো শাসক দল এবং আতঙ্কগ্রস্ত হলো জনগণ। জাসদ নেতৃত্ব কালক্রমে অনুভব করতে থাকলো যে জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে যাবে তাড়াতাড়ি এহেন বিপ্লব শেষ না করা হলে।
এদিকে দেশ যখন নৈরাজ্যে, অরাজকতার দুর্ভিক্ষে ছেয়ে গেলো তখন শাসক দলে বিরোধ-দলীয়করণ তুঙ্গে। তাদের অরাজকতার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর একটা দল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৫ আগষ্ট ’৭৫ হত্যা করে বসলো। ইন্ধন জোগালো খন্দকার মোস্তাক গং। কর্ণেল ফারুক-রশিদ, খন্দকার মোস্তাক যখন দেশ চালানোর নামে সেনাবাহিনীতেও চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গলো তা রক্ষার জন্য ৩ নভেম্বর ’৭৫ আর একটা পাল্টা অভ্যুত্থান করে ফারুক-রশিদকে সেনা কমান্ডে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো খালেদ মোশাররফ, সেফায়েত জামিল গংরা। তারা জিয়াকেও বন্দি করলো তার ভূমিকা না বুঝতে পারার কারণে। পুরো সুবিধাবাদী অবস্থানে থাকার কারণে সেনা ছাউনীতে জিয়ার ভাসমান জনপ্রিয়তা ছিল। জাসদ মুজিব হত্যায় প্রত্যক্ষ জড়িত ছিল না এটা যেমন সত্য, মুজিবের দলের মোস্তাকরাই মুজিব হত্যায় প্রত্যক্ষ জড়িত ছিল এটা যেমন সত্য, আবার জাসদই কেবল গণ আয়তনে মুজিব হত্যার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছিল বা মুজিবের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নিঃশেষ করেছে এটাও সত্য। জাসদ কর্ণেল তাহেরের মাধ্যমে ফারুক-রশিদের সাথে যোগাযোগ করেও (রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পরে) মোস্তাকের কারণে তাদের বিপ্লব ডিজাইন ফারুক-রশিদকে গ্রহণ করাতে পারেনি। এদিকে গণ বাহিনীর তৎপরতা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সব কিছু দেখে তাড়াতাড়ি কিছু করার বাসনা তাদের পেয়ে বসে। সুযোগ তাদের মাথায় চলে আসে। জিয়াকে বন্দি করাকে কেন্দ্র করে এবং খালেদ মোশাররফের পারিবারিক পরিচয় থেকে সেনাবাহিনীতে রক্ষী বাহিনী আতঙ্ক এবং ভারত আতঙ্ক, আওয়ামী লীগের উত্থান আতঙ্ক কাজ করে। এর মধ্যেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে অফিসার সিপাহী বিরোধকে কাজে লাগিয়ে আর একটা পাল্টা অভ্যুত্থান করে জিয়াকে মুক্ত করে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান পুরোটা কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বেই হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে একজন প্রচলিত বাহিনীর অফিসারকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই বিপ্লব হয় না বা তাকে দিয়ে বিপ্লবী কাজ করানোও যায় না। তাই সকাল ৬টায় ক্ষমতায় বসিয়ে বেলা ২টার মধ্যেই জাসদ জিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। মাহবুব আলম চাষী, মোস্তাকের মাধ্যমে আমেরিকার দূতাবাসই জিয়ার উপর পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপরও থামেনি জাসদ। তেমনি তাহের ১৮ নভেম্বর এবং ২৬ নভেম্বর পরপর দুটো সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ২৬ নভেম্বর কারারুদ্ধ হন এবং প্রহসনমূলক বিচারে কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি হয়।
এখানে যে বিষয়টা শিক্ষার তা হলো জাসদের বিপ্লবী (সশস্ত্র) আন্দোলন থেকে বিপ্লবী সংগঠন হবে, না আগে বিপ্লবী সংগঠন করে তারপর বিপ্লবী আন্দোলন করতে হবে এ প্রশ্নে  সিরাজুল আলম খান আগে বিপ্লবী সংগঠন করে তারপর বিপ্লবী আন্দোলন করলে হয়তো আজকের অবস্থা হতো না, হয়তো সফল হতেন। গণ আন্দোলনে ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরের চিন্তাও হয়তো সেদিন ছিলো বেঠিক। আসলে গণ আন্দোলন, বিপ্লবী আন্দোলন একই বিষয় শুধু নেতৃত্বের কারণেই নামের তারতম্য হয়। ঠিক-বেঠিক ইতিহাস বলবে। কিন্তু এটা সত্য যে, একটি রাজনৈতিক পথ-মতের সঠিকতা ও বেঠিকতা সামগ্রিক দলের বিষয়, দলের মূর্ত ও বিমূর্ত নেতৃত্বের বিষয়। কিন্তু দেশের জন্য একটা বিশ্বাসের স্বপক্ষে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে কজন?
শাসকদের সাথে গিয়ে দলবদল, আপোষ-আঁতাতের চোরাগলিতে নিজেকে বিক্রি করে না ক' জন? নিজের জন্য জীবন-যাপনে যথেষ্ট বিত্ত-বৈভব পায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারে কজন? এ নিরিখে বিচার করলে তাহের যে কোনো পর্যালোচনায় শ্রেষ্ঠত্ব পাবেন যুগে যুগে কালে কালে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন