বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

কোন আবর্তে ঘুরছে দেশবাসী


কোন আবর্তে ঘুরছে দেশবাসী
 
'আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষি করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য' (১৪:৪), 'আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানবানদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে' (৩০:২২)।
 
সংলাপ ॥ নির্বোধ আর মতলববাজ। চরিত্র বিপরীত! সময়ে অথবা প্রায়শই এ দু'য়ের ভূমিকা হয়ে পড়ে অভিন্ন। দেশটার নাম বাংলাদেশ। সুতরাং জাতীয়তা হতে হবে বাংলাদেশী! সরলভাবে শুনলে গভীরভাবে না ভাবলে চট করেই হয়ত যে কেউ বলে বসবেন 'ঠিকই তো। বাংলাদেশীই তো।' কিন্তু বিষয়টি এরকম সরল নয়। মাঝে ফাঁক রয়েছে। এই ফাঁক গলিয়েই রাজনীতিক মতলববাজরা আশ্রয় নেয় বিদেশী শক্তির কোলে আর ষড়যন্ত্র করে সুচতুরভাবে। ভাষা বলতে একক অর্থে ভাষা নয়, অভিন্ন কৃষ্টি, অভিন্ন সংস্কৃতি ও অভিন্ন ঐতিহ্য এবং অবশ্যই হাজার হাজার বছরের অভিন্ন ভৌগোলিক সামাজিক আর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারও। স্বাধীনতার পর আমরা বিশ্বখ্যাত একটি সংবিধান পেয়েছিলাম।
ছিলো তার মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য চারটি মূলনীতিঃ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় যতদূর জানা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদের কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সংবিধানে দেয়া হয়নি। যার ফলে আজও এই দুটো নীতি নিয়ে চলছে নোংরা রাজনীতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি।
মতলববাজরা, জাতিদ্রোহী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারীরা, ১৯৭১ সালের ১০ বছরের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা তিন হাজার বছরের বাঙালি জাতির মাথায় সাইনবোর্ড লটকে দিয়েছে বাংলাদেশী জাতি বলে। গায়ের জোরে সাংবিধানিক স্বীকৃতি করিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তা। মূলত বিশ্ববাসী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখলো একটা জাতির কাছে তুলে ধরা এক নিকৃষ্ট হীন অপচেষ্টাকে। এ অপচেষ্টা হচ্ছে এই বাঙালি জাতির সত্ত্বাকে মুছে দেয়ার, তিন সহস্র বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঢেকে ফেলার। যেন ১৯৭১ এর আগে কিছুই ছিলোনা এ জাতির। '৭১-এ জন্ম নেয়া বাংলাদেশ থেকেই এর যেন প্রথম যাত্রা শুরু।
শিক্ষিত ক্ষমতালোভী মতলববাজদের এই অপচেষ্টার আড়ালে ঢাকা রয়েছে রাজনীতিকদের ঘৃণিত প্রত্যাখ্যাত চেহারা। ধর্মের নামে ধর্মকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, সমপ্রদায়গত, কিংবা রাষ্ট্রীয়গত শোষণ, লুটপাট ও ধর্মের নামে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে দলের কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এদেরই  পূর্ব-পুরুষ মুসলমানিত্বের জিকির তুলে ১৯৪৭ সালে ভারতকে খন্ড বিখন্ড করেছিলো, বিভক্ত করেছিলো সমৃদ্ধ বাংলাকে। সৃষ্টি হয়েছিল প্রতারণার রাষ্ট্র 'পাকিস্তান'! ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা আজো তাড়া করে চলছে ওই রাষ্ট্রটিকে।  মতলববাজ ধর্মব্যবসায়ী ও তাদের প্রভু-গডফাদাররা পাকিস্তান আর সৌদি ওহাবীয়?রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মতো এক উদ্ভব মতলবি তত্ত্ব তৈরি করে ধর্মভীরু জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। বলে বেড়াচ্ছে, 'আমরা আগে মুসলমান তারপর বাঙালি'। যেন জন্মটাই হয়েছে সুন্নতি মুসলমানরূপে। মায়ের পেট থেকেই পণ্যের ক্যাটালগের মতো যেন জন্মেছে সঙ্গে একটি স্টিকার আর তাতে লেখা আরবী ভাষায় নাম।
শ্বাশ্বত সত্য চিরন্তন পথের দিশারী। আল-কুরআনে সুস্পষ্টভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে একটি জাতির ভাষাকে যার উপর ভিত্তি করে, যাকে কেন্দ্র করেই ওই জাতির অস্তিত্ব এবং এর কৃষ্টি-সংস্কৃতি। 'আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষি করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য' (১৪:৪), 'আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানবানদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে' (৩০:২২)। অনুসন্ধিৎসু ও জ্ঞানবানদের জন্য এরূপ সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকলেও তা চোখে পড়ে না উগ্র রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের। ওই আল-কুরআনের আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করে না ধর্মব্যবসায়ী মতলববাজরা। আল্লাহ্‌ যা বলার তা রাখ ঢাক না করে বলে দিয়েছেন। বলেছেন, 'কুরআন আমি তো আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পারো' (১২:২)। আরও খোলাখুলিভাবে এও জানিয়ে দিয়েছেন, 'এইভাবে আমি তোমার উপর আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি সতর্ক করতে পারো নগর  অধিবাসীদেরকে ও তার আশে পাশে যারা বাস করে তাদেরকে, আর  সতর্ক  করতে  সমবেত হওয়ার দিন সম্পর্কে, যার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই' (৪২:৭)। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতারই প্রতিফলন দেখা যায় আরবীয়দের মাঝে। তাই তারা নিঃসংকোচে পরিচয় দেয় নিজেদের  আরবীয় হিসাবে। মুহম্মদী ইসলামের সূক্ষ্মভাবে বিরুদ্ধচারণকারী সৌদীদেরই 'ফেৎরা-ভোগী' ওহাবী ইসলামপন্থী এদেশীয় ধর্মবেত্তা এবং ধর্মীয় উগ্র মতলববাজরা গত তিন দশক ধরে সন্ত্রাস ও  মিথ্যাচারের পথ ধরে আজও চিৎকার করে বাঙালিকে বোঝাবার চেষ্টা করে  চলেছে, 'আমরা আগে মুসলমান তারপর বাঙালি'!
এদেশের প্রায় ১৫ কোটি বাঙালি গত একটি শতক ঠেকে-ঠকে এদেশের ধর্মভীরু মুহাম্মদী ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা জেনেছে এবং উপলব্ধি করছে মুসলমানিত্ব তাদের প্রথম পরিচয় নয়- বাঙালিত্বই তাদের প্রথম পরিচয়। অক্ষমতা নির্বুদ্ধিতার বলেই হোক আর বিভ্রান্তির কবলে পড়ে হোক যারা বলতে চায় আমরা আগে মুসলমান তারা নিজের অজান্তেই নিজেকে ইসলাম অবমাননাকারী এবং জাতির কুলাঙ্গারে পরিণত করে তুলছে-পরিণামে হয়ে উঠছে
জাতিদ্রোহী এমনকি সত্য ও শান্তির ধর্মদ্রোহীও হয়ে হচ্ছে ধর্মীয় সন্ত্রাসী।
তাই এখনো সময় আছে। নিজেকে চিনুন। মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমিকে চিনুন। নিজের সংস্কৃতিকে চিনুন তাহলে যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন তা সঠিকভাবে ধারণ-লালন-পালন করে সত্যকার ধার্মিক হতে পারবেন। নচেৎ শুধু আরবী ভাষায় কুরআন পড়ে এবং আরবদের মত পোশাক গায়ে জড়িয়ে ধর্ম পালন করলে নিজেকে চেনা হবে না এবং নিজের সাথে নিজে প্রতারণা করবেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সত্যের পথে আসার পথ ফুরিয়ে যায় না সুতরাং শান্তি নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে  শান্তির (ইসলাম) ঝান্ডা তুলে  ধরুন যাতে ওই ঝান্ডা হেলে না পড়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন