জিএসপি সুবিধা স্থগিতঃ
স্বাবলম্বী অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ
মোঃ তৈয়ব ॥ ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অবাধ বাজারসুবিধা বা জিএসপি
পেয়ে আসছিল বাংলাদেশের সিরামিক, প্লাস্টিকপণ্য, উলের তৈরি পাপশ, তাঁবু, চশমাসহ
রপ্তানিমুখী কয়েকটি শিল্প। কিন্তু গত ২৭ জুন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টার
দিকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে
বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে ওবামা প্রশাসন। যার
সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি, এপি, রয়টার্স
ও বিবিসি অনলাইনের খবরেও।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি
সমিতির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের
অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের
রপ্তানি খাতকে শক্তিশালী করতে এবং দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু রপ্তানিমুখী পণ্যকে তাদের দেশে জিএসপি সুবিধা দিয়ে
আসছে। কিন্তু বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পখাতে
অনিরাপদ কর্মপরিবেশ বিদ্যমান থাকায় এবং এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বারংবার তাগাদা
সত্ত্বেও কর্মপরিবেশ উন্নত না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের
জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে।’
২০০৭ সালে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার এন্ড
কংগ্রেস অব ইন্ডাষ্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা
প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছিল-অনেকে মনে করছেন ওবামা প্রশাসনের বর্তমান
সিদ্ধান্তটা ঐ আবেদনেরই ফলাফল। কিন্তু এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বর্তমানে বাংলাদেশ
ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি ও ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের ডিন হিসেবে কর্মরত স্বনামধন্য
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন,
এএফএল-সিআইও-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে নয়, বরং
বাংলাদেশ কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি বলেই
এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু জিএসপি
সুবিধা প্রত্যাহার করেনি,
শুধু স্থগিত করেছে। এটা সতর্ক সংকেত। বাংলাদেশকে স্বাবলম্বী
হওয়ার জন্য সুযোগও বলা চলে। কারণ এর ফলে দেশে শ্রমিকবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি হবে।’ তবে তিনি
মনে করেন, দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসা ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে নানা দুর্ঘটনার সাথে তাজরীন
গার্মেন্টস ’র ভয়াবহ অগ্নিকা-,
তেজগাঁও-এর ভবন ধ্বস ও সর্বোপরি অতি সম্প্রতি সাভারে ঘটে
যাওয়া মর্মন্তুদ পোশাক কারখানা ধ্বসে পড়ে হাজারেরও বেশি শ্রমিকের মৃত্যু
যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ করে দিয়েছে এমন সিদ্ধান্ত নিতে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর
ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, আমাদের মোট রপ্তানি পণ্যের মাত্র
২১ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে আবার ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। তাছাড়া যেসব
রপ্তানি পণ্য জিএসপি সুবিধা পায়, সেগুলোর মূল্য ও পরিমাণ কোনোটাই উল্লেখযোগ্য নয়। তাই জিএসপি
স্থগিতে দেশের রপ্তানি খাত খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। তার মতে, যেহেতু
জিএসপি সুবিধা পাওয়া পণ্য সিরামিকের গত অর্থবছরের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৩০ কোটি
টাকা, যার ২৫ শতাংশই অর্জিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, কাজেই জিএসপি সুবিধা স্থগিত একটা
অশনি সংকেত! কেননা এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এমনকি
কানাডাও একই পদক্ষেপ নিতে পারে। ফলশ্রুতিতে আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়া শিল্পগুলোর
রপ্তানি ব্যাহত হবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে; কর্মসংস্থান কমবে। পরিণামে বাড়বে
বেকারত্ব; দেখা দিবে সামাজিক বিশৃংখলা।
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি
সুবিধা স্থগিতের বিষয়টিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের
সমিতি (বিজিএমইএ) দেখছে একটি আন্তর্জাতিক ‘ট্রেড কন্সপিরেসি’ বা
বাণিজ্য ষড়যন্ত্র হিসেবে। এ প্রসঙ্গে ড. আশরাফ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে এই ধরনের
ট্রেড কন্সপিরেসি তো থাকবেই! বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো যেমন ভারত, পাকিস্তান, চীন বা
শ্রীলংকা তো নিজেদের স্বার্থে ট্রেড কন্সপিরেসি করবেই। তবু এর মাঝেই তো আমাদেরকে
স্বাবলম্বী হতে টিকে থাকতে হবে। এটাইতো স্বার্থকতা।’
বর্তমানে স্থগিতকৃত জিএসপি সুবিধা শেষ পর্যন্ত
চূড়ান্ত প্রত্যাহারের দিকে যাবার কোনো ঝুঁকি আছে কিনা-জানতে চাইলে প্রখ্যাত এই
অর্থনীতিবিদ মনে করেন,
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে একটা সতর্ক সংকেত দিয়ে দিয়েছে, কাজেই
তাদের দাবীগুলো পূরণ না হলে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে তিনি
নিরাপদ ও শ্রমিকবান্ধব কর্মস্থল, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয়ার উপর
বিশেষ করে জোর দেন। তবে তিনি মনে করেন, বর্তমান এই সংকট নিরসনে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বিজিএমইএ-কেই। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের
বর্তমান কঠোর মনোভাবের জন্য দায়ী মূলত পোশাকশিল্পের ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা। কাজেই এই
সংকটের দায় সবচেয়ে বেশি বিজিএমইএ-এর। সরকারের দায়িত্ব বিজিএমইএ-কে এক্ষেত্রে
প্রভাবিত করা।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন