মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাংলা ভাষায় যুগোপযোগী খোতবা কবে হবে ?

বাংলা ভাষায় যুগোপযোগী খোতবা কবে হবে ?

সংলাপ ॥ খোতবা শব্দের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটা আরবি 'খুৎবুন' শব্দ হতে উদ্ভুত, যার আভিধানিক অর্থ হলো বক্তৃতা। ইসলামী পরিভাষায় খোতবা বলতে  আল্লাহ্‌র প্রশংসা, রাসুলের প্রশংসা ও বক্তৃতা বুঝানো হয়। খোতবার উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌র জিকির বা স্মরণ এবং বক্তৃতা ও উপদেশ প্রদান করা। আর এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক সংশোধন ও সমাজ সংস্কার। খোতবার এসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম কর্তৃক নির্বাচিত ও নির্ধারিত ক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, জুম্মার নামাজের পূর্বে মসজিদে কিংবা ঈদগাহে, দুই ঈদের নামাজের পরে, আরাফাতের ময়দানে হাজীদের উদ্দেশে, বিবাহ অনুষ্ঠানে আক্‌তের সময় এবং জানাজার দোয়া ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত।
শুক্রবার দিনটি অন্য সব দিনের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, কারণ এদিন সারা বিশ্বের সব মসজিদে জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। শহর গ্রামের সব মুসল্লিরা এ দিন মসজিদে একত্রিত হন। রাসুল (সা.)-এঁর যুগে তিনি নিজেই খোতবা প্রদান করতেন। রাসুল (সা.)  খোতবার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিধি বিধান, প্রেরণা বাণী, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতি-নীতি, কৃষি কাজ, স্বাস্থ্য, সামাজিক সমস্যা, ইবাদত-বন্দেগী, বিচার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়ের সমাধান তুলে ধরতেন।  মুমিন হতে হলে তার করণীয় ও বর্জনীয় বিভিন্ন বিষয়গুলো কি তা বিশদভাবে আলোচনা করতেন। আমাদের দেশে খতিবগণ সাধারণতঃ বার চান্দের খোতবার কিতাব সংগ্রহ করে তা দেখে দেখে আরবি ভাষায় পাঠ করেন। অথচ এদেশের মানুষের ভাষা বাংলা। বেশির ভাগ মানুষই আরবি ভাষা জানেন না, তাই খতিবের দেয়া খোতবা শ্রবণ করেন বটে কিন্তু এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে খোতবার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
অধিকাংশ খতিবগণই সাধারণত নিজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতি শুক্রবারের জন্য আলাদাভাবে কোন খোতবা তৈরি করেন না। একজন খতিব যদি প্রতি সপ্তাহের জন্য নিজে খোতবা তৈরি করেন, তবে তার নিয়মিত জ্ঞান চর্চা হয়। আর নির্ধারিত খোতবা পাঠে তার চিন্তার বিকাশ ঘটে না।  আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪২ বছর পরও মাতৃভাষায় ইসলামী সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত হতে পারেনি। প্রতি শুক্রবার জুম্মার দিন খোতবাগুলো যদি গঠনমূলকভাবে তৈরি করা হতো, তবে এ দেশের অনেক খতিবই যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত লেখক এবং গবেষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারতেন। একটি সুন্দর উপযুক্ত, মানসম্মত ও আদর্শ খোতবা তৈরির জন্য কতগুলো নিয়ম পদ্ধতি এবং কলাকৌশল অনুসরণ করতে হয়। যার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব, জাতি সঠিক দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে। বর্তমান বিশ্বে যেসব ফেৎনা-ফ্যাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন কলহ-কোন্দল বিরাজমান, যেমন গণহত্যা, বর্বরতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যাকা- ইত্যাদি নিয়মিত চলছে - এসব কিছুর প্রতিকার কী? কী উপায়ে এর থেকে জাতি মুক্তি পেতে পারে। এ সম্পর্কেও জাতিকে দেয়া যায় দিক নির্দেশনা। সমাজের সাধারণ মানুষও খতিবের কাছে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যই আশা করেন। আমাদের দেশের খতিবগণ প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন খোতবা তৈরি করে দেশ ও জাতির চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবা যেন  বিষয়বস্তুর আলোকে দু'ভাগে বিভক্ত হয়। ১. কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খোতবা। যেমন ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণ। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, পহেলা ?বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষের  তাৎপর্য, ১০ মহররম, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ইত্যাদি বিষয়াবলীর প্রকৃত ঘটনা ও তাৎপর্য গুরুত্ব সহকারে মুসলমানদের সামনে তুলে ধরা। ২. কুরআনের আলোকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা। যেমন ঈমান, আখলাক, আদব, কী?  কুরআনের উপদেশ সংবলিত ঘটনাবলি, ও আদেশ-নিষেধ বর্ণনা করা। নবী-রাসুল (সা.), ও মুসলিম মনীষীদের জীবনদর্শন আলোচনা করা। গবেষণামূলক আলোচনা করা, যেমন আমাদের মাঝে নিত্যনতুন যেসব আবিষ্কার ও পরিভাষা সৃষ্টি হচ্ছে তা আলোচনা করা। সর্বশেষ আগামী দিনের চরিত্র গঠনমূলক আলোচনা ও ইসলাম ধর্মের দিক নির্দেশনামূলক খোতবা দেয়া। অতএব কোন খতিব যদি এ নিয়মে তার খোতবা সাজাতে পারেন, তবে তার খোতবাটি একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবা হবে। মুসলমানদের মাঝে খোতবা শুনার আগ্রহ বাড়বে। তাই আমাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রতি শুক্রবার নতুন খোতবা প্রস্তুত করে মুসলমান্লদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা উচিত।
স্মর্তব্য, ১৯৬০ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রথমবারের মতো ইমাম প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করেছিল। সে সময় খোতবা সংস্কারেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং তৎকালীন বিশিষ্ট উলামা এবং বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক বাংলা অনুবাদসহ নতুন খোতবাও রচিত হয়েছিল, একযোগে তা অনেক মসজিদে পঠিতও হয়েছিল বলে জানা যায়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, নব্বই-এর দশকে বাংলাদেশে খোতবা সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে কিছুটা বাস্তব পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ১৪ জানুয়ারী ইকবাল রোডে ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প আয়োজিত ১৯৮তম দলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণদান কালে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী একটি খোতবা প্রণয়ন কমিটি গঠন করার তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশে প্রচলিত পুরাতন খোতবার অংশ বিশেষ পরিবর্তন করে মুসল্লীদের মধ্যে প্রচার উপযোগী, বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মুদ্রিত একটি নতুন খোতবা শীঘ্রই প্রণয়ন করা হবে।
তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী ঘোষিত খোতবা সংস্কার কমিটি কিছুদিন কাজও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ফলে সেই খোতবা সংস্কার কমিটির আর কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে খোতবা সংস্কারের  সেটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এরপর খোতবা সংস্কারের আর কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে বলে জানা যায় না। বর্ণিত পটভূমির আলোকে বলা যায় যে, খোতবা সংস্কারের মহৎ উদ্দেশে অতীতে যেসব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ সরকারী রেকর্ড-পত্রে সংরক্ষিত থাকার কথা। নতুন শতকের নতুন পরিস্থিতিতে খোতবা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। যেহেতু এ সম্পর্কে অতীতে যথেষ্ট কাজ হয়েছে এবং বেশ অগ্রগতিও সাধিত হয়েছিল। তাই ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনায় এনে সংরক্ষিত কাগজপত্র/রেকর্ড পত্রের আলোকে অথবা বিজ্ঞ আলেম সমাজের পরামর্শক্রমে পুনরায় খোতবা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। পূর্বের গৃহীত উদ্যোগের সাথে যেসব বিজ্ঞ আলেম সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে এখনও কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব জীবিত আছেন, তাদের মূল্যবান পরামর্শ খোতবা সংস্কারে বিশেষ উপকারে আসতে পারে। খোতবার ইসলামি ঐতিহ্য-চরিত্র বজায় রেখে যুগের চাহিদা অনুযায়ী খোতবা সংস্কারের প্রয়োজন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। খোতবাকে কেন্দ্র করে কেউ যেন বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ না নিতে পারে সেদিকেও সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, আল্লাহর কথা জানতে হলে, বুঝতে হলে, মানতে হলে সবাইকে নিজ নিজ ভাষায় কুরআন পাঠ করতে হবে। হিন্দুর ভাষা, খ্রিস্টানের ভাষা, কাফেরের ভাষা বলে কোন ভাষাকে অবমাননার সুযোগ আল্লাহ কাউকে দেননি। রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে, প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগতভাবে মুসলিম, অর্থাৎ, নিষ্পাপ, ভালো ও শান্ত। তাই মানবশিশু জন্মের পর যে ভাষায় কথা বলে তা-ই মুসলমানদের ভাষা। আল্লাহ তায়ালা জন্মের পর নিষ্পাপ ও পবিত্র মানব-শিশুর মুখে যে ভাষা ফুটিয়েছেন সে ভাষাতেই দিয়েছেন ইবাদত ও কিতাব শিক্ষার পূর্ণ অধিকার। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা যে অধিকার দিয়েছেন কোন মোল্লা তা ছিনিয়ে নিতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে তার সকল নবী-রাসুলের কণ্ঠে একমাত্র আরবি ভাষা দেননি এবং নবী-রাসুলদের মাঝে ভাষাগত ঐক্য সৃষ্টি করেন নি। বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আরবি ভাষাই  যদি কল্যাণকর হতো তবে আল্লাহ এতো ভাষা সৃষ্টি করতেন না এবং তাঁর সব কিতাবই আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করতেন, এবং একমাত্র আরবিকেই ইবাদতের যোগ্য ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করতেন। অনারবি ভাষা আল্লাহর ইবাদতের অযোগ্য হলে বিভিন্ন অনারবি ভাষায় বিভিন্ন কিতাব অবতীর্ণ করতেন না। অথচ আল্লাহ তায়ালা হিব্রু ভাষায় ইনজিল, ইবরানি ভাষায় তাওরাত ও ইউনানি ভাষায় যাবুর অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং কেবল আরবিই আল্লাহ তায়ালার ভাষা নয়। আল্লাহ তায়ালা অন্তর্যামী। সব মানুষের ভাষাই তাঁর ভাষা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাব না বুঝে আবৃত্তি করার জন্য অবতীর্ণ করেননি। যে মানুষ যে ভাষায় তাঁর কিতাব সহজে বুঝতে পারে সে ভাষাই আল্লাহর কাছে প্রিয় ও পছন্দনীয়। আল্লাহর ইবাদতে বান্দার মাতৃভাষার চেয়ে উত্তম কোন ভাষা নেই।
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মসজিদের ইমাম-খতিবগণ সমাজের তৃণমূল থেকে ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামী আদর্শ শিক্ষার বিস্তার, বাস্তবায়ন, সামাজিক অপরাধ-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ধর্মদ্রোহীদের অপপ্রচার-বিভ্রান্তির অবসানে কার্যকর ও বাস্তবমুখী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। রাজনৈতিক ইসলাম ও  বিভ্রান্তদের প্রচারণা এবং অপতৎপরতা রোধে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। এ লক্ষ্যে খোতবা সংস্কারের মাধ্যমে ইমামদের যুগ চাহিদা পূরণে প্রস্তুত ও অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। খোতবা যেন সমাজের অভ্রান্ত দিশারী হিসেবে, আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে তা নিশ্চিত করতে হবে।

রুমীর অমৃত বাণী - ১

রুমীর অমৃত বাণী - ১

·        গতকাল আমি চতুর ছিলাম তাই পৃথিবীকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। আজ আমি বুদ্ধিমান হয়েছি, তাই নিজেকেই বদলে দিচ্ছি।
·        তুমি তো সমুদ্রের মাঝে কোন জলবিন্দু নও, তুমি এক ফোঁটা জলবিন্দুর মাঝে সম্পূর্ণ এক সমুদ্র।
·        শুধুমাত্র এই হৃদয় দিয়েই তুমি আকাশ ছুঁতে পারো।
·        তুমি শাখা-প্রশাখায় যা কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছ, তা শুধু শেকড়েই পাওয়া যায়।
·        আঁকড়ে ধরে রাখা আর চলে যেতে দেয়ার এক ভারসাম্য হলো জীবন।
·        গলে যাওয়া বরফের মতন হও। নিজেকে দিয়ে নিজেকে ধুয়ে দাও।
·        দুঃখ করো না। তুমি যা হারাও তা অন্য কোন রূপে তোমার কাছেই ফিরে আসবে।
·        তোমার চালাকি বিক্রি করে মুগ্ধতা কিনে নিয়ে এসো।
·        বসো, স্থির হও, আর খেয়াল করে শোনো, কারণ তুমি কিন্তু এখন মাতাল, আর আমরা আছি ছাদের একদম কিনারায়।
·        তুমি যখন পথ ধরে হাঁটতে শুরু করবে, সামনের পথ তখন স্পষ্ট হয়ে দেখা দিবে।
·        তুমি জন্মেছিলে দু'টি ডানা নিয়ে। কেন তবে জীবন ভর হামাগুড়ি দিতেই তোমার এত পছন্দ?
·        তুমি যে কষ্টদের সহ্য করছ তারা তোমার কাছে বার্তাবাহক হয়ে এসেছে, তাদের কথা শোনো।
·        তোমার নিজের হৃদয়ের মাধুর্য খুঁজে বের করো, তখন সম্ভবত সবার হৃদয়ের মাধুর্য তুমি খুঁজে পাবে।
·        প্রার্থনা কুয়াশাকে দূর করে প্রাণের শান্তিকে ফিরিয়ে দেয়।
·        যাও, তোমার নিজ হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ো।
·        তুমি যদি তোমার মাঝে আমাকে খুঁজে না পাও তাহলে আর কোথাও পাবে না কোনদিন। আমি তো তোমার মাঝেই ছিলাম, আমার সূচনা থেকে।
·        হতাশ হয়ো না! কেননা সবচেয়ে তীব্র হতাশার মূহুর্তগুলোতে আল্লাহ আশার আলো পাঠিয়ে দেন। ভুলে যেয়ো না, চারপাশ আঁধার করে আসা ঘনকালো মেঘ থেকেই তুমুল বৃষ্টি হয়ে থাকে।
·        তোমার ভেতর এক সকাল অপেক্ষায় আছে উজ্জ্বল আলো হয়ে বিস্ফোরিত হবে বলে।
·        যদি কবিতার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে বসন্তও ফিরে ফিরে আসবে।
·        যখন তোমাকে দিতে কেউ হাতে স্বর্ণ তুলেছে, তখন তুমি তার হাতের দিকে তাকিয়ো না, কিংবা স্বর্ণের দিকেও না। তুমি যে দিচ্ছে তার দিকে তাকাও।
·        কষ্টের উপশম কষ্টের মাঝেই আছে।
·        তোমার কিছু চিন্তাকে ঘুম পাড়াও! ওদের ছায়া হতে দিও না, তোমার অন্তরের চাঁদটাকে ঢেকে ফেলে যে ছায়া। ছায়ারূপী ভাবনায় নিমগ্ন থেকো না।
·        আমি সমস্ত কাঁটা তুলে ফেলতাম! কিন্তু তুমি আবার ফিরে এলে, আমার কন্টকময়তাকেই করে তুললে পাঁপড়ি শোভিত সুগন্ধময়।

·        এমন কি যখন পৃথিবী দগ্ধ হয়, সুপ্ত বীণার তান তখনও বেজে যায়। গ্রন্থি পড়ুক সহস্র, রজ্জু কিন্তু একটাই!

কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব

কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব

সংলাপ ॥  আদম (আ.)- কে সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ তাঁকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন। আর এসব নামই মূলত ভাষা। মাতৃভাষা হলো মায়ের ভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মনের ভাব সহজেই প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। স্রোতের পানির মতো সে ভাষা অবিরাম চলে চলে পথ করে নেয়। বাঁধ দিতে গেলে বাঁধ টেকে না,  স্রোতের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গতিরোধ করা যায় না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মানুষের অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বনই হচ্ছে- মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি। মানুষের জীবন হচ্ছে তার মাতৃভাষা, দেশের ভাষা, জাতির ভাষা। ভাষা সমাজ গড়ে, আবার সমাজও ভাষা গড়ে। তাই কোনো জাতির ভাষা দ্বারা তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। পৃথিবীতে মানব বংশের বিচিত্রতা এবং মানুষের  চৈত্র্যময় রং, রূপ, দেহসৌষ্ঠবের পার্থক্য যেমন মেনে নিতে হয়, তেমনি তাদের ভাষার পার্থক্যও মেনে নিতে হয়। ভাষাকে আল্লাহ তায়ালার মহান সত্তাকে চেনাজানা ও তাঁর রহস্যকে বোঝার নিদর্শন বলা হয়েছে। কুরআন বলছেন,  'নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং তোমাদের স্ব স্ব (মাতৃ) ভাষা ও বর্ণের  বৈচিত্র্য, তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম।' (৩০:২২) কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী ভাষার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহই।
মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করে তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী : 'তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাদের ভাব প্রকাশ করতে শিক্ষা দিয়েছেন।'' (৫৫:৩-৪) তথা কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন।
পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত যত ভাষার আবির্ভাব হয়েছে এবং যেসব ভাষা বর্তমানে প্রচলিত আছে, তার মধ্যে এমন কোনো ভাষা নেই, যে ভাষায় শুধু একজন লোক বা একটি পরিবার কথা বলে; বরং প্রত্যেক মাতৃভাষায় নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠী কথা বলে। আবার কখনো দেখা যায় একই মাতৃভাষায় একাধিক দেশের জনগণ কথা বলে। যেমন- বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং নেপালের কিছু লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। আরবি ভাষায় কথা বলে প্রায় ২২টি দেশের লোক। বিশ্বের বহু দেশের লোক ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডের বা একাধিক ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাটি তাদের মাতৃভাষা হিসেবে বিবেচিত। মাতৃভাষা যে আল্লাহ প্রদত্ত জন্মগত অধিকার, তার একটি প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে লক্ষ্য করে বলছেন, 'তোমাদের ভাষার বিভিন্নতা আল্লাহর এক অন্যতম নিদর্শন।' (৩০:২২)। এ আয়াতে 'তোমাদের' (বহুবচনের) সর্বনামটি এ কথাটিই প্রমাণ করে যে একটি মাতৃভাষায় নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠী কথা বলে থাকে।
পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এক কিংবা দুই লাখ ২৪ হাজার নবী-রাসুলের এক মহাসমারোহ ঘটেছে। আর প্রত্যেক নবী ও রাসুলের ওপর ওহি প্রেরিত হয়েছে তাঁর স্বগোত্রীয় ভাষার মাধ্যমে। মহানবী (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতির জন্য অন্তত একজন করে নবী নির্দিষ্ট ছিল। আর এ জন্যই প্রত্যেক নবী ও রাসুলের ভাষা ছিল তাঁদের অঞ্চলের মাতৃভাষা। কুরআন বলছেন - 'আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যেন তাঁরা তাঁদের সমপ্রদায়ের নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন।' (১৪:৪)। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা-ঔদাসীন্য প্রদর্শন সম্পূর্ণভাবে অনুচিত। যারা মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে, তাদের প্রতি ঘৃণাভরে কবি আবদুল হাকীম বলেছেন :
'দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন না জুড়ায়
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশে না যায়।'
মহান আল্লাহ মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝাতে কুরআন সম্পর্কে বলেন : 'আমি এ কিতাব (তোমাদের মাতৃভাষা) আরবিতেই অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে তোমরা তা বুঝতে পারো।' (১২:২) মহান আল্লাহ তাঁর বাণীতে মাতৃভাষার মৌলিক চারটি কথা- শোনা, বলা, পড়া ও লেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষ যেসব মাধ্যম ব্যবহারে জ্ঞান অর্জন করে থাকে, পড়া হলো এর অন্যতম। তাই মহান আল্লাহ কুরআনের সর্বপ্রথম বাণীতে তাঁর নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, 'হে নবী, তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে পড়ো। যিনি সৃষ্টি করেছেন।' (৯৬:১) মহানবী (সা.)-কে যে ভাষায় পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা ছিল তাঁর মাতৃভাষা।
জ্ঞান অর্জনের দ্বিতীয় মাধ্যম হচ্ছে শোনা। আল্লাহ বলছেন, 'সুতরাং আমি যখন নাজিলকৃত বাণী পাঠ করি তখন তুমি (ব্যস্ত না হয়ে) সে পাঠের অনুসরণ করো।' (৭৫:১৮) কুরআনের অন্যত্র বলা হচ্ছে, 'যখন কুরআন পড়া হয় তখন তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং নিশ্চুপ হয়ে থাকবে। আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হবে।' (৭:২০৪) মহানবী (সা.)-কে যে ভাষায় অহির বাণী শোনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা ছিল তাঁর মাতৃভাষা। শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রথমে অন্যের কাছ থেকে শুনতে হয়।
মানুষকে তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য লেখায় দক্ষ হতে হয়। মহান আল্লাহ মানুষকে কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন (৯৬:৪)। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মহানবী (সা.) নিজ মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতা অর্জনের ফলে গর্ববোধ করে বলেছিলেন, 'আমি আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী। উপরন্তু আমি কুরাইশ বংশের লোক।' (ইবনে হিশাম, পৃ. ১৬২)।
হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করেছেন, 'আমার জিহ্বায় জড়তা রয়েছে, আমার কথা প্রাঞ্জল নয়, সুতরাং হারুনের প্রতিও প্রত্যাদেশ করুন।' (২৬:১৩) 'হে প্রভু! তুমি আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও, যাতে করে তারা আমার কথা ও বক্তব্য বুঝতে সমর্থ হয়।' (২৬:১৩) মহানবী (সা.) ছিলেন আরবি ভাষাভাষী, মাতৃভাষাকে তিনি এত বেশি ভালোবাসতেন যে তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমি তিনটি কারণে আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। তন্মধ্যে একটি হলো আরবি আমার মাতৃভাষা।' আল্লাহ বলেন, 'হে নবী! কুরআনকে আমি তোমার নিজের ভাষায় সহজ করে নাজিল করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে' (৪৪:৫৮)।
আরবিতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আরবি ভাষা মহিমান্বিত হলেও কোনো ভাষাই ইসলামে অবহেলিত নয়। সব মাতৃভাষা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান। তাই কুরআনের ভাষা আরবি হওয়া সত্ত্বেও পবিত্র কুরআন অন্যান্য ভাষার শব্দকে আরবি হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। যেমন- তোয়াহা, আল-ইয়াম, আত-তূর ইত্যাদি সুরইয়ানি ভাষার শব্দ। এর মাধ্যমে কুরআন সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। আর এভাবেই একটি মাতৃভাষা সমৃদ্ধ হয়। (জালালউদ্দীন সুয়ুতী, আল-মুযহির। (পৃ.২৬৮-২৬৯)।
নিজ নিজ মাতৃভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা অপরিহার্য বিষয়। পারতপক্ষে সব জায়গায় নিজের ভাষায় কথা বলা। নিজের ভাষায় লেখা আবশ্যক। মহানবী (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির পর রোম ও পারস্য সম্রাটসহ বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর কাছে আরবি ভাষায় চিঠি লিখে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মাতৃভাষা মানুষের জীবনে কত যে গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতি লক্ষ রেখে মনীষীরা মূল্যবান উক্তি করেছেন। যেমন- হজরত ইবরাহীমের (আ.) সহিফায় লেখা ছিল, 'জ্ঞানীর জন্য উচিত তার ভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ করা, যুগসচেতন হওয়া ও স্বীয় কর্তব্যে সদা মগ্ন থাকা।' হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.) তাঁর এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলে ন, 'যদি হিন্দুস্তানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে উর্দু ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।' প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, 'প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর।' সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, 'কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বোধ পূর্ণ মাত্রায় অর্জন করতে হবে।' হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) বলেন, 'যতক্ষণ না তোমরা আপন ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে, ততক্ষণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।'

অতএব প্রতীয়মান হয় যে কুরআন মাতৃভাষার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষা  দিয়েছে।

দলবাজির থাবা থেকে মুক্ত হোক যুবশক্তি

দলবাজির থাবা থেকে মুক্ত হোক যুবশক্তি

সংলাপ ॥ এদেশে ঘুরে ফিরে ক্ষমতায় আসছে দুটো দল। ক্রমান্বয়ে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ক্ষমতার মসনদে বসে এ দল দুটোর নেতা-পাতি নেতারা শক্তিমান হয়ে ওঠেন, ফুলে-ফেঁপে ওঠেন ব্যবসা-বাণিজ্যে। আর ওই ধারার সাথে মিশে ক্ষমতার ছোঁয়ায় বিপথগামী হচ্ছে দেশের যুবশক্তি।
মানুষ গড়ার কারিগরগণ মানুষ গড়ছেন না, গড়ছেন টাকা তৈরির মেশিন। দেশের বিদ্যাপীঠগুলো ক্রমেই হয়ে উঠছে বিত্ত-বৈভব বানানোর তীর্থস্থান। ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য হয়ে উঠেছে হত্যা-সন্ত্রাস-টেন্ডার বাণিজ্য। এখন ছাত্র রাজনীতি মানেই যেন সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও। ছাত্রনেতা মানেই যেন সন্ত্রাসী, যেখান থেকে বের হয় অস্ত্রের আগুন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি জেলা-উপজেলার বিভিন্ন কলেজগুলো নিয়ে প্রতিদিন খবর আসে পত্রিকার পাতায়। প্রত্যেকটা খবরেই ছাত্র আন্দোলনে দলবাজির থাবা হয়ে উঠছে প্রশ্নবিদ্ধ। সন্ত্রাস আর বীভৎসতার চিত্র দেখে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আর ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হতে চায় না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলে কি সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিদ্যাপীঠগুলো চলবে শান্তির মধ্য দিয়ে? স্বস্থি আসবে?
সত্য হলো এই যে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলেই সন্ত্রাস থামবে না, ক্ষমতার লোভ নিয়ন্ত্রিত হবে না। তরুণ ও যুবকদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত না হলে সন্ত্রাসের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হবে না, সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত হবে না বিদ্যাপীঠ ও যুবশক্তি। যুবশক্তির চিন্তার জগত প্রকৃত শিক্ষার আলোতে আলোকিত করতে হবে। তা না হলে অন্ধকার আরো বিস্তৃত হবে, বৃদ্ধি পাবে ক্ষমতা ও বিত্ত-বৈভবের লিপ্সা।
'৫২ থেকে শুরু করে '৭১ কিংবা স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলনে যুব শক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের বিভিন্ন সঙ্কটময় মুহূর্তে ছাত্রনেতারা দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জীবন দিয়েছেন। তাঁদের রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রসমাজের উন্নয়ন, জাতির উন্নয়ন সর্বোপরি দেশের উন্নয়ন। ছাত্ররাজনীতির সে ইতিহাস এখন শুধুই স্মৃতি। এখন প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আর তাদের এই সংঘর্ষের জন্য প্রাণ দিতে হয় সাধারণ ছাত্রদের। কেন এই আধিপত্য বিস্তার? এর উত্তর থেকেই আমরা ইদানীংকালের ছাত্রনেতাদের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বর্তমান ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য জানতে পারবো। ছাত্রনেতারা ছাত্রদের স্বার্থে রাজনীতি করলে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হতো না কিংবা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হতো না। তাদের এই আধিপত্য বিস্তারের মূলে রয়েছে দলবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, চাঁদা আদায়সহ অন্যান্য কিছু কারণ।

বাংলাদেশে সুস্থধারার ছাত্র ও যুব আন্দোলনের প্রয়োজন ফুরাবে না। ছাত্র-যুবকদের ফিরিয়ে আনতে হবে হারানো ঐতিহ্য। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন দলবাজির থাবা থেকে মুক্ত হয়ে সুষ্ঠু সাংগঠনিক ভিতের উপর যুবশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা।  

মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ভোটাধিকারের পবিত্রতা রক্ষা জরুরি!

ভোটাধিকারের পবিত্রতা রক্ষা জরুরি!

শেখ বর্ষা ॥ ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে চতুর্থবারের মতো উপজেলা পরিষদের নির্বাচন।  দেশের অন্যান্য জেলার মতো নরসিংদীতেও এখন চলছে প্রার্থীদের বিরামহীন প্রচার আর ভোট প্রার্থনা। ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা নাগরিক অধিকার। এই অধিকার এমনভাবে প্রয়োগ করা উচিত যেন দলীয় বা গোষ্ঠীগত বিবেচনার কাছে জনগণের কল্যাণের বিষয়টি হারিয়ে না যায়। নগদ অর্থের বিনিময়ে, কোনো চাপের মুখে কিংবা ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ভোটাধিকার প্রয়োগ সমাজ ও দেশের শান্তি-মঙ্গলের জন্য কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রার্থীর অর্থ-বিত্ত-প্রতাপ ভোট পাওয়ার যোগ্যতা হওয়া উচিত নয়। ভোট পাওয়ার যোগ্য ঐ প্রার্থী যার দ্বারা দেশের সম্পদ লুন্ঠিত হবে না, সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে না, গরীব ও মেহনতি মানুষের ক্ষতি হবে না। তাই ভোট দেয়ার আগে ভোটারদের গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার, বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার যে, প্রার্থীদের মধ্যে যিনি দুর্নীতি, ব্যক্তিস্বার্থ ও দলগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে এলাকার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেবেন তাকেই তিনি ভোট দেবেন।

অন্যায়কে যে বাধা দেয় না সেও অন্যায়ের অংশীদার হয়। অন্যায়কে বাধা দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ হলো নির্বাচন। দেশের এক একটি এলাকায় সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানকার নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অত্যন্ত কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের পবিত্র সংবিধানেও শক্তিশালী  ও কার্যকর স্থানীয় সরকারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও এই স্থানীয় সরকার এখনো কাঙ্খিত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করতে পারেনি। এর জন্য দেশের বিরাজমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী দেশের শক্তিশালী আমলাতন্ত্র। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হোক, সেটা অনেকেই চায় না, আর এই না চাওয়ার কারণও নিঃসন্দেহে কায়েমী স্বার্থ। এই সকল কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে বসবাসকারী মানুষের জনপদে শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষের একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন সত্যিকার অর্থেই একটি দুরূহ কাজ, কিন্তু অসম্ভব নয়। একমাত্র একটি অঞ্চলের আত্মসচেতন ভোটাররাই এই অসম্ভব কাজটিকে সম্ভব করে তুলতে পারেন। আর আসন্ন উপজেলা নির্বাচন সেই কাজের ভার ভোটারদের ওপর অর্পন করে দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আছে, ‘মানুষ যার জন্য চেষ্টা করে তা ব্যতীত তার জন্য কিছুই নেই'। ভোটাধিকার তাই একটি পবিত্র  আমানত। এই আমানতের অর্থাৎ, ভোটাধিকারের পবিত্রতা রক্ষায়  প্রতিটি ভোটার অত্যন্ত সচেতন ও সজাগ হবেন-এটাই আজ জাতির বিবেক ও সত্যানুসন্ধিৎসুদের একান্ত কামনা। ভোটাধিকারের পবিত্রতা রক্ষা করাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জরুরি কাজ।

মুক্তির সঙিন যুব শক্তি হও আগুয়ান

এসেছে ফাল্গুন নিয়ে আহ্বান -
মুক্তির সঙিন যুব শক্তি হও আগুয়ান

সংলাপ ॥ জাগো যুব সম্প্রদায় জাগো। নেশাগ্রস্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে। আর কত ঘুমাবে! বাংলার আকাশে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা। ধর্মের নামে অধর্ম, রাজনীতির নামে এক শ্রেণীর রাজনীতিকদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে উন্মাদনা, বিদেশীদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাংলাকে বাঁচাতে - সামাজিক পরিবর্তনে মূল কাণ্ডারি যুব সম্প্রদায় - আগামী প্রজন্মের আলোর দিশারীদেরকে নেশাগ্রস্ত রাজনীতির ঘুম ভেঙে বাংলা মায়ের আহ্বানে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মুক্তির জয়গান গেয়ে। সময় আজ দ্বারপ্রান্তে।
পরীক্ষিত, যুব সমাজের সার্বিক উন্নতি ছাড়া এদেশে উন্নতি হতে পারে না। সেইজন্যে যুব সমাজের উত্থান সময়ের দাবী। দারিদ্র, অজ্ঞতা আর রাজনীতিকদের নিপীড়নে হতবিহ্বল গণমানুষকে বাঁচাতে যুব সমাজের হৃদয় প্রসারিত হোক, মুক্তির চিন্তায় বিভোর হোক- সহানুভূতির ডালা নিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ুক সব বাধা অতিক্রম করে - এটাই সময়ের আহ্বান।
ভাবতে অবাক লাগে, যে যুব শক্তিকে জাতি সালাম জানিয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সমূহের জন্য, যে যুব শক্তি জাতির জন্যে জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছে - সেই যুব শক্তি নেতিবাচক ও ব্যর্থ কাজে জড়িয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। অল্প বয়সে জীবনের লক্ষ্য ও ব্রতকে পদদলিত করে কিভাবে নিজের এবং দেশের অমঙ্গল ডেকে আনছে রাজনৈতিক প্ররোচনায় হঠাৎ বড়লোক হওয়ার নেশায়।
রাজনীতিকরা বিপ্লব, পরিবর্তন, বিবর্তন, ধর্মযুদ্ধের কথা বলছে বাংলার মাটিতে - কিন্তু মুক্তির কথা বলছে না। সব রকমের মুক্তি পেতে হলে যুব সমাজের চিন্তা জগতের চিন্তাগুলোর পরিবর্তন কার্যক্রম প্রণয়ন করে মুক্তির পথে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এর জন্য অধ্যাত্মবিদ্যায় স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে কারণ বাংলার মাটি-বাতাস-পানি আধ্যাত্মিকতায়?ভরপুর। ১৪১৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে যুবসমাজের শক্তি দেশ তথা বিশ্ববাসীকে সে কথাই আবারো নতুন করে জানিয়ে দিয়েছে।  
রাজনীতিকরা নিজ ও দলীয় স্বার্থে যুব সমাজকে বাধ্য করেছে এবং করছে বিদেশী সংস্কৃতির মধ্যে হাবুডুবু খেতে। জীবন চলার পথে ওই বিদেশী সংস্কৃতি প্রবাহিত করতে গিয়ে আজ যুব সমাজ দূষিত। বাংলার মাটির ঐতিহ্য হলো কর্মের মাঝে আধ্যাত্মিকতা।
সেই আধ্যাত্মিকতা যুব সমাজ ভুলতে বসেছে এবং নিজস্ব সংস্কৃতিহীন জীবন ধারায় জীবন চলার পথ বেছে নিয়েছে। সময় এসেছে, বতর্মান সরকারের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব যুব সমাজকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে ঐতিহ্যবাহী বাংলার সহজ-সরল পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রেরণা দেয়া। যুব শক্তিই রূপান্তর ঘটাবে দূষিত পরিবেশকে। যুব শক্তিকে অনুপ্রাণিত করতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শপথ নেয়ার জন্য এবং সমাজ পরিবর্তনে সরকারকে মদদ যোগাতে হবে।
অনেক দেরী হয়ে গেছে। এসেছে আর একটি ফাল্গুন। সরকারকে সব ভুল শুধরিয়ে যুব শক্তির পিছনে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়াতে হবে যাতে যুবশক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, চিন্তাজগতের প্রসারতা বাড়িয়ে, দেশের সামগ্রিক উন্নতি সাধন করতে পারে।
যুব সমাজের এক অংশ বিভিন্নরকম নেশায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। নেতিবাচকতায় আবদ্ধ হয়ে গেছে। সুস্থ চিন্তা ও স্বাস্থ্যকে হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মিথ্যাচার যুব শক্তির অন্য এক অংশকে হিংসা, লোভ ও ক্রোধের  বন্ধু হতে সহায়তা করছে। তাদের মধ্যে নতুন করে মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করতে সরকারকে শপথ নিতে হবে, যুব সমাজকে লক্ষ্য অর্জনে কাণ্ডারি হতে হবে সার্বিক সহযোগিতার জন্য উন্নয়নের পথে।

সময় এসেছে সরকারের, সব মহৎকাজে যুব শক্তিকে ফিরিয়ে আনতে দৃঢ় হবার। যুব সমাজ এক জলন্ত মোমবাতি। বাংলার মানুষ ওই শক্তিকে আজও অনুস্মরণ করে-অনেক কিছু আশা করে। সরকার তাদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করলে অধিকার পাওয়া যাবেই। যুব সমাজের আলোতেই আছে অগ্রগতি ও উন্নতি - দেশ ও জাতির উন্নয়নের ও পরিবর্তনের মূল কথা। কর্মের মাঝে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়াচ লাগলে ঘরে ঘরে আবার জয়ধ্বনি উঠবে এবং সেই জয়গানে বাংলার আকাশ বাতাস মোহিত হয়ে শান্তির পরশ আনবে।

গণতন্ত্রের জন্য বিএনপির মায়াকান্না

গণতন্ত্রের জন্য বিএনপির মায়াকান্না

আল্লামা সাদেক নূরী ॥ গণতন্ত্র জনগণ দ্বারা জনগণ থেকে জনগণ কল্যাণে নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা; আপাততঃ এটাই গণতন্ত্রের সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা। এ হিসাবে নির্বাচন ও গণতন্ত্র একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। অতএব নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র ভাবনা আকাশ কুসুম রচনা বা ডুমুরের ফুল বাসনা। কারণ, নির্বাচনের বিরোধিতা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রেরই বিরোধিতা।
এমতাবস্থায়, নির্বাচনের বিরোধিতা শুধু নয়, নির্বাচন প্রতিহত করার সরাসরি অগণতান্ত্রিক ঘোষণা দিয়ে তা প্রতিরোধ করার নামে ভোটকেন্দ্র ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, বোমা মেরে নিরীহ জনগণ হত্যা, অসংখ্য গাছ কেঁটে দেশের সম্পদ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করাসহ জাতীয় সম্পদ ধ্বংস ও উন্নয়নে বাঁধা সৃষ্টির তাণ্ডবে লিপ্ত থেকে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো কোন্‌ গণতন্ত্র? কার জন্য? এটাকে যদি দেশবাসী মায়ের সন্তান বধ করে মাসীর মায়াকান্না মনে করেন তা' হলে কি কারো অস্বীকার করার উপায় আছে?
প্রসঙ্গটা এলো সম্প্রতি বিএনপির কথিত মুখপাত্র'র মুখে গণতন্ত্র'র ঢেঁকুর দেখে; তিনি আওড়ালেন - এক তরফা নির্বাচন করে সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ‘গণতন্ত্র'কে উপেক্ষা করেছে। অবশেষে, মেজর জিয়া যেমন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে অগত্যা রাজি হয়েছিলেন, সে ধারাবাহিকতায় ঠেলায় পড়ে, বি.এন.পি শেষ রক্ষাকবয হিসাবে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের দোহাই তথা আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে, এটাও শুভ লক্ষণই বটে।
সে যা' হোক, এখানে আলোচ্য মন্তব্যে মুখপাত্র ‘একতরফা' বলতে ‘মুক্তিযুদ্ধের তরফ' বুঝিয়ে থাকলে মন্তব্যটি প্রায় সত্য বলে ধরে নেয়া যায়। কারণ, বিগত নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধে'র তরফের দলগুলোই প্রধানতঃ অংশগ্রহণ করেছে ; অপর তরফে রয়েছে প্রধানতঃ জোর করে জড়িত করা মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়ার বিএনপির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধী দলগুলো, তথা ৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী সপ্তম নৌবহরের মাঝিমাল্লা আর যাত্রীরা।
এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতার পক্ষ জনতার স্বাভাবিক প্রশ্ন- যারা নির্বাচনের বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল তারা কি আসলেই গণতন্ত্র চায় বা গণতন্ত্র মানে? নাকি তারা গণতন্ত্র'র আবরণে ৭১-এর স্বাধীনতার বিরোধিতায় পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসাবে এক সাগর রক্ত, সম্ভ্রম ও বিরল আত্মোৎসর্গ'র বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে?
বিরোধীদের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার প্রশ্ন ! সে বিচার তো হতে হবে, নির্বাচন সম্পন্ন হবার পর। এ ব্যাপারে নির্বাচনপূর্ব মন্তব্য ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার শামিল নয় কি? নির্বাচনের পর তো এর সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গটি নির্বাচনবিরোধী সন্ত্রাসে বিএনপি'র চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ণয়ে বিএনপি নেত্রীর সাম্প্রতিক দু'টি ঈপ্সা যথেষ্ঠ সহায়ক হতে পারে; ১। একটি মার্কিন প্রত্রিকায় নিবন্ধ'র মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ কামনা এবং ২। দেশের সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে জড়িত করার অগণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা।
১৫৩ সাংসদদের এর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন? গণতন্ত্র'র বিশ্ব স্বীকৃত বিধি নিয়ম অনুসারে এঁরাতো সর্ব সম্মতভাবে নির্বাচিতই বটে। এ প্রসঙ্গে কারো কারো ভোট দিতে না পারার অভিযোগ? এটা কেবল যারা ভোট দেয় নি, বা তাতে বাঁধা প্রদান করেছেন, কেবল তাদের উপরই বর্তায়।

অতএব, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক বিচারে দশম জাতীয় সংসদ ও এর দ্বারা গঠিত সরকার সম্পূর্ণ বৈধ; এটাকে অবৈধ বলা গণতন্ত্র ও সংবিধানকে উপেক্ষা করা বই  নয়; বরং রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিলই বটে।

সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে নির্বাচন ছিল ফরজঃ তথ্যমন্ত্রী

সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত 
রাখতে নির্বাচন ছিল ফরজঃ তথ্যমন্ত্রী

সংলাপ ॥ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘সাংবিধানিক ধারা ধরে রাখতে না পারলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়। সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখাই হচ্ছে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। জঙ্গিবাদ বর্জন এবং সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতৃত্ব দরকার।
গত শনিবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দেয়া এক সংবর্ধনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ভান্ডারিয়া ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এ সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে দশম জাতীয় নির্বাচন ছিল ফরজ। নির্বাচনের আগে অনেকেই নানা কথা বলেছিলেন। কেউ ধারণা করেছিলেন, সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) বুঝে ছিলেন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচনের বিকল্প নেই। আর তা বুঝেই তিনি শেখ হাসিনার নির্বাচন কালীন সরকার ও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
তার বক্তব্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে ইনু বলেন, জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে তিনি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছেন। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় যে কয়েকজন ছাত্রনেতা জাতীয়তাবাদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ছিলেন অন্যতম। সাংবাদিক হিসেবেও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বস্তুনিষ্ঠতা, পরিমিতিবোধ এবং সঠিক তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতা করেছেন।

সংবর্ধনার জবাবে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি এক নয়। স্বাধীনতার আগে আমরা  যে স্বপ্ন দেখেছি তা এখন বাস্তবায়ন করা প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু উন্নয়ন ও দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এদেশের মানুষ তার অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে। তাদের স্বপ্ন আশা পূরণ হবে। তারা নিরাপদ এবং সুখে শান্তিতে বাস করবে।

মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার রায় হয়নি

মেজর জেনারেল মঞ্জুর
হত্যা মামলার রায় হয়নি

সংলাপ ॥  গত ১০ ফেব্রুয়ারি  মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর (বীরউত্তম)'র হত্যা মামলার রায় ঘোষণার কথা থাকলেও হয়নি। এ মামলায় আরো যুক্তিতর্কের জন্য নতুন তারিখ ধার্য হয়েছে আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯ বছর ধরে চলমান এ মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, ১৯৮১ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। বিমান বাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দিন এ মামলায় দেয়া এক জবানবন্দিতে বলেছেন, এরশাদের নির্দেশে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। তিনিসহ এ মামলায় পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন দায়িত্বশীল ও সংশ্লিষ্ট ২৮ জন কর্মকর্তা ও সদস্যকে সাক্ষী করা হয়েছে।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, বেশির ভাগ সাক্ষীর জবানবন্দিতে এসেছে, এরশাদের নির্দেশেই মঞ্জুরকে হাটহাজারী থানার পুলিশ হেফাজত থেকে সেনা হেফাজতে নেয়া হয়েছিল। তাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে ১৯৮১ সালের ১ জুন মধ্যরাতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয়।
মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, মঞ্জুর হত্যার দুই দিন আগে, ৩০ মে (১৯৮১) ভোররাতে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। তখন চট্টগ্রামে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) ছিলেন এম এ মঞ্জুর। তিনি ১ জুন স্ত্রী-সন্তান এবং অনুগত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে সেনানিবাস ছাড়েন।
তখন জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে ছিলেন তার নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর মো. রেজাউল করিম, যিনি মেজর রেজা নামে পরিচিত। মঞ্জুরের সঙ্গে তিনিও আটক হয়েছিলেন। মেজর রেজার জবানবন্দি অনুযায়ী, সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে তারা ফটিকছড়ির রাস্তার দিকে রওনা হন। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এক চা-বাগানের ভেতরে একটি বাড়িতে ওঠেন। পরে ওই বাড়িটি পুলিশ ঘেরাও করলে মঞ্জুর ও মেজর রেজা আত্মসমর্পণ করেন। পরিবারের সদস্যদেরসহ তাদের হাটহাজারী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আসামি মেজর (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) কাজী এমদাদুল হক, সাক্ষী মেজর রেজা ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের জবানবন্দি ও সাক্ষ্য অনুযায়ী ১ জুন সন্ধ্যার পরে মঞ্জুরকে হাটহাজারী থানায় নেয়া হয়। পরে ব্রিগেডিয়ার আবদুল লতিফ (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান হন) ও ব্রিগেডিয়ার এ কে এম আজিজুল ইসলামের নির্দেশে ক্যাপ্টেন এমদাদ রাত সাড়ে আটটার দিকে হাটহাজারী থানায় যান। তিনি মঞ্জুর, তার স্ত্রী-সন্তান ও মেজর রেজাকে পৃথক গাড়িতে তুলে সেনানিবাসে নিয়ে যান। জেনারেল মঞ্জুরকে হাত ও চোখ বেঁধে মেজর এমদাদের গাড়িতে তোলা হয়।
ওই গাড়িতে থাকা সুবেদার আশরাফ উদ্দীনসহ আরও কয়েকজন সেনাসদস্য জবানবন্দিতে বলেন, মঞ্জুরকে নিয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে তারা সেনানিবাসে প্রবেশ করেন। পরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মঞ্জুরের লাশের ময়নাতদন্ত করেন চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসক কর্ণেল এ জেড তোফায়েল আহমদ। সাক্ষী হিসেবে দেয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ময়নাতদন্তে মঞ্জুরের মাথার ডান দিকে পেছনে একটি বুলেটের আঘাত দেখতে পান। তার শরীরে আর কোনো জখমের চিহ্ন ছিল না।
এ মামলার সাক্ষী চট্টগ্রাম পুলিশের তৎকালীন উপকমিশনার আলী মোহাম্মদ ইকবাল জবানবন্দিতে বলেছেন, হাটহাজারী থানা থেকে সেনা সদস্যরা মঞ্জুরকে নিতে গেলে তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডেন্ট ব্রিগেডিয়ার আজিজকে টেলিফোন করেন। তখন আজিজ জানান, সেনাপ্রধানের (এরশাদ) নির্দেশক্রমে মঞ্জুরসহ আটক করা ব্যক্তিদের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের জন্য তিনি ও ব্রিগেডিয়ার লতিফ ক্যাপ্টেন এমদাদকে পাঠিয়েছেন।
পরে আসামি এমদাদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ব্রিগেডিয়ার লতিফ ও আজিজের নির্দেশে তিনি মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে আসেন এবং পরে হত্যা করা হয়।
মঞ্জুরকে হত্যার পর প্রচার করা হয় যে সেনানিবাসে নেয়ার পর একদল উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু এ মামলায় যেসব সেনাসদস্য জবানবন্দি দিয়েছেন, তাদের কেউ উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্যের কথা বলেননি।
বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দিন পরবর্তী সময়ে এ মামলায় সাক্ষী হিসেবে দেয়া জবানবন্দিতে মঞ্জুরকে হত্যার জন্য সরাসরি এরশাদকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ১ জুন বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তিনি বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের অফিসে ছিলেন। তখন সেখানে জেনারেল এরশাদও ছিলেন। এ সময় টেলিফোন আসে। রাষ্ট্রপতি টেলিফোন রেখে জানান যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। এ খবর শুনে জেনারেল এরশাদ চেয়ার থেকে উঠে রাষ্ট্রপতির লাল টেলিফোন দিয়ে কাউকে ফোন করে বলেন, ‘মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করেছে, তাকে শিগগির নিয়ে আসো এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করো।' তখন সদরউদ্দিন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে এরশাদ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এয়ার চিফ, আপনি কিছুই বোঝেন না।'
সদরউদ্দিন বলেন, তিনি ও তৎকালীন আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়া অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে বলেন, যেন মঞ্জুরকে বেসামরিক হেফাজতে রাখা হয় এবং বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে এরশাদের দীর্ঘ বাদানুবাদ হয়। পরে এরশাদের পরামর্শে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত দেন।
সদরউদ্দিন আরও বলেন, ২ জুন রাত দেড়টা থেকে দুইটায় তিনি মঞ্জুরকে হত্যার খবর পান। পরদিন সকালে তিনি এরশাদকে টেলিফোন করে বলেন, ‘এরশাদ সাহেব, আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন? এইটা কিন্তু ভালো করলেন না।' জবাবে এরশাদ বলেছেন, ‘বিক্ষুব্ধ সৈনিকেরা তাকে হত্যা করেছে।'
এ ঘটনার ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুরের ভাই আইনজীবী আবুল মনসুর আহমেদ চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। ওই বছরের ২৭ জুন এরশাদসহ পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অভিযোগপত্র ভুক্ত বাকি আসামিরা হলেন মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল লতিফ,  মেজর কাজী এমদাদুল হক,  লে. কর্ণেল শামসুর রহমান শামস ও লে. কর্ণেল মোস্তফা কামাল উদ্দিন। ব্রিগেডিয়ার আজিজ ও নায়েক সুবেদার আবদুল মালেক মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে তাদের আসামি করা হয়নি।
ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ মামলার বিচার চলছে। আদালতের সর্বশেষ আদেশ অনুযায়ী,  ১০ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায় ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে গত ২৯ জানুয়ারি বিচারক পদে রদবদল করা হয়। ফলে এই রায় ঘোষণা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।

বিএনপির করুণ দশায় হতাশ ‘ইকোনমিস্ট'

বিএনপির করুণ দশায় হতাশ ‘ইকোনমিস্ট'

সংলাপ  ॥  জামায়াতের সঙ্গী দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি বর্তমানে প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করা কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরকার পতনের আন্দোলন-কোন কিছুতেই দলটি ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ দলের নেতাকর্মীরাই কোন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন না। গত শুক্রবার ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণে ‘ক্রাইম এ্যান্ড পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ, বাং বাং ক্লাব' শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি গত শনিবার প্রিন্ট সংস্করণে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে বেশ খোশ মেজাজেই আছেন। প্রধান বিরোধীদল বিএনপির  নেতৃত্বে জামাতসহ পুরো ১৮ দলীয় জোটের বর্জন করা গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একতরফাভাবে জয়ী হয়েছে তার দল আওয়ামী লীগ। পশ্চিমা বিশ্বসহ বাংলাদেশের দাতাদেশ এবং পর্যবেক্ষক দেশগুলো একযোগে তখন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নির্বাচন বর্জন করেছিল। তখন সমগ্র আন্তর্জাতিক বিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও বর্তমানে উন্নত দেশগুলো শর্তসাপেক্ষে আরও পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পক্ষে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এমনকি ব্রিটেন এবং আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচনে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ, যা বর্তমান সরকারকে বেশ সুবিধাজনক স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ এবং বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘বিশেষ কাছের বন্ধু' ভারতও বেশ সন্তুষ্ট। জানুয়ারির নির্বাচনকেও সে সময় একমাত্র ভারত সরকারই স্বীকৃতি দিয়েছিল। ভারতের রাজধানী দিল্লীতে এক অনুষ্ঠানে দেশটির কূটনৈতিক নীতি-নির্ধারকরা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাই ভারত সরকার বাংলাদেশে এমন কোন দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না যারা ইসলামের নীতি ‘অনুসরণ' করে, বিশেষ করে ভারতের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী  দেশ পাকিস্তানের ‘বন্ধু' দল হিসেবে খ্যাত হলে তো নয়ই। পাশাপাশি, জীবিকা অর্জনের উদ্দেশে ভারতে যাওয়া অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা কমাতেও বদ্ধপরিকর ভারত সরকার।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতের ‘বন্ধুপ্রতিম' শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও ভারত সরকারের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছে। এই লক্ষ্যেই নিজ দেশের বিরোধী দলগুলোকে রীতিমতো চিড়েচ্যাপটা করার জন্য যা কিছু করতে হয় তার সব কিছু করছে সরকার। আর একটি গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রকে অসুস্থ করে ফেলার জন্য এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট। কিন্তু এর পরেও বর্তমানে শান্ত হয়ে আছে দেশটির বিরোধী দল। কৌশলীপন্থা অবলম্বনের জন্য আপাতত বেশ কিছুদিন শান্ত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন দলটি। আদালতের ঝামেলা শেষ হওয়ার পর ভেতর থেকে দলকে সংগঠিত করে সংসদে ফিরে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে আবারও ফিরে আসবে রাজপথে।
১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা সম্পর্কে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালের এপ্রিলে দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বন্দর থেকে খালাসের সময় পুলিশ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রবোঝাই একটি চালান আটক করেছিল। চালানটিতে রাইফেল, সাইলেনারসমেত সাবমেশিনগান, ২৫ হাজার হ্যান্ড গ্রেনেডসহ চীনে তৈরি প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ছিল।
ধারণা করা হয়, ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সহায়তায় অন্ত্রের চালানটি বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অশান্ত আসাম রাজ্যে বিদ্রোহের সময় ব্যবহারের জন্য অস্ত্রগুলো আনার সময় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রের চালানটি আটক করা হয়।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের পর বছর চলে গেলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা মোটামুটি থমকে ছিল। অস্ত্রের চালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তখন চিহ্নিত করা হয়নি। দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়া এ অস্ত্রসংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে তখন খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল এবং বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই ২০০৯ সালে এই অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি এ বিচারের রায়ে অস্ত্রো্রপাচারের দায়ে অভিযুক্ত ১৪ আসামির মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের অধিকাংশ ব্যক্তিই বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।
ইকোনমিস্ট মনে করে, উচ্চ আদালতের দেয়া এ রায় রাজনৈতিক দিকসহ আইনি দিক থেকেও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এ অভিযোগের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে খালেদা জিয়ার ছেলে এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামও। নিজ দেশে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত কয়েকটি মামলার জের ধরে বর্তমানে লন্ডনে বাস করলেও দলের পরবর্তী নেতা হিসেবে তাকেই মান্য করেন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই তারেক রহমানেরই এক তোষামোদকারী নেতা এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, যিনি অস্ত্রের চালানের বিষয়ে আগে থেকে সবকিছুই জানতেন।
মৃতুদন্ডপ্রাপ্ত বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান, বাংলাদেশী গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন এক শীর্ষ কর্মকর্তা, আসামের এক বিদ্রোহী পলাতক নেতা যিনি একই সঙ্গে ভারত সরকারের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকাভুক্ত এবং এছাড়াও আরও অনেকে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের তালিকায় মতিউর রহমান নিজামীর নামও উল্লেখযোগ্য। নিজামী বাংলাদেশের বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধী দেশ পাকিস্তানকে সহায়তার অভিযোগে এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে পৃথক মামলায় ইতোমধ্যে এই নেতার শুনানি বিচারাধীন আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই মামলাতেও দ্বিতীয়বার তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হতে পারে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্রপাচারের মামলায় দলটির অভিযুক্ত সদস্যদের মৃত্যুদন্ডের রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা অব্যাহত রেখেছেন তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচী। কিন্তু রাজপথে আন্দোলনের নামে সহিংস কর্মকান্ডের জন্য এই দলটি বেশ কুখ্যাত হলেও বিগত কয়েক মাস ধরে সহিংসতা সৃষ্টিতে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাঙালিত্বের জাগরণ জরুরি

বাঙালিত্বের জাগরণ জরুরি

শেখ বর্ষা ॥ শুরু হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। স্মরণ করতে হয়, সেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি অতুল প্রসাদ সেন গেয়ে উঠেছিলেন 'মোদের গরব, মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা, তোমার বুকে তোমার বুলে কতই শান্তি ভালোবাসা'। অথচ আজ এদেশেরই তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত মানুষদের মধ্যে বাংলা ভাষার চাইতে ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ বেশি দেখা যায়, ছেলেমেয়ের বিবাহ-অনুষ্ঠানের কার্ডটি ইংরেজিতে ছাপিয়েই নিজেকে সমাজের 'নামি-দামি মানুষ' হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে আবারো শুরু হয়েছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি, কড়া নাড়ছে ফাগুন মাস। বাংলা এখন  বিশ্বের তিন তিনটি দেশের-বাংলাদেশ, ভারত ও সিয়েরালিয়নের দাফতরিক ভাষা, বিশ্বের কমবেশি ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষার এখন বাংলা, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, মেঘালয়, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লিসহ বিভিন্ন রাজ্যের অসংখ্য মানুষ বাংলায় কথা বলে-এসব কথা ঠিক, কিন্তু এদেশের স্বাধীনতার সুফলভোগকারী একটি গোষ্ঠির মধ্যে বাংলার প্রতি অবজ্ঞা ও ইংরেজিপ্রীতি যেভাবে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে সে ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে না পারলে দেশকে কখনোই এগিয়ে নিয়ে যাবে না কি-না সে ব্যাপারে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বাঙালি জনগোষ্ঠী আজ হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে, দূরপ্রাচ্য থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া-আফ্রিকায়, কিন্তু বাংলাদেশের একটি ব্যাপক জনগোষ্ঠী যে এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সমাজে ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীর আস্ফালনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন দেশ প্রতিষ্ঠা যে এখনো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি তা বলাই বাহুল্য। নিঃসন্দেহে এর বড় কারণ দেশে একটি অশুভ চক্র এখনো সক্রিয়, যা পরিপুষ্ট হয়েছে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টের পর। এই অশুভ শক্তিই এদেশের মানুষকে তাদের বাঙালি পরিচয় ভুলিয়ে দিতে চায়, বাংলাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ইংরেজীর প্রতি আকৃষ্ট করে রাখতে চায়। কিন্তু নিজের দেশ, নিজের ভাষা ও নিজের সংস্কৃতিকে ভালো না বাসলে কেউই প্রকৃত অর্থে বড় হতে পারে না, সেকথাটিও আজ তারা হয়তো ভুলে থাকতে বা ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। আর এজন্যই  'বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ' -মহাপুরুষ গুরুসদয় দত্তের এই মহাবাণীটি তাই আজ আবারো সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার সময় এসেছে।
এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় নিয়ে গত ১৯শে মাঘ শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে দেশকে গড়ে তুলতে সামনে পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। এদিকে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১লা ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করে বলেছেন, 'বাংলাদেশে অশুভ শক্তির কোনো স্থান হবে না। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি শান্তিকামী দেশ'। প্রধানমন্ত্রী আরও বেশি করে বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতির্চ্চার আহবান জানিয়ে বলেন, অশুভ শক্তি প্রতিরোধে সমাজের প্রতিটি স্তরে জাতীয়তাবাদী চেতনার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। একুশের গ্রন্থমেলাকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রেরণার উৎস হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, লেখক, প্রকাশক ও নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনার বিকাশে এই মেলার অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে এবং এখান থেকে তারা ভবিষ্যতের সঠিক দিকনির্দেশনা লাভ করেন। তিনি বলেন, এই বছরই বইমেলার পরিধি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে। এর লক্ষ্য, এই ঐতিহাসিক স্থানকে জাতির সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত করা। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দু'দিনব্যাপী জাতীয় কবিতা উৎসব, যার প্রতিপাদ্য ছিল 'কবিতা সহেনা দানব যন্ত্রনা'। এর উদ্বোধনের পর কবি সৈয়দ শামসুল হক তার বক্তৃতায় বলেন, এখনো দেশে দানব রয়েছে। তাদের যাতনা থেকে মুক্ত হতে হলে কবি-সাহিত্যিকদের মিলিত হতে হবে। সুন্দর ও সত্যেও পক্ষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও অস্ত্র চোরাচালানী ১৪ জনের ফাঁসিতে জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই শুভদিনকে ত্বরান্বিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে; যাতে পরাজিত শক্তি আবার মাথাচাড়া দিতে না পারে। উৎসবে বক্তৃতা পর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানানো হয়।
তাই নতুন দিনের আলোকে বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদের আত্মার প্রতি সম্মান জানাতে হলে দেশ থেকে অশুভ শক্তি নির্মূলে ইস্পাতকঠিন শপথ নিতে হবে। এই অশুভ শক্তি সক্রিয় রয়েছে সমাজের সর্বস্তরে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ছদ্মবেশে। তাদেরকে চিহ্নিত করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে ইংরেজি, হিন্দী এমনকি আরবীর প্রতি অন্ধমোহগ্রস্ত হয়ে যারা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করছে তাদেরকে সঠিক পথে আনতে হবে। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) নিজের মাতৃভাষা আরবীকে যেভাবে ভালোবাসতেন, নিজের আরব পরিচয়কে যেভাবে সম্মান করতেন তার অনুসারী হতে হলে আমাদের মাতৃভাষাকে বাংলাকেও সেভাবে সম্মান ও ভালোবাসার শিক্ষা সবাইকে দিতে হবে। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে একজন খাঁটি মুসলিম হতে গেলে সবার আগে যে একজন খাঁটি বাঙালি হতে হবে- এই সত্য (হাক্কানী) কথাটুকু সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাঙালিত্বের জাগরণ দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আর দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলেও এই জাগরণই একমাত্র পথ।

বাংলার মানুষ ও মাটির ভাষা বুঝতে না পারলে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না

বাংলার মানুষ ও মাটির ভাষা বুঝতে না পারলে
রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না

দিগন্ত ॥ বাংলার মাটি এবং এর জনগণের ভাষা বুঝতে না পারলে এদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় যে রাজনৈতিক শক্তি এদেশের গণমানুষের সকল আশা-আকাঙ্খাকে ধূলিসাৎ করতে চেয়েছিল তাদের পরাজয়ের একটি মাত্র কারণই ছিল তারা এদেশের মানুষের ভাষা অর্থাৎ, চাওয়া-পাওয়াকে চায়নি। ইতিহাসের সেই একই ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঘটেছে এদেশে বিগত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল কয়েকমাস ধরে যেভাবে ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব চালায় তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, রাজনৈতিক কর্মসূচী  আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর্যায়ে ছিল না বরং তা রীতিমতো সন্ত্রাসে রূপ ধারণ করে। এ রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাস কার বিরুদ্ধে ছিল? আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, রেলগাড়ি, বাস, বেবিট্যাক্সি, রিক্সায় পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনগণের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট করা হয়। বিরোধী জোট যেন সারাদেশকেই ধ্বংসের শেষ সীমানায় নিয়ে যেতে চায়। এভাবেই যদি চলতে থাকতো তাহলে দেশের অবস্থা কি দাঁড়াতো? তারা সব ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে কেন এহেন আচরণ শুরু করেছিল? কেন সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল? এ প্রশ্নের কোন জবাবই তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এখন তারা আবার নির্বাচিত এবং বিশ্ব মহলের স্বীকৃত নতুন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। অথচ এ সরকারের আমলে উপজেলা নির্বাচনেও এখন তারা অংশ নিচ্ছে!
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ছিলো, নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই প্রধান বিরোধী দল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাও প্রদর্শন করেনি। তারা দিনের পর দিন সংসদের অধিবেশনে অনুপস্থিত থেকেছে, নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন থেকেও বিরত থেকেছে। বিএনপি-জামাত গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে সন্ত্রাসকেই তাদের অন্যতম প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। জামাতের সঙ্গে জোটবেঁধে তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতা চালাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল করতে অবরোধের নামে ট্রেনে আগুন লাগিয়ে ও লাইন উপড়ে ফেলে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করা হয়েছে। ঝরে গেছে অনেক অমূল্য জীবনও। এসব বিষয় রাজনীতির কোনো সংজ্ঞায়ই নির্ণীত হতে পারে না। হরতালে নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার যেসব চিত্র ফুটে উঠছে তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অতীত। জীবন্ত মানুষ দগ্ধ হয়েছে হরতালের আগুনে। তারপরও হরতাল আহ্বানকারীদের বিবেকবোধ জাগ্রত হয়নি ! প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হবে? কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে গণতন্ত্রের নামে এমন মর্মন্তুদ চিত্র অচিন্তনীয়।
জনগণই সর্বময় ক্ষমতার উৎস বলা আছে আমাদের সংবিধানে। অথচ পথেঘাটে, গ্রামেগঞ্জে জনগণকে হত্যা করা হচ্ছে। জনগণের ওই ক্ষমতায়নে কোনো রাজনৈতিক দলই আজ পর্যন্ত বাস্তবধর্মী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে অথবা আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণকে রাজনীতিকরা গিনিপিগ হিসেবে বারবার ব্যবহার করছে। একের পর এক ককটেল, টিয়ারশেল, গুলি, পেট্রোলবোমা মেরে, সিএনজিতে আগুন দিয়ে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে সাধারণ মানুষকে। গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে গণতন্ত্রপ্রেমীরা নিরীহ সাধারণ মানুষকে মেরেছে অনায়াসে। 

হরতাল অবরোধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে বিজিবির এক সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার কমপক্ষে ৬০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে শিশু নারী-পুরুষসহ প্রায় আড়াই হাজার। তারা দুই শতাধিক যানবাহনে আগুন ও এক হাজারের বেশি যানবাহন ভাঙ্‌চুর করেছে। রেলে নাশকতার সংখ্যা প্রায় ২শ'। বিভিন্ন স্থানে একের পর এক নৈরাজ্যের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। হানাদার বাহিনীর আদলে জামাত-শিবিরের তাণ্ডবে ধ্বংস করা হয়েছে দেশের রেলপথ, সড়কপথ। ইতিহাস বলে, গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য, সাম্য-ন্যায়বিচার-স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে যে রক্ত ঝরেছে, সেখানে নিরীহ মানুষকে কখনো লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। যাঁরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন; তাঁরাই অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। আজকের দিনের মতো তাঁরা অন্যের জীবন কেড়ে নেননি। বরং আন্দোলনকারীরা সর্বদা নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যকে জীবন দান করেছেন। মানব ঢাল হয়ে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করেছেন। অথচ আমাদের দেশে গণতন্ত্র রক্ষার নামে যে আন্দোলন হচ্ছে,  সেখানে আন্দোলনকারীরা সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে পুড়িয়ে  মেরেছে, হত্যা করেছে। সন্ত্রাস-ত্রাসের রাজত্ব কায়েমই তাদের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত, সেই খুনি-সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে আন্দোলনকারীকেই সর্বপ্রথম গণতন্ত্রমনা হতে হবে। গণতন্ত্রপ্রেমীদের গণমানুষের ভাষা বুঝতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সফলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে, গণমানুষের ভালোবাসা অর্জন। নিরীহ মানুষকে হত্যা করে নয়, নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দেয়ার মনসিকতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির পক্ষেই কেবল সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইতিহাস বলে, খুনিরা কখনো গণতন্ত্রের সৈনিক হতে পারে না। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা যায়। কিন্তু কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। একাত্তরের ঘাতক-দালালসহ পরাজিত কোনো শক্তিকে বাঁচাতে গেলে জনগণের ভাষা, বাংলার মাটির গন্ধ বোঝা কখনোই সম্ভব নয় এবং এই জাতীয় কোনো শক্তি বাংলার মাটিতে কখনো ঠাঁই পাবেনা-এই সত্যটুকু যত তাড়াতাড়ি তারা বুঝতে পারবে-ততই মঙ্গল।

২০১৩'র গণজাগরণ মঞ্চ ও ১৯৬৯'র গণঅভ্যুত্থান একই সূত্রে গাঁথা

২০১৩'র গণজাগরণ মঞ্চ ও ১৯৬৯'র 
গণঅভ্যুত্থান একই সূত্রে গাঁথা

সংলাপ ॥ ২০১৩ এর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ও '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জাতির ইতিহাসে একই সূত্রে গাঁথা যা বাঙালিকে আত্ম পরিচয়ের সন্ধানে অনুপ্রাণিত করবে বারবার। ২০১৩ এর ৫ ফেব্রুয়ারি শাহ্বাগের গণজারণ মঞ্চের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যে জাগরণ নতুন করে সৃষ্টি হয়েছিলো তার প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার শাহবাগে আবারো বসছে ছাত্র-জনতার মহাসমাবেশ। এদিকে  ১৯৬৯ এর মহান গণঅভ্যুত্থানের ৪৫ তম বার্ষিকী পার হলো গত ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার। এদিন শহীদ মতিউরের স্বজনেরা এসেছিলেন নবকুমার ইনস্টিটিউশনে, এসেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলামসহ অনেকেই বাঙালির ইতিহাসের এই দিনটিকে স্মরণ করতে, শহীদদেরেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ আব্দুল হালিমসহ সকল শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী। সেই দিনটি বাঙালি জাতির আত্মশক্তি ও আত্মদর্শন প্রকাশের এক অবিস্মরণীয় দিন। '৬৬-র বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং পরবর্তীতে তৎকালীন ছাত্রসমাজের ১১-দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় '৬৯-এর ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা  হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) শাখার সভাপতি আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদ। তৎকালীন ঢাকা জেলার নরসিংদির হাতিরদিয়ায় ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণকারী আসাদ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের, একই সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় আইন মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ এর মৃত্যুর ৪ দিন পর সারা পূর্ব বাংলায় সংগঠিত হয় গণঅভ্যুত্থান, যার ফলশ্রুতিতে কিছুদিনের মধ্যে পতন ঘটে দোর্দন্ড প্রতাপশালী সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের। কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে তৎকালীন পত্র পত্রিকায় জানা যায়, পূর্বঘোষিত হরতালে ২৪ জানুয়ারী ঢাকা শহর মানুষে মানুষে প্লাবন ডেকে আনে। হরতাল পূর্ণভাবে সফল হয়। নগরীতে সেনাবাহিনীও তলব করা হয়। সচিবালয়ের সামনে পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হয় প্রথমে ছাত্রকর্মী রুস্তম আলীকে, পরে স্কুলবালক (নবকুমার ইনস্টিটিউটের) কিশোর মতিউর রহমানকে। বৈদ্যুতিক তার বেয়ে মানুষ সচিবালয়ের এয়ার কন্ডিশনারের বাঙ ভাঙতে যাচ্ছে। গুলি খেয়ে সেই তার থেকে ছিটকে পড়ছে একজন। আর তা দেখে কিন্তু কেউ থামছে না। আরেকজন উঠছে। এতটা উন্মত্ত ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে লড়াকু জনতা।
সমগ্র নগরী এক অভূতপূব শিহরণে জেগে উঠে। ছাত্র-জনতার মধ্যে এমন একটা লড়াকু মনোভাব জাগ্রত হয়ে উঠে যে, তা যে কোনো সময় উচ্ছৃংখল হয়ে উঠতে পারে। নেতৃবৃন্দ জনতার এই অগ্নিমূর্তী দেখে ভয়াবহ কিছু ঘটনার আশংকায় (যা সামগ্রিকভাবে মূল আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে) ভাবিত করে তোলে।
লক্ষ লক্ষ মানুষ পল্টনে দুই শহীদের লাশ নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর অপেক্ষায়, আর ওই দিকে গভর্ণর হাউজে সেনাবাহিনী কামান-মেশিনগান তাক করে প্রস্তুত। যে কোনো সময় প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ ঘটে যেতে পারে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি করে এতটা অনুহুত রক্তাক্ত ও বিয়োগান্ত ঘটনা এড়ানো যায় তা সকলকেই চিন্তিত করে তুলেছিল। শহীদদের জানাজা শেষে দরুদ পড়তে পড়তে মিছিল এগিয়ে গেল ইকবাল হলের দিকে। সেখানে একের পর এক বক্তৃতা করলেন তোফায়েল আহমেদ, সাইফউদ্দিন মানিক, মাহবুব উল্লাহ। প্রবীণ ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানও সেখানে রুদ্ধ কন্ঠে লম্বা এক বক্তৃতা করলেন। এদিনই ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) সভাপতি সাইফ উদ্দিন মানিক ও মেননপন্থী সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ আত্মগোপন অবস্থা থেকে প্রকাশ্যে আসেন।
শহীদ মতিউরের পিতা এ সভায় বক্তৃতা করেন। তিনি উপস্থিত লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভকারীকে 'মতিউর' বলে ঘোষণা দেন। পরবর্তী কর্মসূচী দেয়ার জন্য ছাত্র-জনতার থেকে চাপ আসলে পরদিন ২৫ জানুয়ারিই আবার সর্বাত্মক হরতালের কথা ঘোষণা করা হয়।

আশার কথা হচ্ছে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের মধ্য দিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ আবারও চেতনা ফিরে পেয়েছে। একাত্তরের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের  মধ্য দিয়ে ধর্মব্যবসায়ীদের  রাজনীতির পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। '৬৯'র গণঅভুত্থান তাদেরকে সেই পথে এগিয়ে যেতে আত্মশক্তি অর্জনের পথ দেখাচ্ছে। ধর্মের নামে মিথ্যাচার করে যে সমাজে বেশিদিন টেকা যায় না সেটা জনগণ আবার বুঝে ফেলেছে। এ বাস্তবতাটুকু উপলব্ধি করে স্বাধীনতার চেতনার সপক্ষের  রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আমলা ও ব্যবসায়ীরা দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে মুক্তিযুদ্ধেও চেতনায় দেশ অবশ্যই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আর তা না হলে আরও অকৃতজ্ঞতা ও মিথ্যাচারের পরিণতি ভোগ করতে হবে জাতিকে। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ২০১৩ এর শাহবাগের গণজাগরণ একই সূত্রে গাথা।

সব দল এলেও জয়ের সম্ভাবনা ছিল আওয়ামী লীগেরই -

সব দল এলেও জয়ের সম্ভাবনা 
ছিল আওয়ামী লীগেরই -

সংলাপ ॥ সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে একটি মার্কিন সংস্থার জরিপের ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে মার্কিন নীতি-প্রচারক সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল পুরো বাংলাদেশে জরিপটি চালায়। বহুস্তর ভিত্তিতে দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে জরিপটি চালানো হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নিলে আওয়ামী লীগ ৪২.৭ শতাংশ ভোট পেত। ইউএসএআইডি ও ইউকেএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত 'নির্বাচনোত্তর পরিবেশ' দেশব্যাপী জরিপ ২০১৪-এর ফলাফল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে আসে গত রোববার।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করা হয়ঃ '৫ জানুয়ারির নির্বাচন যদি সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক হতো, তাহলে কোন রাজনৈতিক দলকে আপনি ভোট দিতেন?' মোট উত্তরদাতার ৪২.৭ শতাংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিত বলে জানান। বিএনপিকে ভোট দিতেন ৩৫ শতাংশ। সিদ্ধান্ত গোপন রাখতে চান ১০.৩ শতাংশ। জাতীয় পার্টির পক্ষে ৩.৬ শতাংশ।
নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেয়ার সুযোগ থাকলে ১.৬ শতাংশ উত্তরদাতা সে সুযোগ নিতেন। ভোটার উপস্থিতি ৪০.৭ শতাংশ।
সারাদেশের অংশগ্রহণকারীদের ২৩ শতাংশ ভোট দিতে গেছেন বলে জানান। ব্যালটে নির্বাচন হয়েছে শুধু এমন এলাকার ভোটারদের ৪০.৭ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। ভোট দিতে কেন যাননি এই প্রশ্নের উত্তরে ১৫ শতাংশ উত্তরদাতা ভোটার সাবেক বিরোধী জোটের 'বয়কট' সমর্থনের কথা জানিয়েছেন, ১৫ শতাংশ পছন্দের প্রার্থী না থাকার কথা বলেছেন, ১২ শতাংশ নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছেন। 'প্রহসনের নির্বাচন' তাই ভোট দিতে যাইনি, এমনটা বলেছেন ২.৭ শতাংশ উত্তরদাতা।
ভোট দেয়ার একটি প্রধান কারণ বলতে বলা হলে ৩৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, ভোটাধিকার প্রয়োগের ইচ্ছার কথা, ৩৫ শতাংশ বলছেন সুনাগরিকের দায়িত্ববোধের কথা, ১৯ শতাংশ বলেছেন পছন্দের দল বা প্রার্থীকে সমর্থনের কথা। ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাদের ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।

প্রধান সমস্যা

বাংলাদেশের প্রধান তিনটি সমস্যা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা (৭২ শতাংশ উত্তরদাতার মতে), দুর্নীতি (৪৩ শতাংশ) এবং অনুন্নত রাস্তাঘাটের (৩২ শতাংশ) কথা বেশি বলেছেন উত্তরদাতা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে তিনটি প্রধান সমস্যার অন্তত একটি বলে মনে করেন ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। ১০ শতাংশর বেশি মানুষ সংলাপ না হওয়াকে প্রধান সমস্যাত্রয়ীর একটি বলে মনে করেন না।

আশা-নিরাশার সমীকরণ

বাংলাদেশের 'বিষয়াদি' কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ঠিক নাকি ভুল পথে এমন প্রশ্নের জবাবে জানুয়ারির ১৪ তারিখের জরিপ অনুযায়ী ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন ঠিক দিকে, ৬৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন ভুল দিকে এবং ২ শতাংশ উত্তরদাতা নিশ্চিত নন। তবে দেশের গন্তব্য বিষয়ে মনোভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থকরা সাদা-কালোয় ভাগ হয়ে নেই। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ৫৩ শতাংশ মনে করেছেন দেশ সঠিক দিকে এগোচ্ছে। বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে এরকম মনে করার হার ৯ শতাংশ। দেশের চলমান বিষয়াদি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী দেখা গেছে বরিশাল বিভাগের অংশগ্রহণকারীদের (৪৫ শতাংশ)। সবচেয়ে কম আশাবাদী রাজশাহী বিভাগ থেকে অংশ নিয়েছেন যারা (১৮ শতাংশ)। 

আশাবাদী উত্তরদাতারা শিক্ষা খাতের উন্নয়নকে সবচেয়ে বেশি তাদের স্বস্থির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। ১০ শতাংশ জবাব প্রদানকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তাদের অন্যতম আশার কারণ মনে করছেন। যারা বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় দুর্গতি দেখছেন, তারা কারণ হিসেবে রাজনৈতিক সংঘাতকেই এগিয়ে রেখেছেন (৮৯ শতাংশ)। শতকরা ৪ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেও একটি কারণ মনে করছেন।  

ব্রিটেনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক আজিজুল হক ভূঁঞার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

ব্রিটেনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক
আজিজুল হক ভূঁঞার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি


শেখ উল্লাস ॥  বাঙালির বিপ্লবী চেতনার ধারক, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য এ্যাকশন কমিটিজ ফর দ্য পিপল্‌স্‌ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে-১৯৭১-এর আহবায়ক, সাপ্তাহিক চরমপত্র ও দৈনিক সুখবর-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক আজিজুল হক ভূঁঞা স্মরণে ২রা ফেব্রুয়ারি রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলার সেমিনার আলোচনা সভার আয়োজন করে বিলেতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ফোরাম। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ফোরামের সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, আজিজুল হক ভূঁঞার ছোট ভাই আনোয়ারুল হক ভূঁঞা, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী এবং জাতীয় নারী জোটের সমন্বয়ক আফরোজা রীণাসহ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিকবৃন্দ। বক্তারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তার স্মৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানান। এই স্মরণসভায় বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আজিজুল হক ভূঁঞা ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডে কর্মজীবন শুরু করেন এবং '৬৭ সালে গোষ্টারগ্রীণ স্কুল অব বিজনেস, এস্টোন, বার্মিংহাম, ইউকে থেকে এপ্লাইড ইকোনোমিঙ এবং মার্কেটিং-এ ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরেরই শেষ দিকে গ্রেড ব্রিটেনে ইষ্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট ( ইপিএলএফ) গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। '৬৮ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা মামলায় গ্রেফতার হলে তিনি ইংল্যান্ডে বাঙালি সম্প্রদায়কে একত্রিত করে বঙ্গবন্ধুর  পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে গ্রেড ব্রিটেনে গমন করলে বার্মিংহাম ডিকবেথ সিভিক হলে ইষ্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (ইপিএলএফ)-এর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে গণসম্বর্ধনা দেন। প্রায় এক দশক গোপণে কাজ করার পর ইপিএলএফ ১৯৭০ সালের শেষের দিকে প্রকাশ্য ঘোষণা দেয় স্বাধীনতার জন্য। ওই বছর ২৯ নভেম্বর বার্মিংহাম শহরে একটি পাবলিক মিটিং আহবান করে ইপিএলএফ। সেই সভায় পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রস্তা গৃহীত হয়। সেই সভায় কয়েক হাজার বাঙালির সমাগম হয়েছিল বলে উদ্যোক্তাদের অভিমত। সেই সভায় বক্তৃতা করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক নেতা তারিক আলী। সভার সভাপতি ও ইপিএলএফ-এর আহবায়ক আজিজুল হক ভূঁঞা অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতার আহবান জানিয়েছিলেন। এই সময় ইপিএলএফ-এর একটি মুখপত্রও বের হয়, এর নাম ছিল বিদ্রোহী বাংলা। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন সেলিম আহমেদ, এ ইসমাইল এবং দিপু। এ তিনটি নামই ছিল ছদ্মনাম। সেলিম আহমদ নামের আড়ালে কাজ করতেন সংগঠনের আহবায়ক আজিজুল হক ভূঁঞা। জয়বাংলা নামে বুলেটিন প্রকাশ করেন তারা ১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ। ৩রা এপ্রিল প্রকাশিত বুলেটিনের নাম ছিল স্বাধীন বাংলা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণের আগে থেকেই ব্রিটেনবাসী বাঙালিরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। মার্চ মাসের শুরুতেই তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাংলার মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন অস্ত্র। আর সেই অস্ত্র ক্রয়ের জন্য চাই অর্থ। তাই বিলেতে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিটি সংগঠন তখন থেকেই যার যার মতো করে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকে। মার্চের পর থেকে সারা ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্তে এ্যাকশন কমিটি আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। বার্মিংহামের ইপিএলএফ নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় 'বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি'। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে আজিজুল হক ভূঁঞা এবং সুলতান মাহমুদ শরীফ পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেন এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ২৮শে মার্চ স্মলহিথ পার্কের জনসভায় আজিজুল হক ভূঁঞা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ১ লাখ রাইফেল কিনে দেওয়ার প্রস্তাব করেন এবং তা কিনে জুন মাসে কোলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ২৪শে এপ্রিল কভেন্ট্রি সম্মেলনের মাধ্যমে ব্রিটেনের সকল সংগ্রাম কমিটিকে একত্রিত করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট 'স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য এ্যাকশন কমিটিজ ফর লিবারেশন অব দ্য পিপল্‌স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে-১৯৭১ গঠিত হয়। উক্ত কমিটি পরিচালনার জন্য আজিজুল হক ভূঁঞাকে আহবায়ক করা হয় এবং এই কমিটি ১১ গোরিং ষ্ট্রিটে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অফিস স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে নিয়োজিত হয়। জুন মাসে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুজিবনগরে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আবারো ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে সংগ্রামে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লল্ডনে গেলে বঙ্গবন্ধুকে সম্বর্ধনা দেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সকল ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করেন। সে বছর ১৮ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ গঠনে অংশগ্রহণ করেন। '৭২ সালে তিনি 'সাপ্তাহিক চরমপত্র' প্রকাশ করেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৬ সালের ২২শে জানুয়ারি তিনি ঢাকায় লোকান্তরিত হন। নিজ জন্মস্থানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।