বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ব্রিটেনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক আজিজুল হক ভূঁঞার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

ব্রিটেনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক
আজিজুল হক ভূঁঞার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি


শেখ উল্লাস ॥  বাঙালির বিপ্লবী চেতনার ধারক, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য এ্যাকশন কমিটিজ ফর দ্য পিপল্‌স্‌ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে-১৯৭১-এর আহবায়ক, সাপ্তাহিক চরমপত্র ও দৈনিক সুখবর-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক আজিজুল হক ভূঁঞা স্মরণে ২রা ফেব্রুয়ারি রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলার সেমিনার আলোচনা সভার আয়োজন করে বিলেতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ফোরাম। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ফোরামের সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, আজিজুল হক ভূঁঞার ছোট ভাই আনোয়ারুল হক ভূঁঞা, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী এবং জাতীয় নারী জোটের সমন্বয়ক আফরোজা রীণাসহ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিকবৃন্দ। বক্তারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তার স্মৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানান। এই স্মরণসভায় বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আজিজুল হক ভূঁঞা ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডে কর্মজীবন শুরু করেন এবং '৬৭ সালে গোষ্টারগ্রীণ স্কুল অব বিজনেস, এস্টোন, বার্মিংহাম, ইউকে থেকে এপ্লাইড ইকোনোমিঙ এবং মার্কেটিং-এ ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরেরই শেষ দিকে গ্রেড ব্রিটেনে ইষ্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট ( ইপিএলএফ) গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। '৬৮ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা মামলায় গ্রেফতার হলে তিনি ইংল্যান্ডে বাঙালি সম্প্রদায়কে একত্রিত করে বঙ্গবন্ধুর  পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে গ্রেড ব্রিটেনে গমন করলে বার্মিংহাম ডিকবেথ সিভিক হলে ইষ্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (ইপিএলএফ)-এর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে গণসম্বর্ধনা দেন। প্রায় এক দশক গোপণে কাজ করার পর ইপিএলএফ ১৯৭০ সালের শেষের দিকে প্রকাশ্য ঘোষণা দেয় স্বাধীনতার জন্য। ওই বছর ২৯ নভেম্বর বার্মিংহাম শহরে একটি পাবলিক মিটিং আহবান করে ইপিএলএফ। সেই সভায় পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রস্তা গৃহীত হয়। সেই সভায় কয়েক হাজার বাঙালির সমাগম হয়েছিল বলে উদ্যোক্তাদের অভিমত। সেই সভায় বক্তৃতা করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক নেতা তারিক আলী। সভার সভাপতি ও ইপিএলএফ-এর আহবায়ক আজিজুল হক ভূঁঞা অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতার আহবান জানিয়েছিলেন। এই সময় ইপিএলএফ-এর একটি মুখপত্রও বের হয়, এর নাম ছিল বিদ্রোহী বাংলা। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন সেলিম আহমেদ, এ ইসমাইল এবং দিপু। এ তিনটি নামই ছিল ছদ্মনাম। সেলিম আহমদ নামের আড়ালে কাজ করতেন সংগঠনের আহবায়ক আজিজুল হক ভূঁঞা। জয়বাংলা নামে বুলেটিন প্রকাশ করেন তারা ১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ। ৩রা এপ্রিল প্রকাশিত বুলেটিনের নাম ছিল স্বাধীন বাংলা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণের আগে থেকেই ব্রিটেনবাসী বাঙালিরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। মার্চ মাসের শুরুতেই তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাংলার মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন অস্ত্র। আর সেই অস্ত্র ক্রয়ের জন্য চাই অর্থ। তাই বিলেতে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিটি সংগঠন তখন থেকেই যার যার মতো করে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকে। মার্চের পর থেকে সারা ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্তে এ্যাকশন কমিটি আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। বার্মিংহামের ইপিএলএফ নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় 'বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি'। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে আজিজুল হক ভূঁঞা এবং সুলতান মাহমুদ শরীফ পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেন এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ২৮শে মার্চ স্মলহিথ পার্কের জনসভায় আজিজুল হক ভূঁঞা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ১ লাখ রাইফেল কিনে দেওয়ার প্রস্তাব করেন এবং তা কিনে জুন মাসে কোলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ২৪শে এপ্রিল কভেন্ট্রি সম্মেলনের মাধ্যমে ব্রিটেনের সকল সংগ্রাম কমিটিকে একত্রিত করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট 'স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য এ্যাকশন কমিটিজ ফর লিবারেশন অব দ্য পিপল্‌স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে-১৯৭১ গঠিত হয়। উক্ত কমিটি পরিচালনার জন্য আজিজুল হক ভূঁঞাকে আহবায়ক করা হয় এবং এই কমিটি ১১ গোরিং ষ্ট্রিটে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অফিস স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে নিয়োজিত হয়। জুন মাসে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুজিবনগরে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আবারো ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে সংগ্রামে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লল্ডনে গেলে বঙ্গবন্ধুকে সম্বর্ধনা দেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সকল ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করেন। সে বছর ১৮ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ গঠনে অংশগ্রহণ করেন। '৭২ সালে তিনি 'সাপ্তাহিক চরমপত্র' প্রকাশ করেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৬ সালের ২২শে জানুয়ারি তিনি ঢাকায় লোকান্তরিত হন। নিজ জন্মস্থানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন