মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাংলা ভাষায় যুগোপযোগী খোতবা কবে হবে ?

বাংলা ভাষায় যুগোপযোগী খোতবা কবে হবে ?

সংলাপ ॥ খোতবা শব্দের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটা আরবি 'খুৎবুন' শব্দ হতে উদ্ভুত, যার আভিধানিক অর্থ হলো বক্তৃতা। ইসলামী পরিভাষায় খোতবা বলতে  আল্লাহ্‌র প্রশংসা, রাসুলের প্রশংসা ও বক্তৃতা বুঝানো হয়। খোতবার উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌র জিকির বা স্মরণ এবং বক্তৃতা ও উপদেশ প্রদান করা। আর এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক সংশোধন ও সমাজ সংস্কার। খোতবার এসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম কর্তৃক নির্বাচিত ও নির্ধারিত ক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, জুম্মার নামাজের পূর্বে মসজিদে কিংবা ঈদগাহে, দুই ঈদের নামাজের পরে, আরাফাতের ময়দানে হাজীদের উদ্দেশে, বিবাহ অনুষ্ঠানে আক্‌তের সময় এবং জানাজার দোয়া ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত।
শুক্রবার দিনটি অন্য সব দিনের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, কারণ এদিন সারা বিশ্বের সব মসজিদে জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। শহর গ্রামের সব মুসল্লিরা এ দিন মসজিদে একত্রিত হন। রাসুল (সা.)-এঁর যুগে তিনি নিজেই খোতবা প্রদান করতেন। রাসুল (সা.)  খোতবার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিধি বিধান, প্রেরণা বাণী, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতি-নীতি, কৃষি কাজ, স্বাস্থ্য, সামাজিক সমস্যা, ইবাদত-বন্দেগী, বিচার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়ের সমাধান তুলে ধরতেন।  মুমিন হতে হলে তার করণীয় ও বর্জনীয় বিভিন্ন বিষয়গুলো কি তা বিশদভাবে আলোচনা করতেন। আমাদের দেশে খতিবগণ সাধারণতঃ বার চান্দের খোতবার কিতাব সংগ্রহ করে তা দেখে দেখে আরবি ভাষায় পাঠ করেন। অথচ এদেশের মানুষের ভাষা বাংলা। বেশির ভাগ মানুষই আরবি ভাষা জানেন না, তাই খতিবের দেয়া খোতবা শ্রবণ করেন বটে কিন্তু এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে খোতবার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
অধিকাংশ খতিবগণই সাধারণত নিজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতি শুক্রবারের জন্য আলাদাভাবে কোন খোতবা তৈরি করেন না। একজন খতিব যদি প্রতি সপ্তাহের জন্য নিজে খোতবা তৈরি করেন, তবে তার নিয়মিত জ্ঞান চর্চা হয়। আর নির্ধারিত খোতবা পাঠে তার চিন্তার বিকাশ ঘটে না।  আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪২ বছর পরও মাতৃভাষায় ইসলামী সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত হতে পারেনি। প্রতি শুক্রবার জুম্মার দিন খোতবাগুলো যদি গঠনমূলকভাবে তৈরি করা হতো, তবে এ দেশের অনেক খতিবই যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত লেখক এবং গবেষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারতেন। একটি সুন্দর উপযুক্ত, মানসম্মত ও আদর্শ খোতবা তৈরির জন্য কতগুলো নিয়ম পদ্ধতি এবং কলাকৌশল অনুসরণ করতে হয়। যার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব, জাতি সঠিক দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে। বর্তমান বিশ্বে যেসব ফেৎনা-ফ্যাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন কলহ-কোন্দল বিরাজমান, যেমন গণহত্যা, বর্বরতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যাকা- ইত্যাদি নিয়মিত চলছে - এসব কিছুর প্রতিকার কী? কী উপায়ে এর থেকে জাতি মুক্তি পেতে পারে। এ সম্পর্কেও জাতিকে দেয়া যায় দিক নির্দেশনা। সমাজের সাধারণ মানুষও খতিবের কাছে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যই আশা করেন। আমাদের দেশের খতিবগণ প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন খোতবা তৈরি করে দেশ ও জাতির চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবা যেন  বিষয়বস্তুর আলোকে দু'ভাগে বিভক্ত হয়। ১. কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খোতবা। যেমন ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণ। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, পহেলা ?বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষের  তাৎপর্য, ১০ মহররম, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ইত্যাদি বিষয়াবলীর প্রকৃত ঘটনা ও তাৎপর্য গুরুত্ব সহকারে মুসলমানদের সামনে তুলে ধরা। ২. কুরআনের আলোকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা। যেমন ঈমান, আখলাক, আদব, কী?  কুরআনের উপদেশ সংবলিত ঘটনাবলি, ও আদেশ-নিষেধ বর্ণনা করা। নবী-রাসুল (সা.), ও মুসলিম মনীষীদের জীবনদর্শন আলোচনা করা। গবেষণামূলক আলোচনা করা, যেমন আমাদের মাঝে নিত্যনতুন যেসব আবিষ্কার ও পরিভাষা সৃষ্টি হচ্ছে তা আলোচনা করা। সর্বশেষ আগামী দিনের চরিত্র গঠনমূলক আলোচনা ও ইসলাম ধর্মের দিক নির্দেশনামূলক খোতবা দেয়া। অতএব কোন খতিব যদি এ নিয়মে তার খোতবা সাজাতে পারেন, তবে তার খোতবাটি একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবা হবে। মুসলমানদের মাঝে খোতবা শুনার আগ্রহ বাড়বে। তাই আমাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রতি শুক্রবার নতুন খোতবা প্রস্তুত করে মুসলমান্লদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা উচিত।
স্মর্তব্য, ১৯৬০ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রথমবারের মতো ইমাম প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করেছিল। সে সময় খোতবা সংস্কারেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং তৎকালীন বিশিষ্ট উলামা এবং বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক বাংলা অনুবাদসহ নতুন খোতবাও রচিত হয়েছিল, একযোগে তা অনেক মসজিদে পঠিতও হয়েছিল বলে জানা যায়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, নব্বই-এর দশকে বাংলাদেশে খোতবা সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে কিছুটা বাস্তব পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ১৪ জানুয়ারী ইকবাল রোডে ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প আয়োজিত ১৯৮তম দলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণদান কালে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী একটি খোতবা প্রণয়ন কমিটি গঠন করার তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশে প্রচলিত পুরাতন খোতবার অংশ বিশেষ পরিবর্তন করে মুসল্লীদের মধ্যে প্রচার উপযোগী, বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মুদ্রিত একটি নতুন খোতবা শীঘ্রই প্রণয়ন করা হবে।
তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী ঘোষিত খোতবা সংস্কার কমিটি কিছুদিন কাজও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ফলে সেই খোতবা সংস্কার কমিটির আর কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে খোতবা সংস্কারের  সেটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এরপর খোতবা সংস্কারের আর কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে বলে জানা যায় না। বর্ণিত পটভূমির আলোকে বলা যায় যে, খোতবা সংস্কারের মহৎ উদ্দেশে অতীতে যেসব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ সরকারী রেকর্ড-পত্রে সংরক্ষিত থাকার কথা। নতুন শতকের নতুন পরিস্থিতিতে খোতবা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। যেহেতু এ সম্পর্কে অতীতে যথেষ্ট কাজ হয়েছে এবং বেশ অগ্রগতিও সাধিত হয়েছিল। তাই ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনায় এনে সংরক্ষিত কাগজপত্র/রেকর্ড পত্রের আলোকে অথবা বিজ্ঞ আলেম সমাজের পরামর্শক্রমে পুনরায় খোতবা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। পূর্বের গৃহীত উদ্যোগের সাথে যেসব বিজ্ঞ আলেম সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে এখনও কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব জীবিত আছেন, তাদের মূল্যবান পরামর্শ খোতবা সংস্কারে বিশেষ উপকারে আসতে পারে। খোতবার ইসলামি ঐতিহ্য-চরিত্র বজায় রেখে যুগের চাহিদা অনুযায়ী খোতবা সংস্কারের প্রয়োজন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। খোতবাকে কেন্দ্র করে কেউ যেন বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ না নিতে পারে সেদিকেও সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, আল্লাহর কথা জানতে হলে, বুঝতে হলে, মানতে হলে সবাইকে নিজ নিজ ভাষায় কুরআন পাঠ করতে হবে। হিন্দুর ভাষা, খ্রিস্টানের ভাষা, কাফেরের ভাষা বলে কোন ভাষাকে অবমাননার সুযোগ আল্লাহ কাউকে দেননি। রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে, প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগতভাবে মুসলিম, অর্থাৎ, নিষ্পাপ, ভালো ও শান্ত। তাই মানবশিশু জন্মের পর যে ভাষায় কথা বলে তা-ই মুসলমানদের ভাষা। আল্লাহ তায়ালা জন্মের পর নিষ্পাপ ও পবিত্র মানব-শিশুর মুখে যে ভাষা ফুটিয়েছেন সে ভাষাতেই দিয়েছেন ইবাদত ও কিতাব শিক্ষার পূর্ণ অধিকার। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা যে অধিকার দিয়েছেন কোন মোল্লা তা ছিনিয়ে নিতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে তার সকল নবী-রাসুলের কণ্ঠে একমাত্র আরবি ভাষা দেননি এবং নবী-রাসুলদের মাঝে ভাষাগত ঐক্য সৃষ্টি করেন নি। বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আরবি ভাষাই  যদি কল্যাণকর হতো তবে আল্লাহ এতো ভাষা সৃষ্টি করতেন না এবং তাঁর সব কিতাবই আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করতেন, এবং একমাত্র আরবিকেই ইবাদতের যোগ্য ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করতেন। অনারবি ভাষা আল্লাহর ইবাদতের অযোগ্য হলে বিভিন্ন অনারবি ভাষায় বিভিন্ন কিতাব অবতীর্ণ করতেন না। অথচ আল্লাহ তায়ালা হিব্রু ভাষায় ইনজিল, ইবরানি ভাষায় তাওরাত ও ইউনানি ভাষায় যাবুর অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং কেবল আরবিই আল্লাহ তায়ালার ভাষা নয়। আল্লাহ তায়ালা অন্তর্যামী। সব মানুষের ভাষাই তাঁর ভাষা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাব না বুঝে আবৃত্তি করার জন্য অবতীর্ণ করেননি। যে মানুষ যে ভাষায় তাঁর কিতাব সহজে বুঝতে পারে সে ভাষাই আল্লাহর কাছে প্রিয় ও পছন্দনীয়। আল্লাহর ইবাদতে বান্দার মাতৃভাষার চেয়ে উত্তম কোন ভাষা নেই।
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মসজিদের ইমাম-খতিবগণ সমাজের তৃণমূল থেকে ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামী আদর্শ শিক্ষার বিস্তার, বাস্তবায়ন, সামাজিক অপরাধ-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ধর্মদ্রোহীদের অপপ্রচার-বিভ্রান্তির অবসানে কার্যকর ও বাস্তবমুখী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। রাজনৈতিক ইসলাম ও  বিভ্রান্তদের প্রচারণা এবং অপতৎপরতা রোধে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। এ লক্ষ্যে খোতবা সংস্কারের মাধ্যমে ইমামদের যুগ চাহিদা পূরণে প্রস্তুত ও অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। খোতবা যেন সমাজের অভ্রান্ত দিশারী হিসেবে, আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে তা নিশ্চিত করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন