মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বিএনপির করুণ দশায় হতাশ ‘ইকোনমিস্ট'

বিএনপির করুণ দশায় হতাশ ‘ইকোনমিস্ট'

সংলাপ  ॥  জামায়াতের সঙ্গী দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি বর্তমানে প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করা কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরকার পতনের আন্দোলন-কোন কিছুতেই দলটি ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ দলের নেতাকর্মীরাই কোন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন না। গত শুক্রবার ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণে ‘ক্রাইম এ্যান্ড পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ, বাং বাং ক্লাব' শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি গত শনিবার প্রিন্ট সংস্করণে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে বেশ খোশ মেজাজেই আছেন। প্রধান বিরোধীদল বিএনপির  নেতৃত্বে জামাতসহ পুরো ১৮ দলীয় জোটের বর্জন করা গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একতরফাভাবে জয়ী হয়েছে তার দল আওয়ামী লীগ। পশ্চিমা বিশ্বসহ বাংলাদেশের দাতাদেশ এবং পর্যবেক্ষক দেশগুলো একযোগে তখন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নির্বাচন বর্জন করেছিল। তখন সমগ্র আন্তর্জাতিক বিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও বর্তমানে উন্নত দেশগুলো শর্তসাপেক্ষে আরও পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পক্ষে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এমনকি ব্রিটেন এবং আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচনে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ, যা বর্তমান সরকারকে বেশ সুবিধাজনক স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ এবং বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘বিশেষ কাছের বন্ধু' ভারতও বেশ সন্তুষ্ট। জানুয়ারির নির্বাচনকেও সে সময় একমাত্র ভারত সরকারই স্বীকৃতি দিয়েছিল। ভারতের রাজধানী দিল্লীতে এক অনুষ্ঠানে দেশটির কূটনৈতিক নীতি-নির্ধারকরা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাই ভারত সরকার বাংলাদেশে এমন কোন দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না যারা ইসলামের নীতি ‘অনুসরণ' করে, বিশেষ করে ভারতের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী  দেশ পাকিস্তানের ‘বন্ধু' দল হিসেবে খ্যাত হলে তো নয়ই। পাশাপাশি, জীবিকা অর্জনের উদ্দেশে ভারতে যাওয়া অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা কমাতেও বদ্ধপরিকর ভারত সরকার।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতের ‘বন্ধুপ্রতিম' শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও ভারত সরকারের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছে। এই লক্ষ্যেই নিজ দেশের বিরোধী দলগুলোকে রীতিমতো চিড়েচ্যাপটা করার জন্য যা কিছু করতে হয় তার সব কিছু করছে সরকার। আর একটি গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রকে অসুস্থ করে ফেলার জন্য এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট। কিন্তু এর পরেও বর্তমানে শান্ত হয়ে আছে দেশটির বিরোধী দল। কৌশলীপন্থা অবলম্বনের জন্য আপাতত বেশ কিছুদিন শান্ত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন দলটি। আদালতের ঝামেলা শেষ হওয়ার পর ভেতর থেকে দলকে সংগঠিত করে সংসদে ফিরে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে আবারও ফিরে আসবে রাজপথে।
১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা সম্পর্কে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালের এপ্রিলে দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বন্দর থেকে খালাসের সময় পুলিশ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রবোঝাই একটি চালান আটক করেছিল। চালানটিতে রাইফেল, সাইলেনারসমেত সাবমেশিনগান, ২৫ হাজার হ্যান্ড গ্রেনেডসহ চীনে তৈরি প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ছিল।
ধারণা করা হয়, ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সহায়তায় অন্ত্রের চালানটি বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অশান্ত আসাম রাজ্যে বিদ্রোহের সময় ব্যবহারের জন্য অস্ত্রগুলো আনার সময় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রের চালানটি আটক করা হয়।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের পর বছর চলে গেলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা মোটামুটি থমকে ছিল। অস্ত্রের চালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তখন চিহ্নিত করা হয়নি। দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়া এ অস্ত্রসংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে তখন খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল এবং বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই ২০০৯ সালে এই অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি এ বিচারের রায়ে অস্ত্রো্রপাচারের দায়ে অভিযুক্ত ১৪ আসামির মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের অধিকাংশ ব্যক্তিই বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।
ইকোনমিস্ট মনে করে, উচ্চ আদালতের দেয়া এ রায় রাজনৈতিক দিকসহ আইনি দিক থেকেও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এ অভিযোগের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে খালেদা জিয়ার ছেলে এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামও। নিজ দেশে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত কয়েকটি মামলার জের ধরে বর্তমানে লন্ডনে বাস করলেও দলের পরবর্তী নেতা হিসেবে তাকেই মান্য করেন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই তারেক রহমানেরই এক তোষামোদকারী নেতা এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, যিনি অস্ত্রের চালানের বিষয়ে আগে থেকে সবকিছুই জানতেন।
মৃতুদন্ডপ্রাপ্ত বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান, বাংলাদেশী গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন এক শীর্ষ কর্মকর্তা, আসামের এক বিদ্রোহী পলাতক নেতা যিনি একই সঙ্গে ভারত সরকারের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকাভুক্ত এবং এছাড়াও আরও অনেকে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের তালিকায় মতিউর রহমান নিজামীর নামও উল্লেখযোগ্য। নিজামী বাংলাদেশের বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধী দেশ পাকিস্তানকে সহায়তার অভিযোগে এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে পৃথক মামলায় ইতোমধ্যে এই নেতার শুনানি বিচারাধীন আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই মামলাতেও দ্বিতীয়বার তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হতে পারে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্রপাচারের মামলায় দলটির অভিযুক্ত সদস্যদের মৃত্যুদন্ডের রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা অব্যাহত রেখেছেন তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচী। কিন্তু রাজপথে আন্দোলনের নামে সহিংস কর্মকান্ডের জন্য এই দলটি বেশ কুখ্যাত হলেও বিগত কয়েক মাস ধরে সহিংসতা সৃষ্টিতে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন