বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

চেতনায়.... পহেলা বৈশাখ





চেতনায়....
পহেলাবৈশাখ



সংলাপ ॥ দুঃখজনক হলেও আজো সত্যি, জাতীয় অগ্রগতির ধারায় যখনই কোন ব্যক্তি বা চক্র কৌশলে চক্রান্তমূলক ভাবেই জাতীয় চেতনার মূলে আঘাত হেনেছে, তখনই তাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় স্থান দিয়ে সমর্থন করা হয়েছে। তাই জাতীয় চেতনার পরিপন্থী চক্র বার বার পেয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়।
পহেলা বৈশাখে বাঙালির নববর্ষ উৎসব উদ্যাপনকে নিয়ে ধর্মব্যবসায়ী উগ্রবাদী শ্রেণীর চক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। পাকিস্তান শাসনামলেও এই চক্রান্ত চলেছিল। ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব শাহীর শত নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এদেশের বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্র-জনতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল এ উৎসব পালনের অধিকার। সাম্প্রতিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে যারা মনগড়া ধর্মের অপব্যাখ্যায় জাতীয় চেতনায় বিভাজন রেখা টানতে চান, তাদের স্মরণ রাখা জরুরি বাঙালি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী মানুষের অটুট ঐক্য ও প্রতিরোধের কথা।
বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির উৎসব। এ উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। এ উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা, আবেগ-অনুভূতির সতত প্রকাশ। এ উৎসব বাঙালি তথা আমাদের গর্ব, আমাদের জাতীয়তা বোধের পরিচিতি। এর সাথে শাস্ত্রীয় কোন ধর্মের কোন বিরোধ নেই, থাকতে পারে না। ইসলাম ধর্মে তো নয়ই।
ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম, সাম্যের ধর্ম, সার্বজনীন ও মুক্ত চিন্তার দীক্ষা পাওয়া যায় এ ধর্মে। বিভেদ নয় ঐক্যের আহবান রয়েছে কুরআনে। দেশ, জাতি, জাতীয়তাবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার লালন-পালনের শিক্ষা কুরআনেই আছে। কিন্তু তারপরও আজও ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে জাতীয়তাবোধের সাথে ধর্মের বিরোধ ঘটাতে চান কতিপয় ধর্মবেত্তা ও ধর্মব্যবসায়ী, যারা তথাকথিত ধর্মীয়বোধ, ফতোয়াবাজি এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিতর্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলেছেন সমাজে।
সঙ্গত কারণেই শান্তিকামী মানুষের চিন্তায় আজ জাগ্রত - সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে সাম্য ও ঐক্যের যে বাঙালি জাতীয়তা, তাকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে তথাকথিত ধর্মের অপব্যাখ্যায় আক্রমণ করছে সংকীর্ণ চিন্তাবিলাসী উগ্রধর্মবাদী চক্র। এরা ‘মুসলমান’-এর কোন সংজ্ঞায় নিজেকে এবং ‘বাঙালি জাতি’কে অস্বীকার করতে পারছেন না আবার মুসলমান ও বাঙালির মাঝে তফাত টানছেন? একজন বাঙালি মুসলমান হতে পারেন এটা স্বীকার করেন। কিন্তু স্বীকার করেন না নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে!
স্বাভাবিকভাবে ধর্মভীরু মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে ইসলাম কি তবে মানবজাতির কোন খন্ডাংশের জন্য? প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর ধর্ম-চিন্তাবিদদের কাছে আশা করে জাতি।
জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি বিষোদগার করে যারা প্রজন্মকে ভুল পথে চালিত করে ফাটল ধরাতে চায় জাতীয় ঐক্যতানে, আমদানীকৃত ভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা-সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে গড়ে তুলতে চায় জাতিভেদ-বর্ণবৈষম্য, তাদের এই ফতোয়াবাজি স্বাধীনতা বিরোধী একটি গোষ্ঠীকে বৈধ করবার অপপ্রয়াস সাময়িক ক্ষমতায় যাওয়ার বা টিকে থাকার জন্য রাজনীতিকরা লোকচক্ষুর অন্তরালে করতে সক্ষম হবেন কিন্তু জাতীয় চেতনায় কোন আঘাত হানতে পারবেন কি? বরং এই আঘাতের পাল্টা আঘাতে জাতীয় ঐক্যকেই আরো অটুট ও সুদৃঢ় করে তুলবে।

সময়ের সাফ কথা.... ভোট চলছে-ভোট হচ্ছে





সময়ের সাফ কথা....
ভোট চলছে-ভোট হচ্ছে


সংলাপ ॥ ইউনিয়ন পরিষদে ভোট চলছে-ভোট হচ্ছে। এই দেশে ভোট এল মানেই, নেতাদের গলা মিহি হল, ক্যাডারদের লেজ মোটা হল, মিটিংয়ে-মিছিলে ছোটা হল, কোটি টাকা লুট হল।  অবাধ্য নেতারা বাধ্য হল, কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হল, মিডিয়াগুলোরও খাদ্য হল। ভোট এল তো হরেক রঙের পতাকা আর লিফলেট এল, হরেক সাইজের ডান্ডা এল, নিজ-নিজ কথা নিয়ে ভোটের যত পাণ্ডা এল। ভোট এল তো রাতারাতি দেশে জনদরদি রাজনীতিকরা এল। একটু একটু করে ভোটের জমিটি চষা হল, বড় বড় নেতাদের কিঞ্চিৎ দর্শন হল, প্রতিশ্রুতির বর্ষণ হল।  এইভাবে... ভোটের জমিটি চষা হয়ে আসছে, অঙ্ক-টঙ্ক কষা হচ্ছে বারবার, টিকিট না পেয়ে অনেকের গোঁসা হচ্ছে, কাঁচারা ডাঁসা হচ্ছে, দিনকতকের জন্য শহুরে রাজনীতিকরা গাড়ী চড়ে  গ্রামে এসে সব গ্রামীণ চাষা বন যাচ্ছে। নেতাদের মরা গাঙে বান আসে, দলের কোণঠাসাদের কপালে কিঞ্চিৎ মান আসে...। ভোট এল তো, গলাকাটারা খাপ খুলল, নেতারা-সব ঢাকনা খুলে সেখান থেকে যে-যার পোষা সাপ খুলল...। এদেশের গণতন্ত্রে এই হল ভোট।
আসছে হচ্ছে ভোট/ বাঁধছে জব্বর ঘোঁট/ সত্যি কথা বলবে যে, তার বন্ধ হবে ঠোঁট। তা, যাই হোক, ভোট তো কাউকে-না-কাউকে দিতেই হবে। পৃথিবীর বহু দেশে কোটি কোটি মানুষ এই অধিকারটুকু পাওয়ার জন্য কত কত  বছর ধরে লড়াই চালিয়েছে এবং আজও চালিয়ে যাচ্ছে! সেই অধিকার আমরা পেয়ে গেছি বলে হেলাফেলা করে নষ্ট তো করতে পারিনে।
কিন্তু প্রশ্নটা হল, ভোটটা কাকে দেয়া সবচেয়ে সমীচীন হবে বা হলো! যারা ইতিমধ্যে কোনও বিশেষ পার্টির দফতরে  গিয়ে মাথাটি বিক্রী করে ফেলেছেন, তাদের এই সমস্যাটা নেই। চোর-ডাকু, লম্পট-ধর্ষক, গুন্ডা-মাফিয়া, মিথ্যাবাদী, ভণ্ড, দেশদ্রোহী, ধর্মজীবী যে-ই দাঁড়াক না কেন, তারা ওকেই নির্দ্বিধায় ভোট দেবেন। কিন্তু যারা কোনওকালে কোনও বিশেষ হাড়িকাঠে মাথাটি ঢোকাননি, যারা এখনও অবধি রাজনৈতিক দলগুলোর উৎকর্ষ-অপকর্ষ বিচার করে ভোট দিতে ভালোবাসেন এবং জোর গলায় বলা যায়, তেমন মানুষের সংখ্যাও বড় একটা কম নয়-আসল সমস্যাটা তাদেরই। এ যে আমাদের বাঁশবনে ডোমকানা অবস্থা। কোন বাঁশটাকে ছেড়ে কোনটাকে কাটি বল দেখি? উপমাটা হয়তো জুতসই হল না। কারণ, বাঁশবনে যে লোকটি কানা, তার সমস্যা হল, এতসংখ্যক এবং এত মোটা-মোটা বাঁশের মধ্যে কোন বাঁশটা কাটবে! তার মানে, ওর কাছে ওটা প্রাচুর্যের এবং উৎকর্ষের সংকট। কিন্তু সাধারণের কাছে সংকটটা ভিন্ন। তাদের সমস্যাটা হল, যতগুলি দল ভোটে দাঁড়াবে, ‘তাদের কেউ-কেউ পুরোপুরি ন্যাংটো, তো অন্য কেউ-কেউ কিছুই করতে বা হতে পারেনি।’ এ দেশের  প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলই এই ক’দশকে বেশ ভালোমতোই নাহলে কিছু কিছু পচেছে। বাস্তবিক, আজ এই দেশে একটাও রাজনৈতিক দল পাওয়া যাবে না, যারা দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস, মিথ্যাচার, ভ-ামি, নীতিহীনতা, সুবিধাবাদ ইত্যাদিতে কমবেশি কলুষিত নয়। কোনকালেও জনতার অর্থ চুরি-চামারি করেনি, অপহরণ-ধর্ষণ-খুন ইত্যাদিতে জড়িত নয়, পেশিশক্তির দ্বারা সাধারণ মানুষকে কবজায় রাখে না, সাধারণ মানুষের ওপর হরেক কিসিমের জুলুম-অত্যাচার-সন্ত্রাস করে না, জনতাকে ভাঁওতা দেয় না, পুলিশ ও প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করে না, ব্যবসায়ীদের তোষণ করে না, সিন্ডিকেটরাজ-প্রমোটাররাজের সঙ্গে মাখামাখি করে না, তেমন দল আজ আর বাংলার মাটিতে একটিও খুঁজে পাওয়া খুবই মুস্কিল, হয়তো পাওয়াই যাবে না। শুনতে যতই খারাপ লাগুক, এটাই আজ আমাদের দেশে সবচেয়ে নির্মম সত্য।
তা সত্ত্বেও, ভোট তো কাউকে-না-কাউকে দিতেই হবে। হ্যাঁ, চোর, ডাকাত, মিথ্যাবাদী, ঘুষখোর, ভালোমানুষ...,যা-ই হোক না কেন, ভোট দিয়ে একটা সরকার আমাদের গড়ে দিতেই হবে। কারণ, একটিবার ভেবে দেখুন, দেশে কোনও আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা, থানা-পুলিশ-অফিস-আদালত-জেল-হাজত বলে সব আছে আবার কিছুই নেই, হাকিম নেই, পুলিশ নেই, মিলিটারি নেই, মিউনিসিপ্যালিটি, কর্পোরেশন কিছুই নেই, আবার রয়েছে, তবে ওগুলো চালনা করবার জন্য কোনও দৃঢ় প্রত্যয়ী  সরকার নেই-সত্যি, এমনটা ভাবতে ভয় করে। বেশি নয়, এমন পরিস্থিতি চলছে চলবে, শুধু সূচক উঠানামা করছে। থাবার মধ্যে লুকিয়ে রাখা কোটি কোটি হিংস্র নখদাঁত নিমেষের মধ্যে বেরিয়ে পড়ছে আবার থাবার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। ফলত, সাধারণ মানুষ একেবারে ধনে-প্রাণে মারা পড়ছে পড়বে।
কাজেই, যতই না ইচ্ছে করুক, কেবল জানমানের তাগিদেই কোনও একটা দলকে ভোট দিয়ে শাসনক্ষমতায় বসাতে আমরা বাধ্য। এর থেকে আমাদের কোনও নিষ্কৃতি নেই।
তাহলেই কোটি টাকার প্রশ্ন-সবগুলি কানকাটার ভেতর থেকে সুকর্ণটিকে বাছব কেমন করে? কোন পদ্ধতিতে?  এ-ব্যাপারে আমাদের দেশে বহুল প্রচারিত ওই প্রবাদটাই যথার্থ। ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা’। অর্থাৎ ‘মন্দের ভালো’। অর্থাৎ কিনা, পচনের ক্ষেত্রে ডিগ্রি বা মাত্রা নিরূপণ। সেটাই উপস্থিত আমাদের একমাত্র ভরসা। এই ডিগ্রি কিংবা মাত্রা বস্তুটি কী?
এদেশের সব দলই ভালোমতোই পচেছে অথবা পচার পথে। এবং এই পচন সহজে বন্ধ হওয়ারও নয়। এমন পরিস্থিতিতে  করণীয় হল, অতীত ও বর্তমানের অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করে দেখে নিতে হবে-১) কোন দল দুর্নীতির পাঁকে সবচেয়ে বেশি ডুবেছে। ২) কারা জনগণের জন্য বরাদ্দ অর্থ সবচেয়ে বেশি আত্মসাৎ করেছে। ৩) দেশী-বিদেশী সিন্ডিকেটরাজের সঙ্গে কোন দলের দহরম মহরম সবচেয়ে বেশি এবং সেই সুবাদে কোন দল কাদের থেকে পায়েসটা সবচেয়ে বেশি খেয়েছে। ৪) চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষের পরিমান কোন দলের শাসনকালে সবচেয়ে বেশি। ৫) সমাজ থাকলেই চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি, খুন, নারী-লাঞ্ছনা ইত্যাদি হবেই। সমাজ যতই অসুস্থ হবে, ওগুলো ততই বাড়বে। ওগুলো পুরোপুরি বন্ধ করবার ক্ষমতা সম্ভবত কোনও সরকারেরই নেই। কিন্তু দেখে নিতে হবে, কোন দল এবং সরকার ওগুলো বন্ধ করবার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে। কারাই-বা পীড়িতদের বদলে পীড়কদের পাশে সবচেয়ে বেশি দাঁড়িয়েছে। ৬) কোন দলের নেতাদের মুখে হুমকি-হুংকার, খিস্তি-খেউড় সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। ৭) দেশব্যাপী দলীয় কর্মী ও সমাজবিরোধীদের নিরন্তর তা-ব চলতে থাকলে একদিকে জনগণের দৈনন্দিন জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, অন্যদিকে শিল্পপতিরাও আসতে ভয় পায়। তাই বুঝে নিতে হবে, কাদের আমলে দলীয় কর্মী ও সমাজবিরোধীদের দাপটে মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত থেকেছে। ৮) সব দলেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তাও দেখে নিতে হবে, কোন দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সবচেয়ে বেশি এবং সেই সুবাদে কোন দল দেশজুড়ে সারাক্ষণ মারামারি, রক্তপাত, বোমা ও বন্দুকবাজি চালিয়ে জনজীবনকে সবচেয়ে বেশি ত্রস্ত ও অতিষ্ঠ করে রেখেছে। ৯) কোন দলের আমলে দেশ জুড়ে বোমা- বন্দুকের বেআইনি কারখানাগুলি সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ১০) শিল্প না এলে কর্মসংস্থান হবে না। কাজেই, দেখে নিতে হবে, কারা শাসনে থাকলে দেশজুড়ে  শিল্প আসার ক্ষীণ হলেও সম্ভাবনা রয়েছে। ১১) কাদের আমলে পুলিশ ও প্রশাসন সবচেয়ে বেশি দলদাস হয়েছে। ১২) কোন দলের নেতারা সবচেয়ে বেশি মিথ্যে কথা বলে এবং জনগণকে সবচেয়ে বেশি ভাঁওতা দেয়। ১৩) কোন দল নিজ-নিজ শাসনকালে কতগুলো প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এবং তার মধ্যে কতগুলো রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন  করেছে। ১৪) কোন দলের কোন প্রার্থী নির্বাচিত হলে এলাকায় বেশি সময় থাকবেন, মানুষের কথা বেশি ভাববেন। কোন প্রার্থী নিজের এলাকার মানুষের অভাব-অভিযোগ ও দুঃখকষ্ট সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল, আর কোন প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ‘দূর গগনের পাখি’।
এইসব ব্যাপারে ইউনিয়ন ভিত্তিক ছবিটা হয়তো পরিষ্কারভাবে সবার চোখের সামনে না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে নিজ-নিজ এলাকার ছবিটা বুঝে নিয়েই সিদ্ধান্তটা নেয়া যেতে পারে।
এইমতে সঠিক প্রার্থী ও দলটিকে বেছে নেবার বেলায় নিজ নিজ দলীয় অন্ধত্ব পুরোপুরি ত্যাগ করতেই হবে। নিজ দলকে এবারের ভোটে অপেক্ষাকৃত উৎকর্ষই হোক প্রধান মাপকাঠি।
আমাদের সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, ভোট কেবল নিজ দলের প্রার্থীকে যা তা ভাবে জিতিয়ে দেয়া নয়, বরং দলগুলোর নীতি নির্ধারকদের কাছে একটা সুস্পষ্ট বার্তাও পাঠানো যাতে হয়। কাজেই, উপরোক্ত সূচকগুলো বেশি থাকা সত্ত্বেও আমরা কোনও দলকে জিতিয়ে দিলাম, তাহলে কেবল ওই দলের কাছেই নয়, সমস্ত দলের কাছে একটা ভুল বার্তা পৌঁছে যাবে। দেশের মানুষ এসব নিয়ে বড় একটা ভাবিত নয়, বরং এগুলোকে পরোক্ষে সমর্থনই করে। দলগুলো ওইসব বিষয়ে আরও উৎসাহী হয়ে উঠবে। তাতে করে ভবিষ্যতে আরও বেশি করে ভুগতে হবে দেশবাসীকেই। অপরপক্ষে, ভোটের মাধ্যমে ভোটাররা কোন দলকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে তার দ্বারাও সব রাজনৈতক দলগুলোর কাছে সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছাবে, দেশের মানুষ  আর ওগুলো একেবারেই চাইছে না। তাতে করে অধঃপতিত দলগুলির সামান্য হলেও বোধোদয় হতে পারে। আর, তার সুফলটাও জনগণ পাবে।
ভোট দেবার আগে এগুলো ঠিকঠাক দেখে বুঝে নিতে পারলে, তবেই হয়তো-বা একটা সহনীয়  ব্যবস্থাপনা সরকার আমরা পেলেও পেতে পারি। আর, কোন কিছুর মোহে বা অন্য কোনও কারণে ভুলভাল মানুষকে কিংবা দলকে ভোট দিলে পরবর্তী বছরগুলো আমাদের দুঃখে রাজনৈতিক অঙ্গনের শেয়াল-শকুনও কাঁদবে।
একটা নির্বাচন - পাঁচটা  বছর দেশের পক্ষে যতটা, জাতির কাছে তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের গড় পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে পাঁচটা বছরের অবদান কম নয়। এক সুশাসিত ব্যবস্থায় সকল শ্রেণীর আবালবৃদ্ধবনিতা যেভাবে সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সুযোগ লাভ করে অপশাসিত সমাজে তা কখনওই ঘটতে পারে না। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরাই স্থির করি নিজেদের ও সন্তানদের আমরা কেমন ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করবো।
গত ৪৫ বছর ধরে আমরা এক শোষিত সমাজের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করে চলেছি। এই সময়কালে রাজনৈতিক সন্ত্রাস সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। শাসক দলের পরিবর্তন ঘটলেও সব ধরণের  সন্ত্রাসের যন্ত্রনা থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি পায়নি। ঘর-বাহির, স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি সর্বত্র সন্ত্রাসের দাপট যেন বেড়েই চলেছে। ক্ষেত্র বিশেষে ধরন এক এক রকমের হলেও সর্বত্র একই ধারাবাহিকতা।  ওদের পুলিশের ভয় নেই। ওদের ভয়ে দেশবাসী সর্বদা তটস্থ হয়ে আছে।
নানাভয় সবসময় মানুষকে সর্বদা তাড়া করে চলেছে। এই ভয় থেকেই লোকে নানা ধরনের জুলুম মেনে নিচ্ছে, স্বাধীন চিন্তা-ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এর ব্যতিক্রম হলে চলে শাসানি ও নানা যন্ত্রণার ব্যবস্থা। সবাই তা দেখছে সহ্য করছে।
আজ থেকে অর্ধশতক আগেও বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলি যারা অতিক্রম করেছেন তাদের মতো করে এ যুগের ছেলেমেয়েদের ছারপোকার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। সে যুগে সর্বত্র প্রচুর ছারপোকা পাওয়া যেত। ঘরের বিছানায়, আসবাবে, স্কুল-অফিস-কাছারিতে, সকল প্রকার যানবাহনে সর্বত্র এই তুচ্ছ পোকাগুলির ছিল অনন্ত দাপট। বাড়িতে যারা বিষাক্ত ওষুধ ব্যবহারে পক্ষপাতী হতেন না তাদের বাড়ির আসবাব-বিছানা মাঝে মাঝেই রোদে দেয়া ছিল এক বিরাট পরিশ্রমের কাজ। এই ছারপোকা থেকে মুক্তির পথ দেখাল টিকটোয়েন্টি ওষুধ। এটি বাজারে আসার পরেই যানবাহন, স্কুল-অফিসের ছারপোকা উধাও হয়ে গেল এবং বাড়ির ছারপোকাও আর ফিরে আসার পথ পেল না। ছারপোকা এখন এক অতীতের বিষয় হয়ে গিয়েছে।
এই সব সন্ত্রাসীদের  কি অতীতের বস্তু করে দেয়া যায় না। সেই আশায় দিন গুনছি যখন মানুষ ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারিতে কোন ধরনের সন্ত্রাসর  যন্ত্রণা ভোগ করবে না। সবাই নির্বিবাদে নিজেদের ন্যায্য পাওনা পাবে। পথ নির্দিষ্ট থাকবে পথচারীদের জন্য। সবাই নিশ্চিন্তে পথ চলতে পারবে। মানুষ রাতকে, নির্জনতাকে ভয় করবে না।  সবচেয়ে বড় কথা ছেলেমেয়েরা সন্ত্রাসী  বাবার কুকীর্তির জন্য লজ্জিত জীবনযাপন করবে না। দেশবাসী দেখেছে সেরকম জীবনের লজ্জা কত গভীর হয়। লজ্জার কারণে ছেলেমেয়েরা কীভাবে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, কীভাবে পড়াশোনাতে অমনোযোগী হয়ে পড়ে, মাদকের আশ্রয়ে সবকিছু ভুলে থাকতে চায়। অন্যায় ভাবে উপার্জিত টাকা কোনও সংসারে শান্তি ও কল্যাণ নিয়ে এসেছে এমন একটাও দেখা হয়নি। সুখ হয়তো এসেছে কিন্তু নিতান্ত সাময়িক সেই সুখের অন্তরালে স্থির হয়ে গেছে দীর্ঘ মেয়াদি এক দুঃখের ভবিতব্য। দেশবাসী দেখেছে অন্যায়ভাবে উপার্জিত টাকায় উদ্দাম বিলাস-ব্যসনের জীবন। দেখেছে অপরিণত, বিকলাঙ্গ, জড়বুদ্ধি সন্তানকে নিয়ে মায়েদের জীবনযুদ্ধ, দিকে দিকে অসংখ্য ভেঙে যাওয়া সংসার।
নেতৃত্ব তারই দেয়া সাজে যার আছে এক মহতী কল্পনা ও দূরদৃষ্টি। সেই দূরদৃষ্টিকে বাস্তবায়িত করার প্রবল ইচ্ছাশক্তিও নেতার থাকা দরকার। তার যেন থাকে অপ্রচলিত পথে চলার ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস। তিনি যেন ব্যর্থতা ও সফলতাকে সমভাবে নির্বাহ করার ক্ষমতা ধরেন। সমস্যাকে আয়ত্তে আনা বা পরাজিত করার ক্ষমতাও তাঁর থাকা আবশ্যক। স্বচ্ছতা ও মহানুভবতার সঙ্গে কার্যনির্বাহ করার গুণ ও সেই সঙ্গে সততা ও ন্যায়ের পথে কাজ করে সার্থক হওয়ার যোগ্যতা একজন নেতার অবশ্যই থাকা দরকার।
আমরা সবাই জানি, এতগুণ দিয়ে বিধাতা গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষ সৃষ্টি করেন না। তবু যারা নেতৃত্বদানে ইচ্ছুক তাঁদের মধ্যে এই গুণগুলোর বেশকিছু না থাকলে চেষ্টা করতে দোষ নেই। গণতন্ত্রে  নির্বাচিত করার দায়িত্ব বর্তায় জনতার ওপরেই। সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন করা এক পবিত্র কর্তব্য।
একজন মানুষ একার জোরে সামান্য একটা পরিবারকেও চালনা করতে পারে না। পরিবারের কর্তাকে দেখা যায় নানা কাজের ভার দিয়ে দিতে পরিবারেরই অন্যান্যদের। কর্তাকে অবশ্যই শ্রদ্ধা ও সম্মানের যোগ্য হতে হয় তবেই অন্যেরা তার নির্দেশ পালন করে। এই শ্রদ্ধা ও সম্মানও গায়ের জোরে বা টাকার জোরে আদায় করা যায় না। একটা দেশও চলে সেই একই নিয়মে। সেখানেও সর্বময় নেতার প্রয়োজন থাকে সহযোগীম-লীর। সেই মানুষগুলো সুখের স্পৃহামুক্ত ও দুঃখে অবিচলিত থেকে আকর্ষণ, ক্রোধ ও ভয়কে জয় করলে তবে তাদের শাসনে সাধারণ লোক নির্ভয়ে বাস করতে পারবে ও দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।
ভূতলের উপরে স্বর্গ কোথাও প্রকাশিত থাকলে তা বাংলাতে আছে এবং বাংলাতে আছে এবং বাংলাতে আছে। সর্বত্র অনন্ত ভোগবাদের মধ্যে শান্তির ও আনন্দের সন্ধান সেই আদিকাল থেকে দিয়ে চলেছে এই বাংলাতেই।
এই বাংলা দেখেছে ধর্মীয় তকমা দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা সমাজের শীর্ষচ্ছেদনের ধ্বংসলীলা। দুর্বুদ্ধি-মানুষদের থেকে সাবধান হতে হবে। মাথা উঁচু করে যারা দাঁড়াতে পেরেছে তাদের শেষ করে আর শীর্ষচ্ছেদের রাজনীতি নয়, অন্ত্যোদয়ের কাণ্ডরিরা আসুক। সমাজে যারা ‘সবার নীচে সবার পিছে আছে’ তাদের তুলে ধরে শীর্ষে বসানোর কাজ হোক। এভাবেই বাংলা বাঁচবে, বাঙালি বাঁচবে।

প্রতিবাদের ভাষা বিনির্মাণে....



প্রতিবাদের ভাষা বিনির্মাণে....

অ্যাডভোকেট এম.মাফতুন আহম্মেদ ॥ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় লিখেছেন - ‘যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা, যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে, সবাই করে ভয়, তবে পরাণ খুলে ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বল রে’। সবাই যদি বাংলার জমিন থেকে হারিয়ে যান, ভয়ে সন্ত্রস্ত্র হন, নির্বাক হয়ে যান, আতংকে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেন, একলা চলেন, একলা মনের কথা বলেন তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের কী একদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে? 
কারণ শহীদ-গাজীদের দেশ প্রিয় বাংলাদেশ। আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ বাংলাদেশ। প্রতিবাদের দেশ বাংলাদেশ। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা লাল সবুজের পতাকায় আচ্ছাদিত বাংলাদেশ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের দেশ বাংলাদেশ। এই উপমহাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার সবুজ-শ্যামল এই বাংলাদেশ। অগ্নি গর্ভ বাংলাদেশ। বাঙালিদের অতীত ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহ্য রয়েছে। নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। স্বাতন্ত্রতাবোধ রয়েছে। তারা অধিকার আদায়ে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন - লড়ছেন। বেনিয়া ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন-করছেন। লড়াই করেছেন। বিজয়ের মালা ছিনিয়ে এনেছেন।
সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানি ঢাকায়। পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালিদের অবদান ছিল। আবার বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালিদের ভূমিকা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা লড়েছেন। রক্ত দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তানিদের ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়েছেন। অত:পর সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিদের একমাত্র দেশ যার নাম বাংলাদেশ।
তারা সাম্রাজ্যবাদকে কখনও মেনে নেয়নি। আধিপত্যবাদকে গ্রহণ করেনি। সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। কোন অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। কোন অপশক্তির কাছে আত্মসমর্পন করেননি। তাদের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিকিয়ে দেননি।
বহু আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ। দীর্ঘ এক ইতিহাস। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় টিপু পাগলা, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমির, ফকির মজনু শাহ, দেশবন্ধু সি.আর.দাস, একে ফজলুল হক, এইচ.এস সোহরাওয়ার্দী, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা ভাসানি, শেখ মুজিবর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবুল হাসিম প্রমুখদের নাম ভেসে উঠে। এঁরা ইতিহাসের এক এক অধ্যায়ের নায়ক। এ সব মহান পথিকৃতরা আমাদের সকল আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা। তাঁদের অন্তরে ছিল আগুন। অন্যায় অত্যাচার ও অসত্যের সামনে কোনদিন মাথা নত করেননি। মাথা উঁচু করে থেকেছেন চিরজীবন। নিজেকে চেনার নতুন আশা দেখিয়েছেন। বিপ্লবের আদর্শে দিক্ষিত করেছেন। প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন জীবনবাজী রেখে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়?
শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, নির্লোভ, নির্মোহ এবং ত্যাগী ছিলেন। অন্যায় অসত্যের কাছে তাঁরা মাথা নত করেননি। এক কথায় বাঙালিরা বীরের জাতি। সকল আন্দোলন-সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক। আব্দুল হামিদ খান ভাসানি পাকিস্তানী স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবি তুলে ধরেছিলেন এবং সম্পর্কচ্ছেদের আহবান জানিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হুলিয়া-গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় রেখে পাকিস্তানী স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে সারা বাংলা চষে বেড়িয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজি রেখে আগরতলা ষড়যন্ত্রে জড়িয়েছিলেন। এসব ছিল একজন জাতীয় বীরের জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন। যা আজকের প্রেক্ষাপটে ভাবা যায় না।
সাধক কাজী নজরুল মাথার ওপর শত শত গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে অবিভক্ত বাংলায় আন্দোলন-সংগ্রামে লেখনির মাধ্যমে মদত দিয়েছিলেন-যা বাঙালি জাতির জন্যে চিরদিন প্রেরণা হয়ে ছিল-আছে-থাকবে।
তিতুমীর স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ দু:শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জানতেন সাম্রারাজ্যবাদের আধুনিক সমরাস্ত্রের কাছে পরাজয় নিশ্চিত। তবুও জেনে-শুনে আত্মবিশ্বাসের বলে বলিয়ান হয়ে বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজ দু:শাসনের জবাব দিয়েছিলেন। হাজী শরিয়তুল্লাহ জমিদার-মহাজনের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। দাড়ি রাখা কর প্রথার বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। এসবই এক  এক আদর্শ ও দেশাত্ববোধের প্রেরণা।
তাদের উত্তরসূরি আমরা। কেন সেই বাঙালিরা আজ এত দূর্বল? কেন তারা আজ নানা ক্ষেত্রে ছন্নছাড়া? ভীতি বিহবল, নানা শংকা কেন তাদের আজ আচ্ছন্ন করে রেখেছে? কেন তারা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে? কেন তারা আজ নীরব, নিথর, নিশ্চল, জিম্মি? বিভক্ত আদর্শবোধ, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মবোধ কি এর জন্য দায়ী ?

শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৬

কবে হবে............ ৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস



কবে হবে............
৭ মার্চস্বাধীনতা দিবস
২৫ মার্চগণহত্যা দিবস

* রাজনৈতিক সংকীর্ণতা এবং নৈতিক দুর্বলতার উর্দ্ধে উঠে সরকার কি পারবে সত্যকে পরমসত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে?
সংলাপ ॥ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) প্রায় দশ লক্ষ সংগ্রামী জনতার সমাবেশে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। তাঁর ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’-এই ঘোষণার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বাক্ষী লক্ষ  মানুষ এখনো বেঁচে আছেন এবং তাঁরা গর্বের সঙ্গে সেই দিনটির কথা স্মরণ করেন। আর সেই স্বাধীনতার আহ্বানের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। প্রস্তুতি নিচ্ছিল সশস্ত্র যুদ্ধের। ১৯শে মার্চ ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় বাঙালি সৈনিক ও জনতার সশস্ত্র যুদ্ধ, বর্তমানে গাজীপুর চৌরাস্তার জাগ্রত চৌরঙ্গী আজও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই অমর স্মৃতি বহন করছে। তাই জাতি চায় ৭ই মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা হউক যার মধ্য দিয়ে অবসান হবে বহু মিথ্যাচার এবং স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তির। সত্যকে পরমসত্যে প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলার বাঙালিকে আবার এক হতে হবে। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলার বুকে শান্তি (ইসলাম)।
অপরদিকে, জাতির বাসনা ২৫শে মার্চের ভয়াল কালো রাতের স্মৃতিকে ধারণ করে দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হোক। কারণ, ওই রাতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনায় লক্ষাধিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এই গণহত্যায় এক রাতে নিহত হয় ৫০ হাজারেরও বেশি লোক।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সেই বর্বরতা বিশ্বেও গণহত্যার ইতিহাসে এক ভয়াবহতম ঘটনা। ওই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস, দলিলপত্র, ভিডিও বা ছবি দেখে বিশ্ববিবেক চিরদিন অপরাধীদেরকে ধিক্কার জানাতে পারবে। মানুষ ও মানবতার পক্ষে দাঁড়াবে বিশ্ববিবেক। এর মধ্য দিয়ে আরও জোড়ালো হবে গণহত্যায় যুক্ত পাকিস্তানী বাহিনীর বিচারের দাবি। ২৫শে মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে আসছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এক শ’ বছর আগে সংঘটিত আর্মেনিয়ার গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য সে দেশের সরকার ও জনগণ সম্মিলিতভাবে কাজ করে ৯ই ডিসেম্বরকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা আদায় করেছে।  
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। সম্প্রতি লাহোরের একটি শিশু পার্কে জঙ্গীদের বোমা হামলায় অর্ধ শতাধিক নিরীহ নারী-পুরুষ নিহত এবং তিন শতাধিক আহত হয়েছে। বলতে গেলে বর্তমান বিশ্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিই তথাকথিত ধর্মের নামে জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকের স্থান লাভ করেছে। ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে আজকে জঙ্গীবাদ যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে পাকিস্তানেরই বিভিন্ন গোষ্ঠী। মার্কিন যুক্তরাষ্টের পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি এক সংবাদ বিশ্লেষণে লিখেছে, আইএসসহ বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর উত্থানে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাত রয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র হিসেবে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর পাকিস্তান যে কত বড় বর্বর তা বাঙালি জাতিকে চরম পরীক্ষা দিয়ে টের পেতে হয়েছিল ১৯৭১ সালে, বিশেষ করে ২৫শে মার্চের পর। ২৫শে মার্চের সেই বর্বরতার ইতিহাস গোটা বিশ্বকে জানানোর জন্য এই দিনটিকে বাংলাদেশের গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা তাই এখন সময়ের দাবি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য এসব বিষয়ে বর্তমান সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ আশা করছে সচেতন দেশবাসী। বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনটিই হচ্ছে ৭ই মার্চ, বলা চলে বাঙালি জাতিরই শ্রেষ্ঠ দিন এই ৭ই মার্চ। এই দিনে কোটি কোটি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কথাটিই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল। ৭ই মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাঙালির প্রতিটি ঘরে এই দিনটিকে উৎসব হিসেবে পালন করা না হলে বাঙালির জীবনে সত্য কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর এর কারণে মিথ্যাচার ক্রমেই দানা বেধে উঠবে, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরাই শক্তিশালী হবে, ব্যাহত হবে দেশ ও জাতির অগ্রগতি। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত বলেই তাদের কাছে সচেতন মহলের প্রত্যাশা- একদিকে বাঙালির জাগরণের দিন এবং এই কারণে বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তানীদের পরিচালিত-‘অপারেশন সার্চ লাইট’সহ সকল গণহত্যাকে স্মরণ করার জন্য ৭ই মার্চকে স্বাধীনতা দিবস এবং ২৫শে মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক।