মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগুতে হবে দৃঢ় চিত্তে



মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে
এগুতে হবে দৃঢ় চিত্তে

সংলাপ ॥ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যরা ১২ জানুয়ারি রোববার বিকেলে বঙ্গভবনের জনাকীর্ণ দরবার হলে শপথ নিলেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদের কাছে। শুরু হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকারের যাত্রা। দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে এদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া স্বাভাবিক কারণেই বেশি। দেশি-বিদেশি নিন্দুক ও সমালোচকেরা যে যাই বলুক বাংলাদেশকে যারা নিজের দেশ বলে জানে, মায়ের মতো ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে তাদের কাছে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি অনেক কাঙ্খিত ছিলো এবং এই সফল অনুষ্ঠানটি বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দেখে স্বস্তিও বোধ করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটি যদি না হতো, এদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে এবং রাজনীতির অঙ্গণে যে আরো কত দুর্ভোগ, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হতো তা ভাবতে গেলেও আতঙ্কিত হতে হয়। আপাতত সেই আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে - সেটাই এই মূহুর্তের সবচেয়ে বড় আনন্দ। বাংলাদেশের ইতিহাসের এ যেন আরেক মাহেন্দ্রক্ষণ। মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের সাথে সাথে বিরোধী দলের লাগাতার অবরোধ হরতালেরও আপাত অবসান হয়েছে। তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন এবং তারই হাতের এই মন্ত্রিসভা যথেষ্ট ঝকঝকে-তকতকেও। বিতর্কিত কোনো নেতাকেই স্থান দেয়া হয়নি এ মন্ত্রিসভায়। শপথ গ্রহণের পর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো ধরনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গভবনের খোলা মাঠে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'শেখ হাসিনা কোনো চাপের কাছে কোনোদিন মাথা নত করেনি। আগামীতেও করবে না। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন সরকার গঠিত হলো। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই হবে নতুন সরকারের লক্ষ্য।'  দেশি-বিদেশি যেসব শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি এবং এখনো পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে এদেশের বিরুদ্ধে এবং এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে, কেবল তারাই একেক সময় একেক অজুহাত দেখিয়ে এদেশের মানুষকে অস্বস্তিতে রাখতে চায়। দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে, বাংলাদেশ বিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রটি বেশ শক্তিশালী। এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেই দেশটি ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছিল এবং বাংলাদেশ আজও বিশ্বের বুকে টিকে আছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে।
১৯৭১-এ ৭ই মার্চের ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।' আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি যখন সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ২৩ সেপ্টেম্বর এক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, 'স্বাধীনতা প্রত্যয়টির কোন সীমা পরিসীমা নেই। যুদ্ধে ও শান্তিতে উভয় পর্যায়েই এর প্রাসঙ্গিকতা অপরিহার্য। শত্রুকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়ার পাশাপাশি তাই আমাদের শহীদদের রক্তের উপযুক্ত সম্মান দিতে পারে এমন সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও করতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামে ও নগরে যেসব তরুণ এখন যুদ্ধ করছে তারা শুধু বিদেশী হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করার জন্যই লড়ছে না, বিশেষ সুবিধা ও অবিচারমূলক ব্যবস্থা নির্মূল করার জন্যও তারা লড়ছে। আমরা এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সংগঠিত হবে 'সকল নাগরিক সমান-এই মৌলনীতির ভিত্তিতে।'   (তথ্যসূত্র:তাজউদ্দিন আহমদ স্মারক বক্তৃতা, জুলাই ১৯৯০- আতিউর রহমান)।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন বলতে যা বোঝায় তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বঙ্গতাজ তাজউদ্দিনের ১৯৭১ সালের ভাষণসমূহ থেকে সহজেই স্পষ্ট। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে যে এখনো স্বাধীন হতে পারেনি তার সর্বশেষ উদাহরণ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গড়ে তুলে প্রগতিশীল, ধার্মিক ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। দেশের এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতত্বাধীন সরকারের সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদদের স্বপ্নের মতো একটি দেশ গঠনে এই সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে অতীতের সকল ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে। এই নতুন সরকারের পথ চলার শুরুতে তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থায় আরও একটি শুভ দিক হচ্ছে, যেসব বিদেশি শক্তি এদেশের অভ্যুদয়ে সরাসরি সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছিল তারা আবারো নতুন উদ্যমে সমর্থন ও প্রেরণা যোগাচ্ছে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের পরম বন্ধু রাশিয়া এবার ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়েছিল। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে এসেছিল ভুটান ও ভারতীয় প্রতিনিধি এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় তারা স্বস্তি প্রকাশ করে গেছেন। গত রোববার শপথ গ্রহণের পর পরই নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। শপথ শেষে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ফেরার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাকে টেলিফোন করে ১০ মিনিট কথা বলেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী দু'দেশের মধ্যে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি এবং অমীমাংসিত দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'ভারতের সরকার ও জনগণ যে কোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের পাশে থাকবে।'  এদিকে গত সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণ করার পর শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (গণমাধ্যম) মাহবুবুল হক শাকিল জানান, 'ফোনে প্রণব মুখার্জি বলেছেন, 'দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার হবে। পারস্পরিক সুসম্পর্কের ভিত্তিতে দুই দেশ সামনে এগিয়ে যাবে।' উল্লেখ্য ভারতের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জ্যেষ্ঠ নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান।
তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় ভারতের পর চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং অভিনন্দন বার্তায় শেখ হাসিনাকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় চীনের জনগণ ও আমার পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।' চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বাংলাদেশ-চীন ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। সামপ্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন  ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও বেড়েছে। আমি আপনার প্রতি এ সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাই, যাতে বাংলাদেশ-চীন ব্যাপক এবং সমবায় অংশীদারির ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে একটি নতুন জায়গায় পৌঁছাতে পারে।'
'বিপদেই বন্ধুর পরিচয়'-বাংলা ভাষার এই প্রবাদ বাক্যটি স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও এদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে আবারো সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। যারা দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন তারা এই সত্যটি ধারণ করে এগিয়ে গেলে অবশ্যই দেশ এগিয়ে যাবে, লাখো শহীদের স্বপ্নের মতো একটি অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা অবশ্যই সফল হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন