বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

আলোর পথে যাত্রা হোক শুরু



আলোর পথে যাত্রা হোক শুরু

সংলাপ ॥ জীবন থেকে বিদায় নিল আরো একটি বছর। ২০১৩ বছরটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত। এই বছরটিকে বাঙালি জাতির কলঙ্ক মোচনের বছর বললেও ভুল হবে না। হ্যাঁ, ২০১৩ সালে কিছুটা হলেও কলঙ্ক মোচন হলো বাঙালি জাতির। এই কলঙ্ক মোচনের প্রেরণা দিয়েছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। গণজাগরণ থেকে উত্থিত প্রেরণায় দীর্ঘকাল বয়ে বেড়ানো পঙ্কিলতা থেকে মুক্তির পথে হাঁটা শুরু করলো বাংলাদেশ। ৪২ বছরের প্রতীক্ষার পর শহীদের রক্তে ভেজা বাংলায় সব আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ ও  দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা শেষে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হলো শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লাকে। এর মধ্য দিয়ে দেশ যেমন অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল  তেমনি মনোবল ফিরে পেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা। সুগম হলো বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকরের পথটিও । একই সঙ্গে দেশ আলোর পথে এগিয়ে গেল এক ধাপ।
'৭৫ এর পর থেকে মিথ্যাকে সঙ্গী করে অন্ধকারের দিকে হাঁটতে থাকে বাংলাদেশ। ধর্মান্ধতার অন্ধকারে ডুবতে থাকে সোনার বাংলা। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা আর বাংলার মানচিত্র দখল করে একদল বিশ্বাসঘাতক। '৭১ এর পরাজিতরা লিখতে শুরু করে বাংলার ইতিহাস! নির্বাসনে যায় মুক্তিযুদ্ধের মৌল  চেতনা। ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে ধর্ম ব্যবসাকে বৈধ করা হয়। 'জয়বাংলা'র স্থলে কায়েম করা হয় জিন্দাবাদের রাজনীতি। মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীরা। রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত হয় রাজাকার, আলবদর ও আলশামসরা। দালাল আইন বাতিল করে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। শহীদের রক্তে ভেজা বাংলায় মন্ত্রী করা হয় নিজামী-মুজাহিদদের। রাজাকারদের গাড়িতে ওড়ে জাতীয় পতাকা। এসব ঘটনা ছিল বাঙালি জাতির কলঙ্ক। জাতির কলঙ্ক মোচনে '৭১ এ বাঙালি যেভাবে এক হয়েছিল সেভাবেই এক হয়েছিল ২০১৩ সালে গণজাগরণে। তাই ২০১৩ স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাঙালির ইতিহাসে। 
২০১৩ সাল - সারাটা সময়জুড়ে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সহিংসতা। এ সময় দুটো বিষয় বেশি করে আলোচিত  হয়েছে। প্রথমটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্বিতীয়টি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। বিএনপি তথা ১৮ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাটা বছর আন্দোলন করেছে। একের পর এক হরতাল-অবরোধ দিয়ে হত্যা ও বিপন্ন করেছে সাধারণ মানুষকে। রাজনীতিতে ঘটেছে সন্ত্রাসবাদের প্রবেশ। এদেশের রাজনীতিতে দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে 'শান্তিপূর্ণ' সহাবস্থান ছাড়া সমঝোতা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্য এখানেই যে আমাদের রাজনীতিকরা এ সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আস্থাহীনতার অভাবে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলো না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা আন্তর্জাতিক আসরে প্রশংসিত হলেও আস্থাহীনতা যে একটি দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিতে পারে এবং বিশ্ব আসরে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে, ২০১৩ সালের বাংলাদেশের রাজনীতি তার বড় প্রমাণ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দুটি পক্ষ। একপক্ষে রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। আর অন্যপক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মব্যবসায়ী, ধর্মান্ধগোষ্ঠী ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। এ দুই ধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ছোট ছোট রাজনৈতিক সংগঠন, যারা এ পরস্পরবিরোধী দুই ধারার রাজনীতি সমর্থন করে, তারা বড় দু'টো  দলের পেছনে একত্রিত হয়েছে। ২০১৩ সালে দাবি ওঠেছে বাংলাদেশে রাজনীতি করবে কেবল তারাই যারা স্বাধীনতার পক্ষে। আলোর পথে বাঙালি জাতির এটিই সবচেয়ে বড় সাহসী পদক্ষেপ।
আসছে ২০১৪ সাল। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'তৃতীয়বারের মতো' প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। কিন্তু রাজনীতিতে স্থায়ী আবেদন রাখতে হলে তাকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে হবে। জোর করে ক্ষমতায় থাকার মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের মতামত নেয়া, তাদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখাই হওয়া উচিত রাজনীতির মূল লক্ষ্য। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১৪ সাল সরকারের জন্য হবে বহু কন্টকাকীর্ণ। সরকারকে বুঝতে হবে জনগণের ভাষা, সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, ফিরে যেতে হবে ওয়াদা মতো '৭২ এর সংবিধানে।
বাঙালি জাতি আর কত রক্ত দেবে? আর কত কাল প্রতীক্ষা করবে? মেঘের আড়ালে আর কত কাল লুকিয়ে থাকবে সূর্য? মেঘের আড়াল ভেদ করে উজ্জ্বল সূর্য আমাদের আলোকিত করবে - এই প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে বাঙালি জাতি। আমাদের প্রতীক্ষা ব্যর্থ হতে পারে না। এবার যাত্রা হোক শুরু আলোর পথে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন