মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪

সময়ের সাফ কথা .... সংকটের মূলে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি



সময়ের সাফ কথা ....
সংকটের মূলে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি

সাদি ॥ 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সঠিক পদক্ষেপ। আর দেশে যে সহিংস রাজনীতি চলছে, সেটা মোকাবিলায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দুই দলকে আলোচনায় বসে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি জামাতের সঙ্গে কোনো সংলাপ কিংবা সমঝোতা করা যাবে না। কেননা, দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, তার মূলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামাত। এ সংকট কাটাতে জামাতসহ দেশের সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায়ের বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে হবে।'
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত - 'সহিংস রাজনীতি, সংকটে দেশ, ভবিষ্যৎ ভাবনা' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে গত শনিবার বিশিষ্ট জনেরা এমন মত দিয়েছেন। রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত। এতে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের মারা হচ্ছে। একে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়া আর কী বলা যায়!  বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, '১৯৯৬-এর নির্বাচনের সঙ্গে অনেকে এবারের নির্বাচনকে এক করে ফেলছেন। কিন্তু সেবার ভোট পড়েছিল মাত্র ২৬ শতাংশ'। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন হয়ে যাওয়া ঠিকই হচ্ছে। না হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, লক্ষ্য যদি এক না থাকে, তাহলে সংলাপ বিফল হবে। ১৯৭১ সালেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপি জামাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। তাহলে তারা কি জামাতের কাছে বাঁধা পড়ে গেছে? সে কথা তাদের বলতে হবে। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, যারা সন্ত্রাস করছে তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সন্ত্রাস দমন ও জনকল্যাণমূলক রাজনীতিতে সম্মত হলেই সংলাপ হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রশ্ন রাখেন, 'সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, ভোটার হত্যা করে কি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়?' চলমান রাজনীতিকে সহিংস রাজনীতি না বলে সন্ত্রাসের রাজনীতি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, শুধু জামাতকে নয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে না। সংকটের মূলে রয়েছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি।
অধ্যাপক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বড় বড় পত্রিকা ও সুশীল সমাজের অনেকেই বলছেন, নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হবে। সংলাপ করতে হবে। কিন্তু কেউ বলছে না, আগে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, তারপর আলোচনা হবে, তারপর নির্বাচন করতে হবে। জাফর ইকবাল বলেন, 'যাঁরা নির্বাচন বন্ধ করার কথা বলেন, সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করার কথা বলেন, তাঁরা আসলে জামাতকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে চান। আমি এতে খুবই হতাশ হই।' তিনি বলেন, দেশের একটি উপজেলায় জামাতকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক হয়েছে। সারা দেশে কেন এই রোল মডেল করা যাচ্ছে না?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আব্দুল মান্নান বলেন, এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে। আরেকটি বড় কারণ বাংলাদেশকে আবারও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা।
সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিএনপির এখন স্বীকার করা উচিত যে, তাদের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। তারা নির্বাচন বন্ধ করতে পারেনি। তারা মনে করেছিল হয় গণ-অভ্যুত্থান হবে, নয়তো সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেবে। কোনোটিই হয়নি। আবার বিএনপিকে নির্বাচনে না আনতে পারা সরকারের ব্যর্থতা।
বৈঠকে অনেকেই গত ২৯ ডিসেম্বর নাগরিক সমাজের চারটি সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সংলাপের সমালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে ওই সংলাপের অন্যতম সহ-আয়োজক টিআইবির ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে আমরা কখনোই জামাতের অংশগ্রহণকে বুঝাইনি। বরং বলেছি, বিএনপির মতো দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।' তিনি আরও বলেন, এবারের নির্বাচন সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বৈধ।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঐক্য দুই ধরনের হয়। অভিন্ন লক্ষ্য থেকে ঐক্য আর অভিন্ন ঝুঁকি থেকে ঐক্য। আমাদের এখন ঝুঁকির কারণেই ঐক্য করতে হবে। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, বিরোধী দলের সে সুযোগ নেওয়া উচিত। আর সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আলোচনা হোক, সমঝোতা হোক। আর সংঘাত বন্ধ করার একমাত্র সমাধানই হলো আলোচনা করা। দুই নেত্রীর কাছেই এখন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, 'এত দিন আমরা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেশনের কথা বলতাম, কিন্তু এখন দেশে রাজনীতিতেও সিন্ডিকেশনও হয়ে গেছে। ১৮-দলীয় জোট, ১৪-দলীয় জোট। জোটের কারণেই বড় দলগুলো অনেক কিছুই করতে পারে না।'
তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম বলেন, জামাতের নেতাকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসা হচ্ছে। কেন নেতাদের দিয়ে এ কাজ করা হচ্ছে? বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, 'সারা দেশে জামাতের চলমান সহিংসতার মধ্যেও দেশে জামাতের নেতাকে বরণ করে নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের একজন নেতা। তাঁকে এখন পর্যন্ত বহিষ্কারও করা হয়নি। সরকারের এমন দু'মুখো আচরণ কেন?'
দেশের অনেক স্থানেই আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় জামাত বেড়ে উঠেছে মন্তব্য করে সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, 'সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাই জামাতের আমির। তাঁর মা জামাতের রোকন। সেখানে কেন তাঁকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে মনোনয়ন দেয়া  হয়েছে?' তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি যদি হয় শুধু ভোটের রাজনীতি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিকবে না।
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী, সব্যসাচী লেখক ও সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন অর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহমেদ আল কবীর, নারীনেত্রী রোকেয়া কবীরসহ মোট ২৮ জন বক্তব্য দেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন