বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

রাজনৈতিক অঙ্গনে সত্যের অন্তর্দ্ধানে - অর্ধ সত্য ও মিথ্যার কাইজায় জাতি বিভ্রান্ত


রাজনৈতিক অঙ্গনে সত্যের অন্তর্দ্ধানে

অর্ধ সত্য ও মিথ্যার কাইজায় জাতি বিভ্রান্ত


Ø তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং মিথ্যাকে ব্যর্থ করেন-যদিও অপরাধীরা ইহা অপছন্দ করুক না কেন। ৮ঃ৮।

Ø আমরা তাহাদিগকে কর্ণ, চক্ষু এবং হৃদয় দান করিয়াছিলাম। কিন্তু তাহাদের কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় কোন কিছুই তাহাদের উপকারে আসিল না, কারণ তাহারা অস্বীকার করিত এবং যে আজাব লইয়া তাহারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিত উহাই তাহাদিগকে পরিবেষ্টন করিয়া ফেলিল। ৪৬ঃ২৭।

 
·        দারিদ্র্য - মুক্তিযুদ্ধ - ধর্ম - নারীঃ রাজনীতির পণ্য বৃত্ত থেকে বের করে আনতে হবে।

·        বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূলে পৌঁছাতে হবে আত্মপরিচিতির বিনির্মাণে।

·        ধর্মকে আধুনিক চিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে জাতির উপলব্ধি বেগবান করতে। 

 
শেখ উল্লাস ॥ অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা আজ সত্য যে, এদেশে বর্তমানে যে রাজনীতি চলছে তার মূল উপজীব্যই হচ্ছে ধর্ম, দারিদ্র্য, মুক্তিযুদ্ধ অথবা নারী। কথাটা এভাবে বললে হয়তো আরও স্পষ্ট হয় যে, রাজনীতিজীবী বা রাজনীতিকরা এই ধর্ম, দারিদ্র্য, মুক্তিযুদ্ধ এবং নারীকে রাজনীতির পণ্য বানিয়েছে এবং এই পণ্য বাজারজাতকরণের কাজটা যে যতটুকু মিথ্যা ও অর্ধসত্যের মধ্য দিয়ে সূক্ষ্মভাবে করতে পারছে সে ততটুকু সফল হচ্ছে রাজনীতিতে।  এই অবস্থার মধ্যে রাজনীতি এবং  রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচালিত কর্মকান্ডে রাজনীতিকদের মধ্যে কেউ কেউ শতভাগ মিথ্যাচার করছে, কারো কারো মধ্যে সত্য-মিথ্যার-রসায়নে অর্ধসত্য রয়েছে। অর্ধসত্য আর মিথ্যার কাইজায় দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জনগণের দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। জনগণ সত্যটা জানে তাই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠছে এবং এই সুযোগে অনেক ক্ষেত্রেই অযোগ্য, অদক্ষ, লুটেরা, ব্যবসায়ী ও গণবিচ্ছিন্ন ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থানগুলো দখল করে নিচ্ছে।

রাজনীতিতে সত্যের অন্তর্দ্ধানে দারিদ্র্য, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, ও নারী  রাজনীতিতে পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত ও দরিদ্র এবং এই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়ে তারা অসহায় বলে তাদেরকে অতি সহজেই কাবু করতে পারছে গণতন্ত্রের নামে লুটেরা গোষ্ঠী। পরিণতিতে একজন যথার্থ স্বাধীন ও  সত্যের পূজারী সচেতন মানুষ হিসেবে সমাজে বাস করতে পারছে না।

এই সুযোগটি ব্যবহার করেই রাজনীতিজীবী এবং রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্রের ফাঁদে ফেলে মিথ্যার আশ্রয়ে ধর্মকে রাজনীতির পণ্যে পরিণত করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে এই দেশে। এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু ধার্মিক নয়। ধর্মের মর্মকথা তাদেরকে জানানো হয়নি। বেশিরভাগ ধর্মবেত্তা ও ধর্মজীবীরাও ধর্মের মর্মকথা জানে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জানলেও তাদের কায়েমী স্বার্থেই ধর্মের আসল কথাটা ধর্মভীরু জনগণকে জানাতে চায় না। এই সুযোগটিও ব্যবহার করছে রাজনীতিজীবীরা। ধর্মও এখন এদেশে একটি পণ্য হয়ে উঠছে সমাজে। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে, ধর্মের নামে বিশেষ করে পবিত্র ‘ইসলাম’ শব্দটি ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে হাজারো প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি। এতে করে সমাজের কিছু কিছু লোকের আর্থিক প্রভাব প্রতিপত্তির বিকাশ ঘটলেও অধিকাংশ লোকের জন্য তা এক বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে এবং এইভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্যপূর্ণ সমাজে রাজনীতিজীবীদের পণ্য হচ্ছে ধর্ম এবং তা বাজারজাত করণে মাঠে নেমেছে মিথ্যার ঝুড়ি নিয়ে রাজনীতিক, ধর্মজীবী ধর্মান্ধ রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা।  ১৯৭১ সালে দেশপ্রেম ও সমাজ সচেতন চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ যে অংশটি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল স্বাধীন দেশে তাদেরকেও যথাযথ মূল্যায়ন ও পুনর্বাসন না হওয়ায় তাদের অধিকাংশই এখন সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪২ বছর ধরেই দরিদ্র ধর্মভীরু মানুষ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের রাজনীতিতে শুধু ভোটের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাংঙ্খিত বাংলাদেশ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক যে নারী সমাজ তারা বর্তমানে অর্থনীতির বিরাট চালিকাশক্তিতে পরিণত হলেও তাদেরকে পশ্চাতে নিয়ে যাওয়ার গভীর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে ধর্মজীবী, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীরা এবং এই অপতৎপরতা থেকে তাদেরকে মুক্ত করার কোনো দৃঢ় ও যথাযথ ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। ফলে নারী জাতির যথাযথ সম্মানও প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না এবং তারা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের অপব্যাখ্যার শিকার হয়ে ও রাজনীতির পণ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতির যাত্রাও মন্থর হয়ে পড়ছে এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে দেশ ও সমাজ আরও পিছিয়ে যাবে। বিকৃত চিন্তাচেতনার অধিকারী অশিক্ষিত ধর্মজীবী ও ধর্মান্ধদের রাজনীতিক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পথই শুধু সুগম হবে।

উত্তরণের জন্য আজ প্রয়োজন ধর্ম, দারিদ্র্য, মুক্তিযুদ্ধ ও নারীকে পণ্য বানানোর যে ন্যাক্কারজনক প্রতিযোগিতা চলছে এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও সমাজপতিতের মধ্যে তাদেরকে রুখে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে কারা এই ন্যাক্কারজনক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তা সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সচেতন ও দেশপ্রেমিক কারোরই অজানা নয়। এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা এদেশের লাখো নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, নারী নির্যাতন করেছে, লুটপাট করেছে তা কারোরই এখন অজানা নয়। আর যারা এই অপরাধীদেরকে বাঁচাতে আজ বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করছে তারাও অপরাধের জালে জড়িয়ে পড়ছে। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও তারা প্রকৃতপক্ষে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-রাজাকারদের সহযোগী ছাড়া কিছু নয়। তারাই মূলত ধর্ম, দারিদ্র্য, মুক্তিযুদ্ধ ও নারীকে পণ্য বানিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে বাংলাদেশকে ধর্মীয় সন্ত্রাসের চারণভূমি করে রাখতে চায়। তাদের মুখোশ জনগণের সামনে আবারো যথাযথভাবে উন্মোচনে নতুন প্রজন্ম মাঠে নেমেছে। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আজ সময়ের দাবি। আর তা না করা হলে দেশ ও জাতির জীবনে  অন্ধকার নেমে আসতে বাধ্য।

কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারি দল এই ধর্ম, দারিদ্র্য, মুক্তিযুদ্ধ ও নারীকে পণ্য বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত নয়-কথাটি পূর্ণ সত্য নয়, বলা যেতে পারে অর্ধসত্য। এই দল ও সরকারের ভেতরেও এখন ঢুকে পড়েছে অনেক নব্য রাজাকার যাদের সাথে এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের যোগসাজশ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের একটি শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে বাধা-বিঘ্ন তৈরি করাই এদের কাজ। এদের পূর্বসূরীরা স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে রেখে শেষ পর্যন্ত একটি ১৫ই আগষ্ট সৃষ্টির যাবতীয় আয়োজন করতে সফল হয়েছিলো। এরাই কথিত হেফাজতীদেরকে ঢাকায় আসার সাহস ও শক্তি যুগিয়ে একটি অনাকাঙ্খিত ও বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এই সরকারের জন্য, যে সরকারের বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার মূল নিয়ামক শক্তিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর নতুন প্রজন্ম।  

এদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। জনগণের এই ধর্মভীরুতাকে পুঁজি করেই সংবিধানে আজ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সন্নিবেশিত রয়েছে। ইসলাম অর্থই শান্তি। এটি মানবজাতির একটি সর্বজনীন ধর্ম এবং সাম্যের ধর্ম। এই ধর্মে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। এই ধর্ম যেখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত সেখানে কোনো বৈষম্য, বঞ্চনা, শোষণ, নিপীড়ন থাকতে পারে না। যদি তা থাকে এবং তা দূর করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তবে তা হবে ইসলাম অবমাননা, ধর্মভীরু বাঙালি জাতির ধর্মীয়?অনুভূতিতে আঘাত। বাঙালি জাতির দারিদ্র্য, ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধ ও নারীকে নিয়ে রাজনীতির পণ্য করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে?  সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ জাতি দেখতে চায়।?সমাজের সকল বৈষম্য দূর করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সাম্যবাদী ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণই হোক সরকারের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার। তবেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সন্নিবেশ করাটা সরকারের সত্য  পদক্ষেপ   বলে পরিগণিত হবে। আর তা না হলে ধর্মকে পণ্য করার অভিযোগে বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও অভিযুক্ত হবেন  এবং দেশ ও জাতির কাছে তাদেরকেও একদিন জবাবদিহি করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন