’৭২-এর
সংবিধান বিরোধী কারা?
সংলাপ ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের এক
বছর পার হওয়ার আগেই একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন জাতীয় সংসদে ১৯৭২
সালের ৪ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সেজন্য দিনটি
সংবিধান দিবস হিসেবে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। সদ্য স্বাধীন
দেশে ওই সংবিধানটিতে (যা ’৭২-এর সংবিধান হিসেবে পরিচিত) ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম
রাষ্ট্রের চলার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা। বিশেষ করে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত
দেশটির উঠে দাঁড়ানোর মতো নীতি ও আদর্শ যেমন - গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা
ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে করা হয় রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি। স্বাধীনতাবিরোধী দেশী-বিদেশী
অপশক্তি এবং তাদের দোসররা যেহেতু তখন গর্তের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল এবং দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি
নিয়ে কোনো কথা বলার শক্তি সামর্থ্য তাদের ছিল না সেহেতু ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিগুলোর
বিরুদ্ধে কোনো কথাও তখন শোনা যায়নি। দেশের মানুষ যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল সর্বাত্মকভাবে, যাবতীয়
ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিল নয় মাস স্বপ্নের একটি দেশ গড়ে উঠার প্রত্যাশায়
- ’৭২-এর সংবিধানের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল অকুন্ঠ।
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান এবং তারই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন
পর পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা
বিরোধীরা গর্ত থেকে বের হয়ে আসতে থাকে এবং এদেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের অবস্থান শক্ত
করে লিপ্ত হয় চক্রান্তে-ষড়যন্ত্রে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে
হত্যার মাধ্যমে এদেশকে আবারো পাকিস্তান বানাবার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ’৭২-এর সংবিধানের
মূলনীতিগুলোকে ধুয়ে মুছে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন নিশ্চিহ্ন করতে এবং বাঙালি জাতিকে
দারিদ্র্য, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ধর্মান্ধ করে তুলতে ’৭২-এর সংবিধানকে মুছে দেয়ার চাইতে
মোক্ষম কোন উপায় তাদের কাছে বুঝি আর একটিও ছিল না! এক্ষেত্রে এই ৭২’-এর সংবিধানের বিরোধীরা
যথেষ্ট সফলই হয়েছে বলা যায়। সামরিক শাসন, স্বৈরাচারি শাসন
ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করে রাখতে ধর্মের নামে যাবতীয় অধর্মের কাজ করেছে ’৭২-এর সংবিধান বিরোধীরা। ২০০৯ এর জাতীয় সংসদের
অধিবেশনে সংসদ নেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ’৭২-এর সংবিধান
আজ পর্যন্ত দেশে কায়েম থাকলে স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরে এসে দেশের অবস্থা অন্যরকম হতো।
দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো।
কিন্তু সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা
জিয়া, বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ’৭২-এর সংবিধানের
বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন। অবশ্য তাদের কাছ থেকে উল্টোটা আশা করাও বৃথা। কারণ, ’৭২-এর
সংবিধান বলবৎ থাকলে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে এদের অস্তিত্ব ও বিকাশতো দূরের কথা, উদ্ভবই
হতো না। যেমন থাকে না আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকারের অস্তিত্ব। ’৭২-এর সংবিধান তাই ওদের
কাছে আতংক। এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ওদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের যবনিকা। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানের
নাম যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কেননা, ঐতিহাসিক ৬ দফা আর ১১ দফার মৌল চেতনার আলোয় ’৭০-এর
ঐতিহাসিক নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধান যাতে প্রতিফলন
ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদদের স্বপ্ন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণ আকাক্সক্ষার।
তাই ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার এই দুর্লভ সুযোগে একথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলার সময়
এসেছে যে, ’৭২-এর সংবিধান মানে মুক্তিযুদ্ধ - মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর বিরোধিতা মানে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা (যা ওরা করেও ছিল একাত্তরে
প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে)। ’৭২-এর সংবিধানের বিরোধিতা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। মুক্তিযুদ্ধে
নেতৃত্বদানকারী আজকের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকারকে অবশ্যই এই কঠিন সত্যকে বিবেচনায়
নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে রাষ্ট্রদ্রোহীদের এবং যে কোন মূল্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক ’৭২-এর সংবিধানকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন