বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ১১


রাগানুরাগ ভক্তি জন্মালে ভক্ত গুরু ভিন্ন আর কিছু চান না। তিনি সর্ববিধ শাস্ত্রীয়-ধর্ম ত্যাগ করে মুক্ত হয়ে একমাত্র গুরুর সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্ত্রী, পুত্র বিত্ত সংসার প্রভৃতি জাগতিক বিষয়ের প্রতি ভালবাসা তার নিকট সাময়িক আদান-প্রদানসম্ভূত দোকানদারী কেনাবেচার নামান্তর বলে বোধ হয়। সাধারণভাবে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট জানা যায় যে, সাধারণত সন্তানের প্রতি মায়ের বা মায়ের প্রতি সন্তানের এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামীর বা স্বামীর প্রতি স্ত্রী ভালবাসাও ওই পর্যায়ভুক্ত। এটা প্রেম নামে অভিহিত হলেও এতে আদান-প্রদান-ভাব সুপ্ত থাকে বলে একে প্রেমজগতের ভালবাসার দেশ বলা যায় কিন্তু প্রেমজগতের প্রকৃত পরমপ্রেম বলা যায় না। দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতা-সন্তান ও স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের নিকট যা আশা করে, তা না পেলে তাদের মধ্যে সম্বন্ধ শিথিল হয়। গুরুতে রাগাত্মিক সম্পর্কে কোন প্রকার আদান-প্রদান নেই। এখানে আকর্ষণ আর ব্যাকুলতার মধ্যের খেলা, প্রেমের জন্যে প্রেম, ভালবাসার জন্যে ভালবাসা, একের সঙ্গে একের একাত্মতা, সত্যের সাথে সত্যের একাত্মতা। এটাই পরমপ্রেম বা প্রেমজগতের সর্বোচ্চ প্রেম বা নিঃস্বার্থ ভালবাসা, পরমচেতনা, পরমসত্য। এরই নাম চিরন্তন সম্পর্ক প্রেমজগতের শান্তির দেশ। এখানে আছে শুধু ভক্তিভাব মহাভাব। প্রেমজগতের এই ভক্তিভাব স্তরে প্রেমাস্পদকে ভক্ত কেবল একাত্মতায় আকর্ষণ করেন, ব্যাকুলতা ছাড়া তার আর কিছু থাকে না। প্রেমাস্পদের নিকট তার চাওয়া বা পাওয়ার কিছু থাকে না। প্রেমাস্পদের নিকট প্রার্থনা করেন না। রাগাত্মিক প্রেমের উদয় হলে প্রেমিক হয়। ভালবাসা ক্রীতদাসের ভালবাসার ন্যায় ভালবাসার ভানমাত্র। লোভে ভালবাসা স্বার্থান্ধ। রাগাত্মিক প্রেমে গুরু পরম প্রেমাস্পদ; তাঁর স্মরণ, সংস্পর্শ, সান্নিধ্য আর দর্শন ভক্তের জীবন চলার পথের পাথেয়। ভক্তিতেই প্রেমিক। মুখের কথায় নয়। প্রেমিকের প্রেমাঞ্জনমন্ডিত চোখে গুরুর মতো সুন্দর আর কিছু নেই। ভক্ত সেই চিরসুন্দরের অস্তিত্বে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ধরে রাখেন; তাঁর অস্তিত্বের কোন প্রমাণ চান না। প্রেমিকের নিকট প্রেমের প্রেমাস্পদ প্রমাণ গুরুই। তিনি সর্বশক্তিমান কি না, প্রেমিক তা বিচার করবার আবশ্যকতা বোধ করেন না। তার নিকট গুরু প্রেমময়, পরম প্রেমস্বরূপ। প্রেমিক শত দুঃখ বরণ করেও প্রেমাস্পদের একাত্মে সর্বদা প্রস্তুত। প্রেমাস্পদের আনন্দে প্রেমিকের আনন্দ এবং প্রেমাস্পদের হাসিতেই প্রেমিকের প্রেরণা। প্রেমাস্পদকে একাত্ম করা ভিন্ন প্রেমিক অন্য কিছু কামনা করেন না।
গুরুর প্রতি যাদের আকর্ষণ জন্মেনি, অথচ শাস্ত্র-শাসন দুঃখ-বিমূক্তি ও শান্তি-সুখের জন্য যারা গুরুকে ভক্তি করেন, তাদের পক্ষে বৈধ সাধন উপযোগী। দীর্ঘকাল নিষ্ঠা সহকারে অনুষ্ঠানের ফলে গুরুর প্রতি আকর্ষণ জন্মিলে রাগানুগ সাধনের অধিকার হয়। স্মরণ, মনন ও ধ্যান এই সাধনের অঙ্গ। ভাব-ভক্তি, কল্পনাও আবেগমূলক। এতে গুরুর প্রতি আকর্ষণ আছে।
সংসারে এক ব্যক্তি অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে যে সকল ভাবাশ্রয়ে সম্বন্ধ স্থাপন করে, সে ভাব আধ্যাত্মিক রূপেরই ভাব। গুরু আনেকসময় এই ভাবগুলো আরোপ করে সাধন করতে উপদেশ দেন।
লক্ষ্য ভিত্তিক ধারণার পরিপক্ক অবস্থাই নিমগ্নতা। যেকোন এক বস্তুতে চেতনার জগৎকে আবদ্ধ করা এবং সেই বস্তুবিষয়ক জ্ঞান নিরন্তর এক ভাবে প্রবাহিত করা নিমগ্নতা। চেতনার সচেতন স্তরে কোন বস্তু-বিশেষ ধারণ করে তদ্বিষয়ক কতকগুলো বিশেষ বৃত্তি উৎপাদনের চেষ্টা করলে অন্যান্য বহু বৃত্তি চিন্তাজগতে উপস্থিত হয়। শেষোক্ত বৃত্তিগুলোকে অধ্যবসায় সহকারে নিয়ন্ত্রণ করলে প্রথমোক্ত বৃত্তিগুলো প্রাধান্য লাভ করে। সব বৃত্তিগুলো এক বৃত্তিমাত্রে সংযোজিত হলে লক্ষ্য সিদ্ধ হয়। চিন্তাকে এক লক্ষ্যে দশ সেকেন্ড ধারণ করা হলে তাতে একটা ধারণা হয়; এই ধারণা দশগুণ হলে একটা যোগ হয় এবং এই যোগ দশ গুণ হলে একটা সংযোগ হয়। সংযোগ পরিপক্ক হলেই নিমগ্নতা আসে। যিনি যে ধর্মমতে বিশ্বাসী বা যে ধর্মপথেই সাধন করুন না কেন, সাক্ষাৎ বা পরোক্ষ ভাবে নিমগ্নতার আশ্রয়ে ভক্তিভাব সকলের পক্ষেই গুরু-সর্ম্পকের জন্য বিশেষ আবশ্যক।
গুরু স্মরণে স্থূলনিমগ্নতা, জ্যোতির্ময়তা ও সূক্ষ্মনিমগ্নতা। এই তিনটা পর্যায়ক্রমে অধম মধ্যম এবং উত্তম। স্থূলনিমগ্নতায় পরিপক্কতা, কালক্রমে সগুণ নির্গুণ শূন্যে নিমগ্নতা জন্মে। নিমগ্নতায় বিতর্ক বিচার আনন্দ ও অস্মিতা অনুগত থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন