বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি….- ১


গুরু সত্যমানুষ। আমরা সবাই জানি যে গুরুর রাজ্যই হচ্ছে শিষ্যের বিচরণক্ষেত্র। গুরুভাবে গুরু ব্যাকুল মাতোয়ারা হয়ে তিনি সাথী ও ভক্তদের সঙ্গে কতো খেলাই না করেছেন এবং করেন দিবারাত্রি। সেই শুভ মুহূর্তগুলোতে উপস্থিত ভাগ্যবান ভক্তরা বিহ্বলচিত্তে এবং অনাবিল আনন্দে ওইসব দৃশ্য দর্শন করে। আবার তাদের মধ্যে বিশেষ চিহ্নিত মুষ্টিমেয় কেউ কেউ তাঁরই কৃপাবলে তাঁর কৃপাকল্পতরু রূপটি ধারণা করতেও সক্ষম হন। তিনি তাঁর ভাব ও রূপ কখনও প্রচ্ছন্ন রাখেননা, এটাই তাঁর ইঙ্গিত প্রকাশের একটি রূপ। গুরু নিত্য কল্পতরু, তাই তাঁর রূপটি ধারণ করে নিতে উপযুক্ত আধারের পক্ষে কোনও অসুবিধা হয়না। তিনি সদাই কল্পতরু। জীবকে কৃপা করাই তাঁর একমাত্র কাজ। তিনি নিত্যই জীবকে কৃপা করেন, তিনি কৃপাসিন্ধু, বিশেষ ভক্তরা বিশেষ ভাবে বুঝতে পারেন।
পরিবেশ মোতাবেক অনেকরকম সংশয়ের প্রধানতম কারণটি হলো গুরুর সহজ-সরল জীবনধারা, যার স্বরূপ তাঁর ওই কৃপা কল্পতরু রূপটি কখনও সর্বসমক্ষে প্রকটিত হয়ে ওঠেনা বা বলা যেতে পারে তিনি তা প্রকটিত হতে দেননা। তিনি তাঁর ভাব ও স্বরূপ সম্পূর্ণ গোপন করে রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর দিন কাটে অতি অনাড়ম্বর, দীনহীনভাবে এবং দুঃখবেদনা-জর্জরিত এই জাগতিক সংসারে এক সামান্য সংসারীরূপে। তাঁর এই বাইরের রূপটি সমস্ত বিভ্রান্তির উৎসস্থল। সম্পূর্ণ সংসারীর মতো বেশ ও আচরণ দেখে তাঁর প্রকৃত রূপটি ধারণা করা সাধারণ মানুষের সাধ্যের অতীত। গুরু অতি সহজ ও সাধারণ। বাইরের আচরণ দেখে তার অসাধারণত্ব বোঝা যায় না। ঘটনার বৈচিত্রে আড়ম্বর একেবারেই থাকেনা।
কেউ কেউ তাঁকে বিধাতা বা প্রভু বলে দেখলেও তিনি নিজে কিন্তু সে বিষয়ে একান্তভাবে অনাগ্রহী থাকেন, পরন্তু কেউ তাঁকে ওইভাবে প্রকাশ্যে দেখতে চাইলে তিনি তাকে নিরুৎসাহই করেন অথবা অতিযত্নে ওই প্রসঙ্গে এড়িয়ে চলেন, এমনকী কখনও কখনও ওই আলোচনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মূলে নির্মমভাবে আঘাত করেন।
গুরুর দু’টি রূপ। একটি সাধারণ মানবীর রূপ। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের মতো সামাজিক সকল বিধি ব্যবস্থাই মেনে চলেন, সাধারণ সংসারীর ন্যায় দুঃখ, কষ্ট, শোক, তাপ সবই অনুভব করেন। অপরটি অসাধারণ সত্যমানুষ রূপ-সাধারণ রূপটির অন্তরালে লুক্কায়িত রখেন। সংসারের সবই গ্রহণ করেন, কিন্তু এটা তাঁর বাহ্যরূপ; সংসারের সব কোলাহলের মধ্যে তাঁর চিন্তা সর্বদাই প্রশান্ত ও ঊর্ধ্বমুখী-বাকী সবই বহু নিচে পড়ে থাকে। সবকিছুর মধ্যে থেকেও তিনি কিছুতেই নাই। এটিই গুরুর সত্যমানুষ রূপ।
এই অসামান্য রূপটিই গুরু মহাভাবে গোপন রাখতে পারেন না, ঘনঘন ভাবাবেশে যার প্রকাশ ঘটে। ভক্তদের কাছে তাঁর প্রকৃত রূপটি প্রকাশ-অপ্রকাশই থেকে যায়। তাঁর কৃপালাভে বঞ্চিত থাকেন না ভক্তরা, থাকেন না তাঁর সদা প্রবাহমান স্নেহধারায় অবগাহন করে প্রশান্তি লাভ হতে বঞ্চিত। ভক্তরা অন্ধ হলে তিনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। অজ্ঞানতা থাকলেই প্রশ্ন, সংশয়, দ্বিধা। গুরুর কৃপাতেও কোন বিরাম নেই, সেই কৃপাবর্ষণ হচ্ছে অতি সংগোপনে, জাগতিক দৃষ্টির অগোচরে, প্রকাশ্যে নয়। কৃপাধন্য অন্তরঙ্গ ভক্ত ছাড়া গুরুর ওই কৃপাপ্রবাহের সন্ধান থাকে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের অতীত। গুরুর কৃপাবন্যার ধারা ভক্তদের কাছে সদা-সর্বদা প্রবাহমান।
রূপ ও ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রভেদ পরিলক্ষিত হলেও, গুরু-স্বীকৃত শিষ্যের কাছে সেই রূপ অভেদ ও অভিন্ন এই বিষয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ থাকে না। এই চরম সত্যটি তাঁরা উভয়েই বারবার নিজ মুখেই স্বীকার করে থাকেন। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। স্বীকৃত – শিষ্য গুরুর মতো একাধারে ভাব জগতে গুরুভাবে কোনও রকম কার্পণ্য না করে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় গুরুর মতো এক পথ অনুসরণ ও ষ্মরণ করে কৃপা বিতরণ করে যান। বাস্তবে তা সংঘটিতও হয়। কিন্তু তা উপলব্ধি করার জন্য যে অনুধ্যানের প্রয়োজন, সেটা বর্তমান সাধন ও চিন্তনপীঠগুলোতে একান্ত অভাব।
গুরু-স্বীকৃত শিষ্য সর্বদাই সচেতন। গুরুভাবে কোনও রকম বাছ-বিচার না করেই শত শত অভাজনকে স্থান-কাল-আধার ভেদে দীক্ষা দিয়ে তিনি কৃপা করেন ও তাদের সবকালের দায়-দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করে অশেষ যন্ত্রণাও ভোগ করেন। অভাজনকে আশ্রয় দিচ্ছেন। কৃপালাভ থেকে কাউকে বঞ্চিত করছেন না। যারা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন বা আসেন, তারা যেমন কৃপালাভ করেন, যারা আসতে পারেননি, তাদের জন্যও তাঁর কৃপাধারা একইভাবে প্রবাহমান।
কী অপার করুণা! যে গুরুর চরণে আশ্রয় লাভে নিজেকে বন্দী করেছে, সে-ই অনুভব করছে তাঁর কৃপা ও সংস্পর্শ। বাস্তবতার নিরিখে গুরু রূপেরই মহিমার প্রকাশ। গুরু রূপটিকে তিনি অতি যত্ন সহকারে প্রচ্ছন্ন রাখেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে তার ধারণা করা খুবই কঠিন। সব রূপেই গুরুর কৃপা কল্পতরু সত্যমানুষ রূপটির সবিশেষ পরিচয় লাভ করতে হলে গুরুর মুখ থেকে নিঃসৃত দৃপ্ত এবং সুস্পষ্ট কৃপাবাণীগুলো উপলব্ধি করায় নিমগ্ন থাকতে হয়। শান্তি ও সত্য অন্বেষণের পথযাত্রীরা সেটা ঠিকমতো অনুভব করতে না পারলে, সেটা তো তাদেরই অক্ষমতা!
যাকে দেবার, গুরুই (সত্যমানুষ) দেন। দুই ফকির শহরে ঘুরে বেড়াত। তাদের মধ্যে একজন সব সময় বলত : গুরু যাকে দেন, তাকে আর কে কী দেবে? আর এক ফকির বলত : ধনীরা যাকে দেন, গুরু তাকে আর কী দেবে? অর্থাৎ ধনীদের দয়াতেই যখন সবকিছু পাওয়া যায়, তখন গুরুকে আর কোনো দরকার নেই।
ঘুরতে ঘুরতে ওই দুই ফকির শহরের সেরা ধনীর বাড়ীতে এসে নিজেদের কথা শোনাল। ধনী ব্যক্তিটি প্রথম ফকিরের দিকে ফিরেও চাইলেন না। দ্বিতীয় ফকির, সে ধনী ব্যক্তিকে গুরুর চেয়েও বড়ো বলেছিল, তাকে তিনি কাছে ডাকলেন। ফকির ভাবলো, ধনী ব্যক্তিটি যখন আমার উপর খুশী হয়েছেন, তখন না জানি কত ধন-দৌলত আমাকে দেবেন। ধনী ব্যক্তিটি একটা তরমুজের ভিতর হীরে জহরত ভরে সেই তরমুজটা দ্বিতীয় ফকিরকে দিলেন। ফকির জানতো না তরমুজের ভিতরে মহামূল্য সম্পদ রয়েছে। তাই সে ভাবল, ধনী ব্যক্তিটির এত ধন-দৌলত থাকতে আমাকে কিনা সামান্য একটা তরমুজ দিলেন। এ তরমুজ আমি খাব না। এই ভেবে তরমুজটা বিক্রি করবে বলে সে এক ফলওয়ালার কাছে গিয়ে বলল: ‘পাঁচ টাকায় তুমি এটা নেবে?’ ফলওয়ালা দেখল এটা সে দশ টাকায় বিক্রি করতে পারবে : তাই দরাদরি না করে পাঁচ টাকায় সে ফকিরের কাছ থেকে তরমুজটা কিনে নিল।
এদিকে প্রথম ফকির ধনীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভিক্ষেয় বেরুল। ভিক্ষে করে তার জুটল দশ টাকা। সেই দশ টাকা নিয়ে সে বাজারে গেল আটা কিনতে, কিন্তু বাজারে গিয়ে হঠাৎ তরমুজ দেখে তরমুজ খাওয়ার শখ হলো। সে তখন ফলওয়ালার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো : ভাই, তোমার এ তরমুজের দাম কতো? ফলওয়ালা বললো : দশ টাকা। প্রথম ফকির দশ টাকা দিয়ে কিনে নিল তরমুজটা। খেতে গিয়ে দ্যাখে তার ভিতর মণিমুক্তো ঠাসা রয়েছে। ফকির তখন গুরুর উদ্দেশে বলতে লাগলো : ‘হে মালিক, তুমি যাকে দাও, তাকে এমনিভাবে তরমুজ ভরতি করেই দাও।
আবার একদিন দুই ফকির এসেছে শহরের সেই সেরা ধনীর ওই বাড়িতে। যে ফকিরকে তরমুজ দিয়েছিলেন, তাকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: ‘তোমাকে যে তরমুজ দিয়েছিলাম তা দিয়ে তুমি কী করলে?’ ফকির বললো: আমি ফলওয়ালার কাছে পাঁচ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। ধনী ব্যক্তিটি তখন ফলওয়ালাকে ডাকলেন। সে বললো: আমি দশ টাকায় এক ফকিরের কাছে তরমুজ বেঁচেছিলাম। এবার প্রথম ফকিরের ডাক পড়লো। ফকির বললো : ‘হুজুর আমি তো প্রথমেই আপনাকে শুনিয়েছিলাম যে গুরু যাকে দেন, তাকে আর কে কী দেবে? তখন আপনি আমার উপর রাগ করে আমাকে কিছু না দিয়েই বিদায় করেছিলেন। কিন্তু এখন দেখুন আমার কথা ঠিক কিনা। আপনি আমায় কিছুই দেননি, কিন্তু গুরুই আমাকে তরমুজ ভরতি করে হীরে-জহরত পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ধনী ব্যক্তিটি এবার বুঝতে পারলেন যে দেবার মালিক তিনি নন, মালিক যাকে দেন, শুধু তারই কপালে ঐশ্বর্যলাভ ঘটে। জগতে দাতা একজনই, তিনি হলেন গুরু। হাজার সদিচ্ছা থাকলেও কেউ কাউকে কিছু পাইয়ে দিতে পারে না। যাকে যা দেবার তা গুরুই দিয়ে থাকেন, আর তা দেন মানুষের হাত দিয়েই। তিনি না চাইলে রাজা-বাদশাহ-ধনীর দুয়ারে গিয়েও কিছু মেলে না। ভক্তরা তাই তাঁর দিকেই চেয়ে থাকেন সব অভাব-অভিযোগ মেটাবার জন্য, কারণ তারা জানেন যে রাজা-মহারাজা চাইলেও কারুর অভাব ঘোচাতে পারেন না যদি গুরু তা না চান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন