বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি….১৪


গুরুকে যে মানুষ যেভাবে চায় অর্থাৎ গুরুর কাছ থেকে যে মানুষের যে ধরনের আকাক্সক্ষা সে সেই রকমের জিনিসই পায়। চাইতে হয় সতর্কভাবে। মানুষ তার ভক্তির স্তর অনুযায়ী তার চাওয়াটা নির্ধারণ করে, কারণ ভক্তি যদি খুব বেশী স্বার্থপ্রণোদিত হয়, তাহলে সে কী চাইবে? না, অমুক লোকটা আমাকে বড্ড জ্বালাতন করছে, অমুক ভাড়াটেটা কিছুতেই উঠতে চাইছে না, অমুক আমার শত্রু অতএব, হে গুরু ওকে শেষ করে দাও, নিপাত করে দাও। এখন কেউ যদি বলে হে গুরু লোকটা আমার শত্রু, তুমি ওকে শেষ করে দাও, গুরুকেও তো বুঝে-সুঝে কাজ করতে হবে, কারণ শত্রুও তো বলবে হে গুরু, আমার শত্রুটাকে শেষ করে দাও। তাই গুরুর পক্ষে মুশকিল হলো কোন্ কুল তিনি রাখবেন, কার মনোরঞ্জন করবেন তিনি। তাঁকে সামলে চলতে হচ্ছে সকল দিক। সুতরাং কেউ যদি গুরুকে বলে আমার শত্রু নিপাত করে দাও, আমার পথের কাঁটাটি সরিয়ে দাও, তাহদলে গুরু যা ভাল বুঝবেন তা-ই করবেন। তবে একথা ঠিক, এই শ্রেণীর ভক্তরা কখনও গুরুকে কোন দিন কাছে পাবে না কারণ সে তো গুরুকে চায়নি। যখন চায়নি তখন নিশ্চয়ই তা’ সে পাবে না। মা রান্না করছেন, শিশু চীৎকার করছে। ছোট্ট ছেলে মা তাকে একটা খেলনা দিয়ে, লাল রঙের কোন একটা জিনিস দিয়ে ভুলিয়ে বসিয়ে রেখে আবার কাজ করতে চলে গেলেন। কিন্তু শিশু যদি জেদী হয়, খেলনা না নিয়ে সে যদি কেবল মাকেই চায়, তখন মায়ের মহা মুশকিল। কিছুক্ষণের জন্যে রান্না বন্ধ রেখেও ছেলেকে নিয়ে ভোলাতে হবে। আদর করতে হবে। এছাড়া অন্য কোন পথ নেই। নইলে চীৎকার করে সে পাড়া মাৎ করবে। পাড়ার লোকেরা বলবে, কী রকমের মা রে বাবা! ছেলের দিকে তাকায় না! যারা চায় শত্রু নিপাত করে দাও, গুরু তার শত্রু নিপাত করুন আর নাই করুন, সে গুরুকে পাবে না। এতে কোন সংশয় নেই। সুতরাং চাওয়াটা খুব সতর্কতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে।
আবার কেউ কেউ বলে না, না, শত্রুর নিপাত চাই না, আমার খুব উন্নতি হোক, আর্থিক উন্নতি হোক, চাকরি-বাকরির উন্নতি হোক। চাকরি-বাকরির উন্নতি চাইছে, এমন লোকও তো অনেক রয়েছে সেক্ষেত্রে কাকে রেখে কাকে দেবেন! ওপরের পদ একটাই, সেটা কাকে দেবেন, কাকে দেবেন না! তিনি সেক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী হয়তো ব্যবস্থা করে দেবেন। তা যা চাওয়া হচ্ছিল তা, সে পেতেও পারে, নাও পেতে পারে। তবে একথা ঠিক, সে গুরুকে পাবে না কারণ সে তো গুরুকে চায়নি।
প্রথমোক্তটায় যারা শত্রুর নিপাত চায়, তাদের বলা হয় মূর্খ ভক্ত। আর যারা চায় আমার এই উন্নতি হোক, তারা মূর্খ ভক্ত নয়, কারণ তার দ্বারা অপরের ক্ষতি হচ্ছে না কিন্তু তারা যে জিনিসটা চাইছে, সেটা যুক্তিসঙ্গত হতেও পারে, আবার নাও হতেও পারে। মানুষের কাছে তার স্বার্থটা যখন খুব বড় হয়ে ওঠে, তখন যুক্তি তার কাছে থাকে না। এরা হলো আড়ম্বরপূর্ণ ভক্ত। এর চেয়েও উঁচু দরের ভক্ত আছেন তারা বলেন, কিচ্ছু চাই না, শুধু তোমার সংস্পর্শ-সান্নিধ্য-স্মরণে হে গুরু এবার মুক্ত হওয়ার পথ দেখাও যাতে দেহকে দ্রবীভূত করে নৈসর্গিক স্পন্দনের এক সাধারণ পুঞ্জের মধ্যে বিলীন হতে পারি।
প্রতিটি মানুষ সকল সম্ভাব্য উপায়ে এক পৃথক সত্তায় গঠন। একটি মানুষ যে অন্য সকলের থেকে পৃথক, অহংই এই ভাবটি সৃষ্টি করে। নিশ্চিত রূপেই অহং এই ভাবটি উদ্রেক করে, আমি আছি, আমি চাই, আমি করি, আমি অস্তিত্বশীল। এমন কি আমি চিন্তা করি তাই আমি অস্তিত্ববান, এটিও হলো অহং। যা থেকে আমার ধারণা হয় যে আমি হলেম মনোজ, তা হলো অহং। অহং, যা আমাকে দেয় এক যথাযথ আকার, নির্দ্দিষ্ট চরিত্র, এক পৃথক চেতনা, এই বোধ যে আমি সকলের থেকে স্বতন্ত্রভাবে নিজেতে সত্তাবান। কেউ নিজের অহংকে একটু বেশী তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলে তাহলে সে প্রাণিক ও মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আবার এক আকারহীন পিন্ডে পরিণত হবে। নিশ্চিতভাবেই অহং হলো স্বাতন্ত্রীকরণের সহায়ক। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত এক ব্যক্তিসত্তা নিজের মধ্যে এক স্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ অহং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। যদি কারুর শক্তি থাকে সময় পূর্ণ হবার আগেই অহংকে বিলুপ্ত করে দেয়ার, সেক্ষেত্রে তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হবে। কিন্তু একবার যখন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়ে যায়, তখন এবং অপ্রয়োজনীয় এমনকি ক্ষতিকরও হয়। তখনই সেই সময় আসে যখন অহংকেও ত্যাগ করা উচিৎ। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই যেহেতু আমাকে গড়ে তুলতে সে এত পরিশ্রম করেছে, এত সহজে সে তার কাজ ছেড়ে দেবে না। সে চাইবে তার পরিশ্রমের পুরস্কার তা হল স্বাতন্ত্র্যকে উপভোগ করা। স্বার্থপরতা ও অহমিকা হলো এমন একটি বস্তু যাকে সংশোধন করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কারণ সবাই জানে স্বার্থপরতা ও অহমিকা কাকে বলে। সেটাকে আবিষ্কার করাও সহজ, সংশোধন করাও সহজ, অবশ্য সত্যিই কেউ তা করতে রাজী হলে এবং সে জন্যে লেগে পড়ে থাকলে, তবেই।
অহংকারকে উপলব্ধি করা বেশী শক্ত। কারণ ও যে কি বস্তু, তা উপলব্ধি করতে পারার আগে, নিজেকে সম্পূর্ণ অহঙ্কারমুক্ত হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে পারা চাই, নইলে তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সবটা, বাহ্য চেতনা থেকে আধ্যাত্মিক চেতনা পর্যন্ত সমস্ত কিছু অহংকারের সঙ্গে মিশে এক হয়ে রয়েছে। এমন কিছুই নেই যার সঙ্গে অহংকার মিশে নেই। তাই ও যে কি বস্তু তা মানুষ বুঝতেই পারে না। আগে ওকে নিয়ন্ত্রণ করা চাই, ওর থেকে বেরিয়ে আসা চাই, নিজেকে ওর থেকে খানিকটাও অন্তত মুক্ত করা চাই, তা যদি নিজের সত্তার ক্ষুদ্রতম কোন একটি অংশেও হয়, তা হলেও শুরু করলে, তখন বুঝতে পারা যায় অহংকার কি।
যে বস্তু আমাদের স্বতন্ত্র ব্যক্তি হয়ে উঠতে সাহায্য করে এবং একইসঙ্গে আবার আমাদের উর্দ্ধমুখী চৈতন্য হয়ে উঠতে বাধা দেয় সেই হলো অহংকার। এ দুটিকে একসঙ্গে করলে অহংকে দেখতে পাওয়া যায়। অহং না থাকলে, জগৎ এখন যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে স্বতন্ত্র ব্যক্তি বলে কিছু থাকত না। অহং আছে বলে, বিশ্বজগৎ শান্তিময় হয়ে উঠতে পারছে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন