ধর্মীয় আধিপত্যবাদের কবলে বাংলাদেশ
সংলাপ
॥ মানবতাকে প্রধান্য দিয়ে পরস্পরের জন্য সাহায্য ও সহমর্মিতার মাঝে যখন শান্তির পথে
জীবনের সার্থকতা খুঁজছে পৃথিবীর মানুষ। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশে একটি বিশেষ শ্রেণীর
ধর্মজীবীরা দারিদ্রতা, অশিক্ষা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মভীরু বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক
উন্নয়নের নামে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় ত্রাণ ও কল্যাণ সংস্থা এবং বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের
কাছ থেকে অনুদান হিসেবে আনীত কোটি কোটি টাকা
এদেশের পিছিয়ে থাকা ধর্মভীরু দরিদ্রদের মধ্যে ধর্মের নামে বিতরণ করে সুকৌশলে ধর্মীয়
আধিপত্য বিস্তার করে জাতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা ধ্বংস করে দিয়ে ধর্মীয় রাজ্য গড়তে মরিয়া
হয়ে উঠেছে। ওই গোষ্ঠী যারা তাদের দলে দীক্ষিত
হচ্ছে তাদের উপহারস্বরূপ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। যে দরিদ্র এলাকার মধ্যে
ধর্মান্ধ -উগ্রবাদী কেউ নেই সেই সব এলাকায় ওইসব দল ধর্মের লেবাস পরে ধর্মভীরুদের কাছে
পৌঁছায়, যার কারণে সেখানে মাদ্রাসা, ঘরবাড়ী ও মসজিদে দেয়া হয় তাদের জায়গা। ওই সকল ধর্মজীবীদের
উদ্দেশ্য?ও ষড়যন্ত্র সুপরিকল্পিত। ওই সব ধর্মজীবীকে যখন প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনারা কেন
এসব দরিদ্র ধর্মভীরু মানুষগুলোকে সত্য থেকে বিচ্যুত করছেন?’ তখন তারা বলেন, আমরা কাউকে
জোরপূর্বক দলে টানছি না। বিবেকবান মানুষ জানে, অর্থ সাহায্য, সেবা বা মানবতার কোন শর্ত
থাকে না। ধর্মজীবী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কতকগুলো অঘোষিত শর্ত থাকে। ধর্মজীবীরা ছোট ছোট
দরিদ্র ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অজুহাতে দরিদ্র অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রলোভন দিয়ে
তাদের মাদ্রাসায় নিয়ে আসে। ওইসব ছেলে মেয়েরা যেসব মাদ্রাসায় যাচ্ছে সেখানের তথাকথিত
ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া বাধ্যতামূলক। ওইসব ছেলেমেয়েকে প্রথমত প্রশিক্ষণ দিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদী
তৈরি করে তারপর ধর্মজীবীদের সৃষ্ট বিভিন্ন পথে সাহায্য, অনুদান দিয়ে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতির
মধ্যে ফেলে পরকালের কথা বলে তাদের নিজস্ব অনুভূতি ও স্বকীয়তাকে দুর্বল করে ফেলে। এসব
দরিদ্র ছেলে-মেয়েগুলোকে এমন একটা বলয়ে আবদ্ধ করে যেখান থেকে তারা বের হতে পারে না এবং
ধর্মীয় সন্ত্রাসী হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দরিদ্র অভিভাবকগণ ধর্মজীবীদের কথায় সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করে।
চতুর ধর্মজীবীরা আরবীয় সংস্কৃতিতে তাদের প্রভান্বিত করে যা সাধারণ দেশের দরিদ্র মানুষরা
বুঝতে পারে না। তাদের কবলে পড়লে কেউই বাঙালির (ইসলাম) সত্য ধর্ম, সংস্কৃতি ধরে রাখতে
পারছে না। তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বাদ দিয়ে এবং মুহম্মদী ইসলাম ত্যাগ করে ওই ধর্মজীবীদের
ভাবধারায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তারা যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে এবং দলের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য? বিভিন্ন ভিন্ন
ভিন্ন সংগঠন করে দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে রাখছে। এভাবেই তারা বাঙালি সংস্কৃতি
ও জীবনধারাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে।?তারা নামটাকেও পুরোপুরি পরিবর্তন না করে মূল নামটা
ঠিক রেখে আগে-পরে এমন কিছু যোগ করে দিচ্ছে, যা থেকে আস্তে আস্তে প্রকাশ হতে থাকে যে,
তারা ধর্মাবলম্বী হয়েছে কোন দলের।
বাঙালি
আদি থেকে এক ঈশ্বরবাদ দর্শনের ধারক ও বাহক।
তাছাড়াও কিছু পারিবারিক এবং কিছু বংশীয়
আচার ইত্যাদি পালন করে থাকে। উপমহাদেশের সকল জাতির নাম, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও জীবনধারা ভিন্ন। ধর্মজীবীরা সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদিকে
প্রথমবারেই পুরোপুরি না বদলে ধীরে ধীরে তাদের মতো করে বদলে নিচ্ছে। অনেক দূর ইতিহাস
থেকে দেখা যায়, ওইসব ধর্মজীবী ও ধর্মজীবীরাই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেছে এবং সেসব
এলাকায় নিরীহ ধর্মভীরু মানুষগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করছে।
সুদূরপ্রসারী
পরিকল্পনায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সভ্যতা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ধর্মীয় আধিপত্যবাদীরা
তাদের ধর্ম চাপিয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাপী তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সুক্ষ্মভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ধর্মজীবীরা
বাঙালির সংস্কৃতি, শান্তি ধর্মের আচার, অনুষ্ঠান একটা একটা
করে শেকড় কাটার মতো করে কাটছে। বাইরে থেকে সহজে কারও চোখে পড়ছে না। ধর্মভীরুদের এবং
ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের মাথায় হাত বুলিয়ে কৃত্রিম ভালবাসা
দেখিয়ে তাদের সংস্কৃতির শেকড় কাটছে। যে শত্রু সমাজের ভেতর থেকে, সংস্কৃতির ভেতর থেকে,
সংসারের ভেতর থেকে ধ্বংস করে, সে শত্রু ক্যান্সারের চেয়েও বিপজ্জনক।
উন্নয়নের
নামে দেশী-বিদেশী অনেক এনজিও ধর্মভীরু বাঙালির উৎসব ও দরিদ্রতার চিত্র ভিডিও করে বিদেশী
দাতাগোষ্ঠিদের নিকট প্রদর্শন করে তাদের নিকট হতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ আনে। কিন্তু কোন
এনজিও দ্বারা বাঙালি জাতির প্রকৃতপক্ষে কোন উন্নয়ন হয়নি।
আধিপত্যবাদী
ধর্মজীবীরা যেখানে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে সেখানেই ধর্মীয় সন্ত্রাস জন্ম নিয়েছে। দরিদ্র
এলাকাগুলোতে যেমন শহরের বস্তিগুলোতে যেখানে মৃত্যুক্ষুধা নিত্যদিনের সঙ্গী সেখানে ধর্মজীবীদের
কর্মকান্ড বেড়েই চলেছে। কারণ তারা জানে এসব জায়গায় তথাকথিত রাজনৈতিক ধর্মের কথা বলে
দলভুক্ত করা যাবে। সেখানে তারা অর্থ ব্যয় করে। যারা মানবতাবাদী,
যারা মানুষকে ভালবাসে, যাদের ভালবাসায় কোন উদ্দেশ্য থাকে না, যাদের ভালবাসায়, সেবা
ও ত্যাগে কোন শর্ত থাকে না, যাদের কাজের পেছনে ধর্মভীরু মানুষকে ফাঁদ পেতে দলীয়করণ
করার মাধ্যমে সংখ্যা বৃদ্ধি করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মত মানসিকতা থাকে না তারাই
মানুষকে ভালবাসতে পারে। ধর্মজীবীরা উপরে উপরে দেশ ও জাতির কথা বললেও তাদের ভেতরের আসল
উদ্দেশ্য হল ধর্মীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দ্বারা নয়া আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা।
ধর্মজীবীরা এখন সেবা, সাহায্য ইত্যাদি অজুহাতে বিভিন্ন দেশে প্রতিটি পেশাজীবী সম্প্রদায়ের
মধ্যে প্রবেশ করছে এবং দেশ ও এলাকা, মাটি, মানুষ, আলো বাতাসের সঙ্গে মিশে থেকে তাদের
ভয়াল আগ্রাসী রূপটাকে মায়াবী মুখোশে ঢেকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে হতদরিদ্র
লোকজনকে দলে টানছে। তাদের জাতীয়তা ভুলিয়ে দিয়ে এবং?আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নতুন বীজ বপন
করছে। সরকারের ধর্মমন্ত্রণালয় এবং?সচেতন বাঙালি জাতি এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা না নিলে
অচিরেই ধর্ম নিয়ে সমাজে এমন বিশৃঙ্খলা ঘটার সম্ভাবনা আছে। যা থেকে শুধু রক্তক্ষয় হবে
না শান্তি (ইসলাম) ধর্ম আর শান্তিতে থাকতে পারবে না!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন