বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাণিজ্য ও রাজনীতির অবসান হোক!

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে

বাণিজ্য ও রাজনীতির অবসান হোক!

সংলাপ ॥ স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে শহীদদের স্বপ্নের শোষণমুক্ত সমাজ বা দেশ প্রতিষ্ঠিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য কখনোই বন্ধ ছিল না। রাজধানী ঢাকার দৃশ্যপটঃ গুরুত্বপূর্ণ ছোটবড় সকল সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে খেতাব অর্জনকারী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নামে, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন নেতৃত্ব ও সংগঠকদের নামে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিবর্গের নাম ও কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখা একটি জাতীয় দায়িত্ব। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদর ও তাদের আদর্শের ধারক-বাহকরা ছাড়া এ কথা অস্বীকার করতে পারে না কেউই। কিন্তু বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের অনেক নামফলকে যেভাবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নাম প্রায় সমান আকারের টাইপে ফলাও করে লেখা হয়েছে তাতে স্পষ্টই বোঝা গেছে সংশ্লিষ্ট মেয়র তার নামকে জনসমক্ষে তুলে ধরার একটি মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগানোর যথাসাধ্য চেষ্টা-তদ্বির করেছেন।
অর্থাৎ  মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক তৈরি ও সড়কের নামকরণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হবে এ আশংকা রয়েই গেল। অবশ্য যেসব ফলকে কেবল বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যক্তিত্বের নামের পাশাপাশি তাদের কর্ম ও অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোতে নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রয়েছে। বাংলার মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক এঁর একটি স্মরণীয় বাণী হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি চিন্তা ও কর্মে এক নয় তার ইবাদত শুদ্ধ নয়।’ আর হাজার বছর আগেকার এক সাধক-ইমাম জাফর সাদিক ইবাদতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সঠিক সময়ে সঠিক কাজ সুসম্পন্ন করার নাম ইবাদত।’ ৪৫ বছর বয়সী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকালের আশা-আকাংখা ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়েও আজ দেখা যাচ্ছে, যারা স্বাধীন দেশের সকল সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগ করেছে তাদের অনেকেই চিন্তা ও কর্মের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না, পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আজও স্বপ্নেই থেকে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ম ও অবদানের ফসল হিসেবে যে সাফল্য তার সুফল ভোগ করছে অতি নগণ্য সংখ্যক মানুষ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের যে মেয়রের সময় সড়কগুলোর নামকরণ মুক্তিযুদ্ধের নামে করা হলো তিনিও একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জানবাজ গেরিলা হিসেবে ঢাকায় অনেক দুঃসাহসী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে যে ভূমিকা পালন করেছেন তাতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ব্যক্তিবর্গ ও দলই বেশি উপকৃত হয়েছে, ভূলুন্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই। রাজাকারদের তালিকা না করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে গিয়েই সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। কেননা, ’৭১-এর নয় মাসে কতিপয় রাজাকার-আলবদর-মুসলিম লীগ-শান্তি কমিটির লোক ছাড়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিবাহিনীর লোক ওসৈনিকদেরকে যুগিয়েছিল খাদ্য আশ্রয়সহ যাবতীয় সহযোগিতা।
যে কারণে মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধ-বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জনতার কাছে যার আবেদন চিরভাস্কর হয়ে আছে। আর এ যুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটিতে ছিল সমগ্র মুক্তিকামী বাঙালির সকল বিজয় ও আশা-ভরসার প্রাণস্পন্দন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এর আবেদনকে সংকীর্ণ করে তোলার পেছনে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে আজও বিদ্যমান। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার আড়ালে তৎকালীন সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোনাফেক ও ভন্ড রাজনীতিকদের যোগসাজশে বিলি করা হয়েছিল হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট যার সুবিধা নিয়ে সুযোগ-সন্ধানী কথিত শিক্ষিত শ্রেণী এমনকি অনেক রাজাকারও সরকারি চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে এবং এ শ্রেণীটিই পরবর্তী ৪৫ বছর ধরে দেশের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিয়ন্তা সাজতে গিয়ে আবহমান বাংলা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে করেছে কলুষিত। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে আবারো পাকিস্তানী ভাবধারার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ (যার সর্বশেষ পরিণতি জঙ্গীবাদ) বানানোর এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর ক্ষমতা ভোগকারী জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কেউই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি ও বাণিজ্য করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। জিয়া সারা দেশে ‘ইয়ূথ কমপ্লেক্স’ গঠন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর কার্যক্রমকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করে এদেশের ছাত্র, যুব সমাজ ও মুক্তিবাহিনীর বেকার সৈনিকদের পদস্খলন ঘটানোর পেছনে মারাত্মক ভূমিকা পালন করে গেছেন। জেনারেল এরশাদ, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’-এ ঘোষণা দিয়ে আরও বড় রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতা মেয়াদ নয় বছর পর্যন্ত বাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন।

তারপর ১৯৯১ সালে এদেশের জনগণ তথা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের অবসান ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহনের পর মৃত্যুর পরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। যে দেশে ’৭১-এর বীর সেনানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, অন্যদিকে রাজাকার, আলবদর চক্র বিভিন্ন ছলচাতুরি ও দেশি-বিদেশী অশুভ শক্তির সহযোগিতায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সেখানে শুধুমাত্র মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থায় তুষ্ট থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে  ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তুমি দিতে এলে ফুল’?-এই গানের কথাগুলোই মনে পড়ে যায়। মুক্তিয্দ্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে বলেই শহীদদের স্বপ্নের সোনার বাংলা আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধুমাত্র নগন্য সংখ্যক লোকের হাতে দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গেছে। দারিদ্র্য অশিক্ষা-কুশিক্ষা, শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন নির্যাতনের’ নির্মম শিকার হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। তবু আশার কথা, বহু পরে হলেও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বদৌলতে দেশবাসী আজ যুদ্ধাপরাধীদের চিনতে পেরেছে, তাদের বিচারের দাবি জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং এত বিজয়ের ঘটনা যে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা তা সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক একটি অসম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এখন সবার আগে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতিকদের রাজনীতি ও বাণিজ্যের অবসান ঘটানো। তবেই সুগম হতে পারে শহীদদের স্বপ্নের দেশ গড়ার, মুক্তি পাবে এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবিদার সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব এ বিষয়টি যত শীঘ্রই উপলব্ধি করতে পারবে ততই মঙ্গল। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে আর সুযোগ দেয়ার অবকাশ নেই। তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন পর্যন্ত কপটতাই তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন