বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৪

জীবন একটি দলগত খেলা



জীবন একটি দলগত খেলা

আবদুল্লাহ্‌ মাযরান ॥ একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, ‘তুমি যদি কাউকে একটি মাছ দাও, তাহলে তুমি তার এক দিনের খাবারের ব্যবস্থা করলে। কিন্তু তুমি যদি কাউকে মাছ ধরা শেখাও তাহলে তুমি তার সারা জীবনের খাবারের ব্যবস্থাই নিশ্চিত করে দিলে’। অভিভাবক ও সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত শিশুদের হাতে মাছ তুলে না দিয়ে মাছ ধরতে শেখানো। আমরা যদি শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ আর সহায়তা দিই, তাহলে সরকারকে বেকার সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে না।
আমরা শিশুদের জ্ঞান দিই, কী কী করা উচিত নয়। কাউকে মেরো না, তর্ক কোরো না, এমন আরও শত শত বিধি-নিষেধ! আমরা তাদের বলি, সবচেয়ে ভালো চাকরিটাই পেতে হবে। স্কুলের শিক্ষক বলেন, চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী হতে না পারলে আর জীবনে হলোটা কী! টেলিভিশন আর পত্রিকা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, যদি একবার মডেল, গায়ক কিংবা নায়ক হতে পারো, তাহলে তোমাকে আর পায় কে! আমাদের এমবিএ প্রোগ্রামে উদ্যোক্তা হতে শেখানো হয় না। সেখানে শুধু শেখানো হয়, কীভাবে বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে। এসব বড় বড় কোম্পানি যারা তৈরি করছে তারা উদ্যোক্তা। অথচ আমরা তোতাপাখির মতো শিখিয়ে যাচ্ছি, ‘উদ্ভট কিছু করার চেষ্টা কোরো না। সবাই যা করে, সেটাই করো। ভালো ছাত্র হও’। উদ্যোক্তা হতে হলে এমবিএ করতেই হবে, স্কুলে ভালো ফল করতেই হবে- এমন কোনো কথা নেই।
আমরা শুধু ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য প্রাইভেট টিচার দিয়েই মনে করি দায়িত্ব শেষ! কিন্তু না, তাদের নেতৃত্ব দিতে শেখাতে হবে। তাদের মনে মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে জানতে হবে। সব মানুষই আসলে উদ্যোক্তা হয়ে জন্ম নেয়। মানুষ যখন গুহায় বাস করত, তখন তারা সবাই ছিল এক অর্থে উদ্যোক্তা। তারা নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করত, নিজেদের কাজের সংস্থানও করত। এভাবে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমেই মানব ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। সভ্যতার সূচনালগ্নে বেকার বলে কোনো শব্দ ছিল না। কিন্তু সময় যত পেরিয়েছে, আমরা আমাদের সহজাত উদ্যোক্তাসুলভ মনোভাবকে তত দমিয়ে ফেলেছি। আমরা উদ্যোক্তা থেকে পরিণত হয়েছি শ্রমিকে। আমাদের মগজে পাকাপাকিভাবে এই ধারণা ঢুকে গিয়েছে যে আমাদের চাকরি করতে হবে।
পৃথিবী এখন বিশ্বায়ণ আর প্রযুক্তির কল্যাণে যত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। গত দশকে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ধাপে ধাপে তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলত। কর্মক্ষেত্রে তার কাজের একটি নির্দিষ্ট বিভাগ থাকত, ক্যারিয়ারের পথ ছিল সুনির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। যে কোম্পানিতেই কাজ করুক না কেন, সে সেই ছকের ভেতরে থেকেই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেত। কিন্তু বিশ্বায়ণ যেখানে প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছে, সেখানে ক্যারিয়ার-ভাবনাও বদলে ফেলতে হবে। আগে ক্যারিয়ার ছিল একটি সোজা ওপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি, এখন তা পরিণত হয়েছে গোলকধাঁধার মতো এক পাহাড়ি এলাকায়। এখান উপরে উঠতে হলে কখনো নিচেও নামতে হতে পারে, অনেক চড়াই-উতরাই পাশ কাটিয়ে যেতে হতে পারে বুদ্ধি করে, কখনো কখনো ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিতেও হতে পারে। আবার সময়ের প্রয়োজনে হয়তো পাহাড়ের পাদদেশে নেমেও আসতে হতে পারে।
কিছুই একরকম থাকবে না, কখনো থাকে না। যা আছে তা বদলায়, কখনো বদলে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু তৈরি হয়, কখনো আগে যা ছিল তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। আধুনিক ক্যারিয়ার প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনকেই শিক্ষার্থীদের  একমাত্র স্থায়ী ব্যাপার বলে ধরে নিতে হবে। আশপাশের সবকিছুই বদলে যাবে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা ও সামর্থ্যকেও দ্রুত বদলে ফেলতে হবে। বর্তমান সময়ে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন কৌশল। আর সেই কৌশলটি হলো, উদ্যোক্তাদের মতো চিন্তা করা। বসে বসে দীর্ঘ পরিকল্পনা করে জীবন পার করে দিলে চলবে না, কাজে নেমে পড়তে হবে। নিজের কাজ, নিজের ক্যারিয়ার নিজেকেই সৃষ্টি করে নিতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করা। যার নেটওয়ার্ক যত শক্তিশালী হবে সে তত বেশি তথ্য পাবে, ব্যবহারিক জ্ঞান পাবে। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক যে কোন ক্ষেত্রে সফল হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা ও দুর্যোগ এড়িয়ে যাওয়া যায়, অনেক নতুন সম্ভাবনাও খুঁজে বের করা যায়, শুধু একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক শুধু পরিচিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না- মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে তারা এবং তাদের পরিচিত মানুষেরা, এমনকি সেই মানুষদের পরিচিত মানুষেরা সবাই এক অদৃশ্য সুতায় জড়িয়ে আছে। জীবন একটি দলগত খেলা। আশপাশের সবকিছু, দলের সবাইকে নিয়েই গড়ে উঠে ব্যক্তিত্ব।
পৃথিবী খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তাই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা আর নতুন কিছু আবিষ্কার করার তাগিদও দিন দিন বাড়ছে। পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে হলে উদ্যোক্তাদের মতো ভাবতে হবে।
যখন কেউ নতুন কিছু করে, পরিবর্তনের কথা বলে, তখন অধিকাংশ সময়ই তার পরিচিত মানুষেরা কিংবা নিজের দেশের লোকেরা তার যথাযথ মূল্যায়ণ করতে পারে না। স্বদেশে সে হয়তো উপহাসের পাত্র হয়, কিন্তু দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে ঠিকই তার কদর বুঝতে পেরে সমাদ্রিত করে ধন্য করে। সত্যকে প্রথম প্রথম কেউই মেনে নিতে না চাইলেও একসময় তা নিজগুণেই প্রকাশিত হয়। তত দিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাকে মেনে নেয়ার মানসিকতাও গড়ে ওঠে। আপনা-আপনিই তখন লোকে সেই আদর্শে চলতে থাকে, যে আদর্শকে তারাই একদিন তাচ্ছিল্য করেছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন