মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

আমি মানুষ হতে চাই

আমি মানুষ হতে চাই

সিদ্ধার্থ ॥ মানুষ শব্দটি এসেছে 'মনুষ্য' শব্দের অপভ্রংশ হিসাবে। মনু+ ষ্ণ্য (অপত্যার্থে)=মনুষ্য। অর্থাৎ মানুষ মনুর সন্তান এবং দানব দনুর সন্তান। ইংরেজি Man, জার্মান MannMensch, আবেস্তান Manu ইত্যাদি সব শব্দ একই উৎস সম্ভূত। মানুষের নানা রূপ। মানুষ যখন অনুভূতিশীল তখন মানুষের বিপরীত শব্দ অমানুষ, মানুষ যখন মানব জাতি, তখন বিপরীত শব্দ মানষ্যেতর, মানুষ যখন পরিণত বা প্রাপ্তবয়ষ্ক তখন বিপরীত শব্দ ছেলেমানুষ।
মানুষ শব্দের ক্রিয়াপদ 'মানুষ করা'। মানুষ করা অর্থ - লালন-পালন করা ও উপযুক্ত শিক্ষা দান করা। মানুষ  শব্দের দ্বিতীয় ক্রিয়াপদ মানুষ হওয়া। মানুষ হওয়া মানে সত্য বলা, কারো ক্ষতি না করা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, বিপদে-আপদে অন্যকে সাহায্য করা, সদাচরণ করা। সবাই যদি মানুষ হতো তাহলে মানব জাতি সুখে শান্তিতে থাকতো। আইন, আদালত, থানা, পুলিশ, পার্লামেন্ট কোন কিছুর প্রয়োজন হতো না। কারো কোন অভাব থাকতো না। আনন্দ ও সমৃদ্ধি থাকতো সর্বত্র।
হাজার হাজার বছর ধরে নবী, রসূল, ওলি, সাধক, শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক সকলেই মানুষকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ। মানুষ এখন বন্য জানোয়ার থেকে নিরাপদ কিন্তু মানুষ থেকে নিরাপদ নয়। সর্বদাই অমানুষের ভয়ে অস্থির থাকে মানব জাতি। সামান্য একটু খোঁচা দিলে ভদ্র মানুষগুলোও অভদ্র হয়ে ওঠে; চিৎকার চেঁচাম্যাচি, গালাগালি শুরু করে; ঝগড়া-মারামারি লেগে যায়; - কেন এমন হয়?
আমাদের শরীরটা আসলে মানুষ না। এটা অন্য সব পশুর মতই একটা পশু। পশু ভালো-মন্দ বোঝে না। একটি গাভি ফুলের বাগানে ঢুকে পড়লে মহূর্তের মধ্যে নির্ভয়ে সকলের সামনে বাগান নষ্ট করে দেয়। গাভি বুঝে না যে, এ কাজটা ভাল না। কিন্তু কোন মানুষ যখন বাগান নষ্ট করে তখন সে তা করে লুকিয়ে যেন কেউ না দেখে কারণ সে জানে যে এটা মন্দ কাজ। যে মানুষটি ভালো-মন্দ নির্ণয় করে সে কিন্তু শরীর নয়। লৌকিক ভাষায় আমার একে বিবেক বলি। ভালো কাজ করলে বিবেকের কাছে ভাল লাগে, খারাপ কাজ করলে বিবেক দংশন করে। মানুষের বিবেক আছে, পশুর বিবেক নেই। প্রশ্ন হলো - ভালো-মন্দ বুঝেও মানুষ মন্দ কাজ কেন করে?
যখন খিদে লাগে তখন দেহটা খাবার চায়। আমরা তখন তাকে খেতে দিই। আমরা যখন নির্ণয় নেই - উপবাস ব্রত পালন করব তখন দেহের দাবি আমরা উপেক্ষা করি। দেহ খাবার চাইলেও তাকে খেতে দেই না।
এতে করে দেহের উপর বিবেকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বিবেক সবল হলে দেহের বিরুদ্ধ দাবি পূরণ করে না। বিবেকের শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বিবেক যদি দুর্বল হয় তাহলে দেহ যখন যা চায়, তা-ই দিতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ  যার বিবেক কাজ করে সে মানুষ অর্থাৎ যে বিবেকের প্রয়োজনে দেহের দাবিকে অগ্রাহ্য করার শক্তি রাখে সে মানুষ। আর কোন বিচার বিবেচনা না করে দেহ যা চায় তা-ই যে দিতে বাধ্য হয় সে পশু।
মানুষ হতে হলে দেহের উপর বিবেকের কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিবেক যে কাজকে মন্দ বলে, দেহ দাবি করলেও তা পূরণ করা যাবে না। আমাদেরকে যখন কেউ অমানুষ বলে তখন নিজের কাছেই খারাপ লাগে। অমানুষের মতো কাজ করলে খারাপ লাগে না কিন্তু কেউ অমানুষ বললে কেন যে খারাপ লাগে তা এখনও খুঁজে পেলাম না।
ছোট বেলা থেকে বাবা মা কতো চেষ্টাই না করেছেন আমাদেরকে মানুষ বানাতে। মক্তবে, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন; এমনকি বিদেশে পর্যন্ত পাঠিয়েছেন মানুষ হওয়ার সর্বোচ্চ শিক্ষা নিতে। কিন্তু বড়ই আফসোস! আমি মানুষ হতে পারলাম না।  মানুষ হওয়ার চেষ্টা আমি করেছি বটে। মানুষ হওয়ার প্রয়াসে আমি বুঝেছি - মানুষ হওয়া খুব কষ্ট। অনেক কষ্ট ও ক্ষতির পর কেউ মানুষ হয়। তাই ভাবলাম, মানুষ হওয়া যখন এত কষ্টের তাহলে আমি মানুষ না হয়ে বরং অমানুষই হই! কিন্তু অমানুষও আমি হতে পারলাম না! ভেবে দেখলাম অমানুষ হওয়া মানুষ হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি  কষ্টের ও লাঞ্ছনার।
আমি কষ্ট ও ক্ষতি স্বীকার করতে চাই না তাই মানুষও হতে পারলাম না, অমানুষও হতে পারলাম না। আমি সুবিধাবাদী হয়েছি। কখনও মানুষ, কখনও অমানুষ। আমি কখনো সত্য বলি, কখনো মিথ্যা বলি; আমি কখনো উদার কখনও সংকীর্ণ; কখনো স্বপ্ন দেখি কখনও বা দুঃস্বপ্নে আঁৎকে ওঠি, কখনো ভালোবাসি কখনো ঘৃণা করি।

একবার এই দিকে আরেকবার ওইদিক দুলছি আমি। দুলতে দুলতে আমি ক্লান্ত, আমার মাথা ঘুরছে, আর ভালো লাগছে না, সহ্য হচ্ছে না। এবার আমি এক বিন্দুতে স্থির হওয়ার নির্ণয় নিয়েছি। আমি মানুষ হতে চাই। কতো মানুষ কতো ভাবেই না চেষ্টা করেছে আমাকে মানুষ বানাতে কিন্তু কেউ আমাকে মানুষ বানাতে পারেনি। আমাকে মানুষ হতে হবে নিজ প্রয়াসে। নিজের ধর্ম নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি তখন নিচে নেমে পশু হতে চাই না, উপরে ওঠে মানুষ হতে চাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন