বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০১৪

'খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা ?'

'খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়,
কে দেয় সেখানে তালা ?'

'তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী, 
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!
কোথা চেঙ্গিস গজনী-মামুদ, কোথায় কালা পাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যতো তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!'
                                     - কাজী নজরুল ইসলাম

সাদিকুল হক ॥ রসূল (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর মদীনার প্রাণকেন্দ্রে নির্মাণ করেছিলেন মসজিদে নববী। খেজুর পাতা আর কাদা মাটি দিয়ে নির্মিত হয়েছিল সে মসজিদ। কিন্তু খেজুর পাতার মসজিদটিতে ছিল অফুরন্ত প্রাণের উচ্ছ্বাস, দিশেহারা মানুষের দিশা, পথহারা মানুষের আলোকবর্তিকা, অন্ধকারে আলোক বিচ্ছুরণের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদে নব্বী একদিকে যেমন রসূল (সা.)-এঁর আবাসিক বাসভবন ছিল, অন্যদিকে তেমনি ছিল শিক্ষাকেন্দ্র, পাঠাগার, আশ্রয়হীনদের আশ্রয়স্থল, আত্মিক উন্নতির সাধনাক্ষেত্র, সমাবেশ ও সালাতের স্থান। মামলার শুনানি, বিচারকার্য পরিচালনা হতো মসজিদে, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকেও বন্দি করে রাখা হতো মসজিদেই। বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠিত ছিল মসজিদেই। মসজিদে নববী ছিল অতিথি ভবন, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ ও সাহায্য সংস্থা কেন্দ্র, আহত ও অসুস্থদের চিকিৎসালয়, জ্ঞান অন্বেষীদের গবেষণাগার ও লাইব্রেরি। মসজিদে নববী ছিল মিলনকেন্দ্র বা কমিউনিটি সেন্টার। মসজিদেই অনুষ্ঠিত হতো বিয়ে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হাস্য-রস, কৌতুক, কবিতা পাঠের আসর হতো মসজিদে। তৎকালের প্রখ্যাত কবি হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর জন্য নির্মিত ছিল পৃথক মিম্বার। তার কবিতায় মুগ্ধ হয়ে রসূল (সা.) তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন নিজ গায়ের চাদর। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মসজিদ ছিল উন্মুক্ত। চব্বিশ ঘণ্টা প্রাণের জোয়ার থাকতো মসজিদে। রসূল (সা.)-এঁর  শিষ্যগণ মসজিদ থেকে দীক্ষা নিয়ে শান্তি মঙ্গলের বার্তা ছড়িয়ে দিতেন মদিনার ঘরে ঘরে।
বর্তমানে আমাদের মসজিদ-গুলোর কী দশা? ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। ঢাকার অলিতে-গলিতে অপূর্ব কারুকার্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক লাখ লাখ মসজিদ কিন্তু মসজিদে নববীর আদর্শ কি আছে সেসব মসজিদে? মসজিদগুলো এখন ধর্মজীবীদের দখলে, কেবল নামাজ পড়ার স্থান হিসেবে বিবেচিত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সর্বোপরি আড়াই ঘণ্টা আবাদ হয় মসজিদ। আবার এমন মসজিদও আছে যেগুলো জুমআর দিন ব্যতীত অনাবাদী থাকে। এখন মসজিদে কোন সামাজিক কার্যক্রম সম্পন্ন করাকে অবৈধ ও মসজিদের আদব পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাই মসজিদগুলো আজ প্রাণহীন, নীরব, নিস্তব্ধ।
মহানবী মুহাম্মদ (সা.) প্রায় পনেরশ' বছর আগে বলে গেছেন, এমন এক সময় আসবে, যখন অলিতে গলিতে সুন্দর সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করা হবে কিন্তু মসজিদে কোন শিক্ষা থাকবে না। এখন মসজিদ আছে কিন্তু এর ভেতরে কোন শিক্ষা নেই। জুমার নামাজে আমাদের মসজিদগুলোতে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটে। কিন্তু সালাতের কোন প্রভাব নেই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে। এরকম মসজিদেরও অভাব নেই যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দখলদার পরিবর্তন হয়।  সরকার পাল্টায় আর পাল্টায় মসজিদ কমিটিও। সরকারের সাথে সাথে খোলস পরিবর্তন করতে হয় মসজিদের ইমাম খতিবদের। কারণ, অধিকাংশ ইমাম খতিবই তাদের এ পদকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম মনে করেন। মসজিদের ইমাম বা খতিব নয় তারা এখন কর্মচারী মাত্র। তাই জীবিকার প্রয়োজনেই তাদের রূপ পরিবর্তন করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মসজিদের ইমাম সাহেবের মাথায় একথা ঢুকেই না যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বাইরে তাদের কিছু করণীয় আছে। আসলে এসব বেতনভুক্ত ইমামগণ কেউ প্রকৃত অর্থে ইমাম নয়, ঘরগুলোও প্রকৃত অর্থে মসজিদ নয়, আর ভেতরে যা করা হয় তাও প্রকৃত অর্থে সালাত নয়। ইসলামে পেশাদার ধার্মিকশ্রেণীর কোন অস্তিত্ব নেই।
মসজিদ এখন কাঁদে টাইলসের ভারে। আজ আমাদের মসজিদগুলো কারুকার্য, জাঁকজমক ও আড়ম্বরতার দিক থেকে অনেক অগ্রসর। দেশী-বিদেশী পাথর, রকমারি টাইলস আর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে সজ্জিত। মর্মর পাথর আর মখমলের গালিচা বিছানো মসজিদগুলো যেন রাজদরবার। রসূল (সা.) বলেছেন - 'লানত ও অভিসম্পাদ ওদের উপর, যারা মসজিদকে কারুকার্য খচিত করবে। পূর্বেকার জাতিসমূহ তাদের ইবাদতের ঘরসমূহ সাজগোজ করে মানুষকে বিপথগামী করেছে। তোমরা কখনও তা করবে না। যারা করবে, তাদের উপর আল্লাহর লানত।' রসূল (সা.)-এঁর নির্দেশ অমান্য করে কারা আজ অপূর্ব কারুকার্যময় মসজিদ তৈরি করছে? কারা টাকার যোগান দিচ্ছে? আমাদের দেশে এখন অনেক মসজিদই নির্মিত হচ্ছে অবৈধ উপায়ে অর্জিত আর্থিক প্রতিপত্তি মানুষকে জানানোর জন্য। যেন মানুষ তাকে দেখলে টাকার গরমে ভয় পায়। সালাম দেয়। একে তো অবৈধ টাকা তার উপর মসজিদ তৈরি করে দেমাক দেখানো! পার্শ্ববর্তী মসজিদের চেয়ে নিজের টাকায় তৈরি মসজিদকে কীভাবে আরেকটু দৃষ্টিনন্দন করা যায় সেই প্রতিযোগিতায় মত্ত আছে কিছু মানুষ। স্মরণে রাখা দরকার, ইসলামে কোন গোত্র বা গোষ্ঠীর নামে তৈরি মসজিদে সালাত হয় না। যদি কোন মসজিদকে ওমুকের মসজিদ বলা হয় তবে তা ওমুকেরই ঘর, আল্লাহর ঘর নয়। কোন ব্যক্তি, জাতি, গোষ্ঠী বা বর্ণের নামে নির্মিত মসজিদ আল্লাহর ঘর নয়।
এমন মসজিদও আছে যেখানে মাইক দিয়ে টাকা তোলা হয় কিন্তু তাতে আশপাশের লোকদের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে কি-না তা ভাববার অবকাশ তাদের নেই। মসজিদের জন্য রাস্তার পাশে চৌকি বসিয়ে চাঁদা তোলা হয়, যানবাহনগুলোতে কালেক্টর দিয়েও চাঁদা তোলা হয় আবার নামাজের পর দানবাক্স ঘুরিয়েও অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এসব কি ইসলামের কোনো আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? জানা যায়, মসজিদের জন্য আদায়কৃত অর্থ থেকে কালেক্টররা কমিশন খায়। মসজিদের জন্য আদায় করা অর্থ থেকে কোনোরকম কমিশন গ্রহণ কি কুরআন সম্মত?
দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদ। আর দুনিয়ার সর্বনিকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে বাজার। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের নীচে, আশে-পাশে রয়েছে নিকৃষ্ট পণ্যের উৎকৃষ্ট বাজার। এক সময় ঢাকার পরিচয় ছিল বায়তুল মোকাররম মসজিদ। নবাবপুর থেকে উত্তরে তাকালে কাবা সদৃশ বায়তুল মোকাররম মসজিদ দেখা যেত। এখন আর সেই বায়তুল মোকাররমকে চেনাই যায় না। পূর্বপাশে তাকালে মনে হবে শিল্পকারখানার বিশাল টিনশেড। পশ্চিম পাশে তাকালে মনে হবে, একটি আধুনিক মার্কেট। দক্ষিণ পাশের অর্ধেক ঢেকে আছে যাত্রী ছাউনি দিয়ে। উত্তর পাশে তাকালে অসংখ্য কোম্পানির সাইনবোর্ড। কেন এমনটি হলো? টাকার জন্য? টাকার অভাব না-কি আদর্শের অভাব?
বাইরের আকৃতিতে অনেক উন্নত হয়েছে মসজিদ। খেজুর পাতা থেকে রূপান্তরিত হতে হতে কাঁচ, টাইলস আর গালিচার মসজিদ হয়েছে। আর ভেতরের দিকে অবক্ষয়ের এমন নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে যে অধিকাংশ মসজিদকেই ইসলামের স্মৃতি কংকাল বললে অত্যুক্তি হবে না। এসব মসজিদের সাথে জীবনের কোন সম্পর্ক নেই, সমাজের কোন সম্পর্ক নেই, বিশ্বাসী চেতনার কোন সম্পর্ক নেই, শান্তির প্রেরণা নেই, মঙ্গলের নিশানা নেই।  তাই এসব মসজিদে নামাজ পড়েও কোনও পরিবর্তন আসছে না। দেশ ও সমাজ দিন দিন ধাবিত হচ্ছে অবক্ষয়ের অতলান্তে। ১৫ কোটি মুসলমানের বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন, উৎপীড়ন, শোষণ, কালোবাজারি, মওজুদদারি, মুনাফাখোরিতে রেকর্ড করেছে। দেশে চলছে সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও চরিত্রহীনদের রাজত্ব। এর কারণ কি? এতো হাজী, এতো হাফেজ, এতো খতিব, ইমাম, আলেম-ওলামায়ে দ্বীন, মুফতি-মোহাদ্দেস থাকতে দেশের এ দশা হবে কেন? তাহলে কি এঁরা রসূল (সা.)-এঁর দ্বীনকে অনুসরণ করে না? সৎ কাজের নির্দেশ ও অন্যায় কাজে বাধা দেয় না? কি দেখি আমরা তাদের আচরণে? অসংখ্য দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে আলেম-ওলামারা আজ পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, কাদা ছোড়াছুড়িতে নিজেদের শক্তি, শ্রম, মেধা ও সময় নষ্ট করছেন। টাকার বিনিময়ে সেই গতানুগতিক ওয়াজ, নসিহত, টিভিতে আলোচনা, মোনাজাত চলছে বিরতিহীনভাবে। এসব করে শান্তির প্রচার ও প্রসার হয় না।
মসজিদ  যখন আদর্শচ্যুত হয় তখন তাকে বলে অনিষ্টকর মসজিদ বা মসজিদে দিরার। মহানবী (সা.) মসজিদে দিরার ধ্বংস করার জন্য লোক প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর নির্দেশে আদর্শ বিচ্যুত মসজিদে আগুন লাগিয়ে সমূলে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। যে মসজিদের কারুকার্য আছে কিন্তু ভেতরে আল্লাহর সাথে সংযোগ প্রচেষ্টাকারী নাই, সে মসজিদের তুলনা নদীর তীরবর্তী এমন মাটির সাথেই করা যায়, যাকে পানির ঢেউ নিচের দিকে সরিয়ে দেয়, কিন্তু উপর থেকে মনে হয় সমতল ভূমি। এর নির্মাতারা যেন জাহান্নামের পথ পরিষ্কার করলো। সুরা তওবার ১০৮ নং আয়াতে কুরআনে বলছেন  - 'লা- তাকুম ফীহি আবাদান ....'  'তুমি (সালাতের জন্য) এতে কখনও দাঁড়িয়ো না, যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন হতেই তাকওয়ার উপর স্থাপিত হয়েছে ওতেই সালাতের জন্য দাঁড়ানো উচিত'।
একমাত্র সে মসজিদই সম্মানের যা তাকওয়ার সাথে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্মিত হয় এবং যে মসজিদ নির্মাণে লোক দেখানো মনোবৃত্তির লেশ মাত্র থাকে না। কোন একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া মসজিদ নির্মিত বা পরিচালিত হলেই এটা বিপথগামী হয়ে দিরার মসজিদে পরিণত হতে বাধ্য। তাকওয়ার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত সব মসজিদেরই এক রূপ। যুগে যুগে দেশে দেশে আদিকাল থেকে শুরু করে সর্বকালের সব আদর্শিক মসজিদই এক। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেই আলেম-ওলামারা পরস্পর হানাহানি করে থাকে।
কুরআনের আদর্শে মসজিদের রূপান্তর চাই। এ জন্য প্রথমে দরকার নিজের রূপান্তর। এমন এক রূপে নিজেকে রূপান্তরিত করা চাই যা এক এবং অদ্বিতীয়। যার রূপের কোন অন্ত নাই তাঁর রূপে রূপান্তর। এ রূপান্তর সাধিত হলে প্রাণবন্ত, কর্মচঞ্চল মসজিদ নির্মিত হবে। হয়তো, পাতা আর মাটি হবে এর বাহ্যিক উপাদান। হয়তো, লোকে তাকে মসজিদ বলে স্বীকারই করবে না কিন্তু এর ভেতরে মানুষ হবার শিক্ষা থাকবে, থাকবে মানবিক গুণাবলির বিকাশ প্রচেষ্টা, পরস্পরের প্রতি মায়া ও প্রীতি, মমতা ও ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগ। এমন একটা মসজিদের খুব প্রয়োজন - যেখানে মসজিদে নব্বীর কর্মসূচী থাকবে। যে মসজিদের মিম্বর থেকে শান্তি ও মঙ্গলের আহ্বান জানানো হবে, অত্যাচার প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হবে, সত্যে প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করা হবে,  যে মসজিদে পরিশুদ্ধ হবে মানবাত্মা, যে মসজিদে সালাতের আগে ও পরে থাকবে সেবা কার্যক্রম, যে মসজিদ হবে আশ্রয়হীনের আশ্রয়স্থল, যে মসজিদে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। যে মসজিদ হবে মানব জাতির মিলন কেন্দ্র।

দেশের প্রতিটি মসজিদ, গীর্জা, মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার সময় এসেছে যাতে সেখানে মানবিক অনুশীলন হয় এবং মুক্ত চিন্তার মুক্ত-মানুষ গড়ে উঠে। এটাই সময়ের দাবি দেশ ও জাতির কল্যাণে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন