শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

চেতনায় নজরুল


চেতনায় নজরুল

সংলাপ ॥ ‘যারা আমার নামে অভিযোগ করেন তাদের মতো হলুম না বলে - তাদের অনুরোধ, আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে তারা যেন সকলের করে দেখেন, আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের-সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব, আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ [১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর জবাবে, প্রতিভা ভাষণ] অথবা- ‘এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গন্ডি কাটাইয়া সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ [নবযুগ প্রবন্ধ]
কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীর রুলে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য দীপ্যমান। তার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্যে নজরুল একক, অদ্বিতীয় ও তুলনা রহিত। যেটিকে কেউ পারেনি ছুঁতে। নজরুল আজও সে বৈশিষ্ট্যে অন্য অনেককে রেখেছেন দৌঁড়ের ওপর। বাংলার প্রধান দুই সমাজ হিন্দু-মুসলমান উভয়ের সংস্কৃতির পুরাণ ও ইতিহাসকে বেণীবদ্ধ করে কাব্যে রূপদান করেছেন। -
এই দু’টি সমাজের ওপর ভর রেখে নজরুল এমন এক সাহিত্য সৃষ্টি করলেন যা গোটা বাংলা সাহিত্যে একক ও অদ্বিতীয়। এ ক্ষেত্রে তিনি অন্যদের পেছনে ফেলে বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সত্যিকার শিল্পিত তীর্থ গড়ে দিয়েছেন। এ ধারায় দু’ধারি তলোয়ার ব্যবহার করেছিলেন নজরুল, যেখানে তার সমকক্ষ কেউ নেই। এখানে তার আগেও নাই কেউ, পরেও না। সেই পরিচয় নজরুল দিচ্ছেন। যে পরিচয়ে তিনি ব্যবহার করলেন হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত পুরাণ আর ইতিহাস। ‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্য করতলে/তাজি বোররাক আর উচ্চৈঃস্রবা বাহন আমার হিম্মত হ্রেষা হেঁকে চলে/’সত্যিই নজরুল হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই সতর্ক করে হাঁকছেন ‘ঘর সামলে নে এই বেলা তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন/আল্লাহ্ ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন/ধর্ম কলহ রাখ দু’দিন।’ পরধর্ম অসহিষ্ণুতার জন্য নজরুল আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে বিশ্বস্ত হয়ে আছেন। যে বিশ্বস্ততার বহুতল ভবন থেকে দাঁড়িয়ে তিনি তীব্র শ্লেষের মিশ্রণে বলতে পারেন- ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছো জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে/ জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।’ প্রশ্ন করে সাথে সাথে সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারা এ তো কেবল এ স্বভাবজাত কবির পক্ষেই সম্ভব। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, জাত-পাতের মিথ্যে অহঙ্কার, হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষ শেষ করার জন্য একটা সমাধান তিনি করতে চেয়েছেন। তাই প্রশ্নের উত্তরে এই ছোঁয়া-ছুঁয়ির প্রশ্নে তিনি হলেন আরো বেশি কঠোর   ও আপসহীন। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের কুটিরে কুঠারের আঘাত হেনে তছনছ করছেন এভাবে ‘হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,/ তাই তো বেকুব করলি তোরা এক জাতিকে একশ’ খান।’ তখন সাম্প্রদায়িকতা এত বেশি চেপে বসেছিল যে, যেখানে একজন হিন্দু, একজন মুসলমানের এক গ্লাস পানিতে ঠোঁট বসালেই যেন জাত চলে গেল। এখান থেকে বাঁচাতে সেই গ্লাসে একটি পাইপলাইনের সাহায্যে পানিটুকু পান করাতে নজরুলই এগিয়ে এসেছিলেন। ‘যে জাত ধর্ম ঠুনকো তত/আজ নয় কাল ভাঙবে সেত,/যাকনা সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া।’ এখানে কারো রক্তচুকে পরোয়াই করেননি তিনি। তার এই  স্ব-সৃষ্ট পথে তিনি একাকী হেঁটে গেছেন বহু দূর; যেখানে যদিও ছিল ভয়ানক আঁচড়ের ভয়, হিংস্রতার ভয়। এ ক্ষেত্রে তিনি অপেক্ষাও করেননি কারুর জন্য। দেশ ও দশের মঙ্গলের প্রদীপ তো তখন তারই হাতে। নজরুলের উচ্চকিত কণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে সেই ঘোষণা ‘যে যায় যাক সে। আমি আছি। আমি নতুন করে জগৎ সৃষ্টি করব। নতুন আলোর প্রাণস্পন্দনে সৃষ্টির আঙিনা তুলব ভরে।’ নজরুলের সেই নতুন জগৎটিই তো হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার চিত্তবৃত্তি।
তার এমন সব বলিষ্ঠ উক্তির পেছনে যে যুক্তি কাজ করেছে তা হলো  তার উদার, মুক্ত, স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন, কল্যাণী ও পবিত্র দৃষ্টি। যে দৃষ্টি সৃষ্টিকর্তা তার আপন মহিমায় ধারণ করে আছেন। বাংলা সাহিত্যের এই শ্রেষ্ঠ পুরুষ একমাত্র, শুধুমাত্র, কেবলমাত্র একটি জাতির একটি গোষ্ঠীর হয়ে যাবেন তা কেমন করে হয়! তাই তিনি হলেন না কোনো জাত-পাতের। তার বলার ঢংই যেন আলাদা ‘সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্বমায়ের বিশ্বঘর, /মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্মপর।’ আমাদের এই আত্মপরের ঘরে সুচ বিদ্ধ করেছেন কবি এভাবে  ‘বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত/কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ/ নারায়ণের জাত যদি নাই/তোদের কেন জাতের বালাই’ এই বালাইয়ের দাওয়াই দিতে গিয়ে নজরুল যেন মিলে যান তুর্কি কবি আমির খসরুর সাথে। সেই মিলটা কাকতালীয় বা দৈবাৎই যেন। দু’জনই জাতের রোগের বিশেষজ্ঞ হয়ে চমৎকার ট্রিটমেন্ট করেছেন। তুর্কি কবি যেমন বলেন  ‘হিন্দু বাচ্চে বা বনিগর আজব দুসন ধরতো হ্যায়/দর আকতে সুমন গুফতন মুহজফুল করতো হ্যায়/গুফতম বিয়াকে বর লবেতু বুসে বগারম’-একটা হিন্দু ছেলেকে দেখো, কী আশ্চর্য সৌন্দর্যের অধিকারী। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে যেন ফুল ঝরে পড়ে। তাকে বললাম, কাছে এসো, তোমার ঠোঁটে চুমু খাব।
সে বলল, আরে রাম, তাহলে আমার ধর্ম নষ্ট হবে। এই ধর্ম থেকে জাত নামের বজ্জাত শব্দগুলো তুলে দিয়ে, মনুষ্যত্বের ওপর পশুত্বের দখলদারিত্বে ধিক্কার জানিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ঘটাচ্ছেন নজরুলও এভাবে  ‘মানুষ আজ পশুতে পরিচিত হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ল্যাজ গজিয়েছে ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা মুখে। ওরা মারছে লুঙ্গিকে, মারছে নেঙটিকে। মারছে টিকিকে, মারছি দাড়িকে। বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির কি অবসান নেই।’ অবসান হোক আর না হোক, নজরুল তার বলা থেকে কখনও অবসর নেননি। যে নজরুল ভাবগত আদর্শে দংশিত, মানবিক মূল্যবোধের জন্য মূল্যবান, ঐক্যের ঔদার্যে উদার, তিনিই তো ধর্মীয় বিবেকহীনতা ও হিন্দু-মুসলমানের এক কাতারে কাতারবদ্ধ হতে খোলাখুলি মত প্রকাশ করবেন।
দেখিলাম, ‘হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিলো না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চির কলঙ্কিত হইয়া রহিল।’
হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে তীব্রভাবে কশাঘাতে জর্জরিত করার শক্তি নজরুল লাভ করেছিলেন মানুষের প্রতি স্বাভাবিক মমত্ব ও ধর্মীয় বহিরাবরণের অন্তঃসারশূন্যতা থেকে। এই শক্তিই তাকে জাতির মুক্তির পথে ধাবমান করেছিল। এখান থেকেই সাহস ও প্রেরণা নিয়ে সাম্যবাদের গান গাইলেন ‘মানুষেরে ঘৃণা করি/ও কা’রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি/ ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে/ যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো/মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’ মানব জীবনের মানুষের এক বৃত্তির প্রতিনিধিই যেন নজরুল। মানুষে মানুষে ভেদ নেই বলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই একটা বিশিষ্ট দিকের তুলনারহিত টাইপ বা প্রতিনিধি তিনি।
হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির ঐতিহ্য থেকে রূপক হিসেবে উদাহরণ গ্রহণ করার ফলে তিনি নিজেই একজন উদাহরণ। উভয়ের কাছে আজও তিনি প্রিয় প্রাঙ্গণ। এ ক্ষেত্রে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মন্তব্যের সত্যতা স্বীকার্য। তিনি লিখেছিলেন- ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নি কো নজরুল।’ অন্য দিকে রবি ঠাকুরের একান্ত সচিব নজরুলকে একান্ত থাকতে দিলেন না। ১৩২৭ সালে মোসলেম-ভারত পত্রিকায় সেই সুধাকান্ত রায় চৌধুরী দু’টি কবিতা লিখেছিলেন। একটি মহাত্মা গান্ধীকে অন্যটি নজরুলকে নিয়ে।- ‘ছন্দে গানে বাজাও কবি বাজাও প্রাণের গান/মুগ্ধ করো বিশ্বজনে দাও গো নূতন প্রাণ।’ নজরুল কথা রেখেছেন। নূতন প্রাণও দিয়েছেন। গানের গানও গেয়েছেন। যে গানে ছিল কয়েক টন স্বর্ণ। যে প্রাণে ছিল লক্ষ কোটি প্রাণ। তাই বলে নজরুল নিজের ধর্ম ত্যাগ করেননি। অন্যের ধর্মকেও দেখেছেন উদারচিত্তে। হিন্দু পুরাণের গভীরে নিমগ্ন হওয়ার কারণও কিন্তু এটি। গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল, জেন্দাবেস্তা, গ্রন্থসাহেব এবং মার্কস বাকুনিন বা রাসেল পড়ার পরও নজরুল লিখতে পেরেছিলেন, ‘শহীদী ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারি/হবে দুনিয়াতে আবার ইসলামি ফরমান জারি।’ অথবা, ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য তার নিজস্ব বক্তব্য- ‘ঐ ইসলাম ডুবে যায়।/ যত শয়তান/ সারা ময়দান/ জুড়ি খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়গান শোন গায়/ আজ শখ করে/জুতি টক্করে/তোড়ে শহীদের খুলি দুশমন পায় পায় -/ওরে আয়!/তোর জান যায় যাক পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায়।/ধর ঝঞ্ঝার ঝুঁটি দাপটিয়ে শুধু মুসলিম পাঞ্জায়।’ এসব চিন্তা কিন্তু ধর্ম ও দর্শনের ঊর্ধ্বে ইসলামকে স্থান না দিলে এমন কথা লেখা যেতো না। ইসলামই যে সমস্ত সৌন্দর্যের আকর। ইসলামের শিক্ষা তো এটি যে মায়ের পেটে যেমন তার কচি সন্তানটি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ও নির্ভয়ের, তেমনি ভিন ধর্মের লোকেরাও ইসলামের অনুসারীদের কাছে তদ্রুপ নিরাপদ। তারপরও এখানে প্রশ্ন তোলা সম্ভব, তাহলে তিনি কেন বললেন, ‘আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। এই প্রশ্নের জবাব তার পূর্বোক্ত অভিভাষণ থেকে নেয়া যায়। তার উপলব্ধি সুন্দরের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন- ‘আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি। তার চোখে চোখভরা জলও দেখেছি।
শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাকে ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি। ফাঁসির মঞ্চেও তাকে দেখেছি। আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ করে দেখার স্তব- স্তুতি।’ এই ‘সুন্দর’ কিন্তু ইসলামের ভাবাদর্শ বা চিন্তাদর্শ থেকে দূরে ঠেলে দেয়ার পথ খোলা নেই। মোতাহার হোসেনকেও একই বক্তব্য প্রদান করেছেন চিঠির মাধ্যমে। ‘প্রিয় মোতাহার! আমার কেবলই মনে পড়ছে [বোধ হয় ব্রাউনিং] এর একটি লাইন- How sad and bad, and mad it was But than, was it was sweet!’- আমার মনে হচ্ছে ছোট্ট দু’টি কথা- সুন্দর ও বেদনা। এই দু’টি কথাতেই আমি সমস্ত বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারি।’ সুন্দর-অসুন্দরের একই বক্তব্য ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জুবিলী উৎসবের অভিভাষণ দিয়েছিলেন- ‘যিনি সকল কর্মের, ধর্মের, জাতির, দেশের, সকল জগতের একমাত্র পরম স্বামী পতিত্ব বা নেতৃত্ব করার একমাত্র অধিকার তাঁর। এ অধিকার মানুষেও পায় মানি। কিন্তু সে পাওয়া যদি তার কাছ থেকে না হয়, তারে বলে অহঙ্কার। এই অহঙ্কারকে আমি অসুন্দরের দূত মনে করি। এ উবারহব নয়, উবসড়হ।’ অহঙ্কার, অসুন্দর, কুসংস্কারকে নজরুল ভয়াবহ ভয় করতেন। তিনি তো অহঙ্কারকে আখ্যাও দিলেন অপদেবতা বলে। আসলে নজরুল ইসলাম মানবতার কথাই বলতে চেয়েছেন এবং তা করেছেনও। তিনি দৈত্যশক্তি বা পশুত্বকে বিনাশ বা উৎখাত করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। জালিম, অত্যাচার ক্ষত্রিয়কূলকে সমূলে উৎপাটন না করলে নতুন পৃথিবী নতুন সমাজ গঠন এবং সেখানে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার লক্ষ্যও এক আজীব- ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না’। তখনই তিনি ‘রণক্লান্ত’ হয়ে শান্ত হতে পারেন। অথবা তার খুনঝরা লেখায় অশুভ শক্তির আসর কেটে শুভ শক্তির নদীতে আছড়ে পড়বেন এমনই- ‘প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।’ ভীতিহীন এসব সাহসী উক্তি শুধু মানবতার মুক্তির জন্য তিনিই কেবলমাত্র উচ্চারণ করেছেন। কাজেই অনুভূতির ক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হলেও প্রকাশের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির উভয় ধারাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি। এখানেই নজরুলের মহত্ত্ব যে, হিন্দু ও মুসলমান এই দুই বাঙালি প্রধান, ধর্ম সম্প্রদায়কে গভীরে ধারণ করেই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন অন্য লোকে।

সম্প্রদায়োর্ধ্ব বলেই বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, আরবি ও ফারসি যে সাতটি ভাষা জানতেন তা থেকে দুই হাতে পরিগ্রহ করেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার শ্রেষ্ঠপুঁরুষ হিসেবে নিজেকে উন্মোচিত করলেন। সম্প্রদায়োর্ধ্ব সমস্ত কাঁচামাল জমা করলেন হিমাগারে। আর হিমঘরে পাঠালেন জাত-পাতের সাম্প্রদায়িকতা নামের পরিত্যক্ত, উচ্ছিষ্ট বস্তুগুলো। যার কারণে নজরুলের আসনটি বাংলা সাহিত্যের আকাশ ছেদে ঝলমলে কম্পিত হলো। আর বাঙালি পেল সর্বকালের শ্রেণী নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন