মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০১৩

পৃথিবী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে


পৃথিবী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে

 
দিগন্ত ॥ সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও প্রকৃতির যে ভয়াবহ ক্ষতি করছে মানুষ, তা খোদ সভ্যতাকেই ঠেলে দিয়েছে বিপর্যয়ের মুখে। নগর বিকাশের জন্য মানুষ ধ্বংস করেছে কৃষিজমি ও বনভূমি। শিল্প বিকাশের জন্য হামলা করেছে প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর। নগরজীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও গতির প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। সভ্যতার গতি হয়েছে একমুখী। ধরিত্রীকে মানুষ শুধু পরিবর্তিতই করেছে ক্রমশ, তাকে ফিরিয়ে দেয়নি কিছুই। বিরামহীন কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে, ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হিমবাহগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত উষ্ণতার প্রভাবে হিমবাহগুলো গলতে শুরু করলে পৃথিবীতে সৃষ্টি হবে নতুন এক বিপর্যয়ের। বর্তমান সভ্যতা যে বিপর্যয় আর কখনোই প্রত্যক্ষ করেনি। অতিরিক্ত খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্‌াস, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে হতচকিত করে দিচ্ছে বারবার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমান শতাব্দীর শেষ দিকেই হয়তো এমন বিপর্যয় ঘনিয়ে আসতে পারে যার ফলে সভ্যতার শেষ স্মৃতিচিহ্নগুলো ধরে রাখাও অনেক কঠিন হবে।

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, পৃথিবী বিপর্যয়মূলক ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পৃথিবী এমন একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছে, যেখানে ধ্বংস আর অবিশ্বাস্য সব পরিবর্তন সংঘটিত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দরকারি প্রাণিকুল। আর এই ধ্বংসলীলা এমন মাত্রায় সংঘটিত হবে, যা ১২ হাজার বছর আগে হিমবাহ গলতে শুরু করার পর আর ঘটেনি।

বিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যাপক এই ধ্বংসলীলায় বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী হারিয়ে যাবে। ব্যাহত হবে ফসল উৎপাদন। পৃথিবীজুড়ে দেখা দেবে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি বারনস্কি বলেন, 'পৃথিবী খুবই ভিন্নমাত্রা পরিগ্রহ করছে। এই শতাব্দীর শেষ দিকে এই বিপর্যয়ের জোর সম্ভাবনা আছে।' তিন হাজার বছরেরও কম সময় আগে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ বরফে ঢাকা ছিল। কিন্তু এখন প্রায় বরফহীন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এই গ্রহের বেশির ভাগ বিলুপ্তির ঘটনা এবং পরিবেশ-প্রতিবেশগত পরিবর্তন গত ১৬০০ বছরে ঘটেছে। শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর ৩৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়ার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা অতীতের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। তিনি বলেন, ভূপৃষ্ঠের ৪৩ শতাংশ মানবজাতি কৃষিজমি ও নগরায়ণে রূপান্তর করেছে, যা সর্বশেষ বরফযুগে ছিল ৩০ শতাংশ। অধিকন্তু জনসংখ্যা বাড়ার কারণে পৃথিবীর সম্পদের ওপর নজিরবিহীনভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বারনস্কি বলেন, 'আমরা যুগসন্ধিক্ষণে। যদি আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো পদক্ষেপ না নিই, তাহলে সত্যিই সেই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির শিকার হব।'

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী ১০০ বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধান উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে মনে করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। বাতাসে বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ফল ও ফুলের রেণু, মাছের ডিম ও পোনা নষ্ট হচ্ছে। এতে শস্য ও ফল আগের চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। অনেক ফলবতী বৃক্ষ পুরোপুরি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাতাস, পানি ও মাটি। পরিবেশ দূষণের কারণেই ওজোন স্তরে ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও আবহাওয়ার পরিবর্তন। মিল-ফ্যাক্টরি ও শিল্প-কারখানাগুলো থেকে যে রাসায়নিক বর্জ্য বের হয়ে আসছে সেগুলো দূষিত করছে বাতাসকে। তাছাড়া পানি যখন বর্জ্য হিসেবে বের হয়ে আসে কিংবা তরল রাসায়নিক বর্জ্য মাটিতে পতিত হয় এবং পরে পানিতে পৌঁছে, তখন তা পানি দূষণের জন্ম দেয়। রাসায়নিক দ্রব্য মাটিতে ফেলে দেয়ায় মাটিও দূষিত হয়ে পড়ে।

মানবজাতি নগরায়নের স্বার্থে বনবাদাড় উজাড় করে দিচ্ছে। জনসংখ্যা যত বাড়ছে পানির চাহিদাও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা শহরের ভূ-গর্ভস্থ পানি অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে এর স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। প্রতিদিনই টনকে টন গৃহস্থালির বর্জ্য স্তূপাকারে জমা পড়ছে। যদি এসব বর্জ্য সঠিকভাবে সমাহিত করা কিংবা ফেলার ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি হবে। তাছাড়া কলকারখানা ও গাড়ি-বাড়ি পরিচালনার কারণে যে ধোঁয়াগুলো বের হয়ে আসছে সেগুলো শুধু বাতাসকেই দূষিত করে না বরং পানিকেও দূষিত করে ফেলছে।

সারাবিশ্বে ১৯৭২ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উদযাপনে সেমিনার, গবেষণা হয় কিন্তু কোন পরিবর্তন আসে না মানুষের ভোগবাদী আচরণে। পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বারবার বৈঠকে বসে নিজ দেশের ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরে বেরোতেই পারছেন না। বারবার শীর্ষ সম্মেলনগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। অতিদ্রুত সংকট থেকে উত্তরণের কোনো কর্মপরিকল্পনার সম্ভাবনাই  দেখা যাচ্ছে না। ধরিত্রীকে রক্ষায় একের পর এক উদ্যোগের ব্যর্থতা  দেখে মনে হয়, সর্বনাশের আশায়-আশঙ্কায় বসে থাকা ছাড়া হয়তো করার কিছুই নেই। এভাবে চলতে থাকলে আজ থেকে ১০০ বছর পর কি হবে তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়! ১০০ বছর পর গাছপালার আরও বিলুপ্তি ঘটবে, শহরের সংখ্যা ও আয়তন আরও অনেক বাড়বে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯শ কোটি, জনসংখ্যা, কলকারখানা আর ইটের দালানে ছেয়ে যাবে পৃথিবীর বুক। বিষিয়ে  উঠবে পৃথিবীর বাতাস, প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বিশ্ব পরিবেশ।

আমাদের উত্তরপুরুষদের আমরা কি দিয়ে যাবো? বুক ভরা বিষ। সে বিষ পান করে তারা কি নীলকণ্ঠ হতে পারবে? নাকি বিষক্রিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে এবং ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে?  মানুষ কি ঘুরে দাঁড়াবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন