কথায় কথা রাখে
সংলাপ ॥ কথায় কথায় রাজ্যে ফিরে এলাম। কথা নিয়ে দুনিয়ায় যে কত কথা
হল, হচ্ছে এবং হবে তার কি ইয়াত্তা
আছে? কথার ধারায় মানুষ কখনও কুপিত
বা কখনও মোহিত হয়। কথা মানুষকে কী পরিমাণ অনুভূতি প্রবণ করতে পারে তা যে সব ব্যক্তি
কথা-যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে তারাই সেটা ভালো বলতে পারবে। কথামৃত পানে একজন মৃতের মধ্যে
প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসতে পারে পক্ষান্তরে ওই কথারই মারপ্যাঁচে একজন সজীব ব্যক্তি মুহূর্তে
নির্জীব হয়ে যেতে পারে। অবশ্য যারা কথার ধার ধারে না তাদের কথা আলাদা। কারণ তাদের মধ্যে
এমন কিছুর ধার আছে যার ধারায়, তারা ধরাতে, কথার ধারকে ধারশূন্য করে দেয়। যদিও ওই শ্রেণীর
মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে পান্ডা জাতীয় প্রাণীর মতই দুর্লভ।
কথা কাটাকাটিতে প্রতিপক্ষ
কথকদ্বয়ের কথন শক্তিতে ভারসাম্য বিরাজ করলে কথায় কথা বাড়ে। কথার আঁটুনিতে তারা একে
অপরকে আটকাতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে কথার তুবড়ি ছুটিয়ে নিজেদের কান্ডজ্ঞান হারিয়ে তুলকালাম
কান্ড বাঁধিয়ে ফেলে। তখন তারা বেফাঁস কথাবার্তা বলে পরস্পরকে ফাঁসাতে কসুর করে না।
অনেক সময় কথা জীবদেহের রূপ
নেয়। অর্থাৎ কথার আদল তৈরী হয়। হাত-পা শূন্য কথাই যখন অন্যের কাছে যায় তখন সেটার হাত-পা
বের হয়। এখানেই যদি কথা বিস্তারের গতি রোধ হত তা হলেও না হয় কথা বেচারার দুর্দশা লাঘব
হত। কিন্তু না সেটা যখন পাঁচকান ঘুরে আসে তখন দেখা যায় নাবালক কথা বেচারার হাত পায়ের
সাথে চোখ, মুখ, নাক প্রভৃতি বের হয়ে তা পূর্ণ সাবালক কথায় পরিণত
হয়েছে। বালকের সাবালকত্ব সমাজ জীবনে ইতির প্রভাব ফেললেও কথার সাবালকত্ব অনেক ক্ষেত্রেই
বারুদের স্তূপে ম্যাচের শলাকা ছুঁড়ে দেয়ার কাজ করে।
ব্যবসায় জগতে কথা একটি আকর্ষণীয়
ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেমন বিজ্ঞাপনের কথাই ধরুন না সেখানে শুধু কথারই জয়জয়কার। কথার
বাঁধুনিতে উৎপাদক ভোক্তাকে বাঁধার নিরন্তর প্রচেষ্টায় কতই না কথার শ্রাদ্ধ করে। ভোক্তা
কথার শ্রীর সাথে অনেক সময় পণ্যের শ্রীর মিল খুঁজে পায় না। এবং 'যে কথা সেই কাজ' এই নীতিকথায় দুর্নীতি থাকায় ভোক্তা পণ্যভোগে দুর্ভোগ পোহায়।
ফেরেববাজার কথার ফের ফেরি
করে অনেক কিছুরই হেরফের করে। এই হেরফেরের ফেরা ফিরিতে সাতপাঁচে না থাকা মানুষগুলো জিলপির
প্যাঁচে জড়িয়ে জড়বৎ জীবন-যাপন করে।
কথা বেচে খাওয়ার প্রতিযোগিতায়
রাজনীতিক দলের নেতা-কর্মীরা নিঃসন্দেহে অন্যান্যদের চাইতে কয়েক কদম এগিয়ে। কারণ কথা
তাদের কাছে এমন একটি মূল্যবান ওষুধ যা তাদের বাঁচিয়ে রাখে। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের
কথার ধরণই হল, কথায় কথায় জনসাধারণকে
কথা দেয়া এবং শেষমেশ কথা না রাখা। কিন্তু প্রতারিত জনগণ আর কতকাল কথার কথা শুনবে? তারা এখন কথার মত কথা শুনতে চায়। দুর্ভাগ্যের কথা
তাদের মধ্যে এখনও সেই কথা শিল্পী আসেনি যার মুখ থেকে হতাশাগ্রস্থ নর-নারী কাজের কথা
শুনবে।
এই কথা খেলাফির সংস্কৃতিতে
যখন কেউ কথা রাখে তখন তার কথা ডাকের কথায় পরিণত হয়। কারণ তার ডাকাডাকিতে সে যুগের ডাকহরকরার
বিশ্বস্ততা প্রতিফলিত হয়। কাউকে দু-চার কথা বলেনি বা কারো মুখ থেকে দু-কথা শোনেনি এমন
দু-চারটে মানুষে অস্তিত্ব দুনিয়ায় সত্যিই দুর্লভ। কথা শোনার জন্য চাই শ্রবণ ক্ষমতা
এবং কথা শোনানোর জন্য বাকপটুতা। পৃথিবীতে কথা শোনানোর লোকের সংখ্যাই বেশি। কথা শোনা
লোকের সংখ্যা ঠিক সেই পরিমাণেই কম।
কানকথায় কানভারী করার ব্যাপারে
মহিলারা বেশ অগ্রণী। দু'তিনজন মহিলা একসঙ্গে
বসে গল্পগুজব করছে অথচ কানকথা নিয়ে তারা কানাকানি করছে না এমনতর দৃশ্য তাদের স্বভাব
বিরুদ্ধই বটে।
ছোটমুখে বড় কথা এই প্রবাদটি
হামেশা শুনলেও বড়মুখে যে ছোটকথা শোনা যায় এমন অসঙ্গতি কি কেউ লক্ষ করেছেন? এই অসঙ্গত কথাটি রাজনীতিক মঞ্চে ইদানিং প্রবল দাপটের
সাথে রাজত্ব করে যাচ্ছে। রুই-কাতলা গোছের নেতা-নেত্রীর মুখ থেকে পুঁটি মাছের মত ছোট
ছোট অর্থাৎ কুকথা এমন সাবলীল ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসছে যে যার স্বরূপকে অনেকটাই পর্বতের
মুষিক প্রসব বলে বোধ হয়। পদস্থ নেতৃবৃন্দের মুখ থেকে নিঃসৃত এমন হাল্কা কথার ফুলঝুরি 'বড় মুখে ছোট কথা' টিকে ডাকের কথায় পরিণত করতে সহায়তা করলেও এতে 'খেলাফি কথা' সংস্কৃতির ভিতটিই মজবুত হবে। এহেন পরিস্থিতিতে যেটা মোটেই কাম্য নয়। কথা বিক্রেতারা
কথা দিয়ে মানুষের মন ভিজিয়ে দেয়। মন ভেজানো সহজ কাজ নয়, কেননা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা করতে
করতে মানব মন নিরস হয়ে পড়ে। এই নিরস মনে সরসতা আনতে বলিয়েদের বিভিন্ন কথা বলতে হয়।
পেশাদার কইয়েদের আপাত মধুর বাণীর বানে মুগ্ধ শ্রোতা মন মরুভূমিতে মরুদ্যান তৈরির কাজ
শুরু করে। কিন্তু কথার মানুষগুলো একসময় শ্রোতাদের মরীচিকার পেছনে ঠেলে দিয়ে কথা দিয়ে
চিড়ে ভিজিয়ে নেয়। আর সকলেই এটা জানা যে ভেজানো চিড়ে স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।
কথার পসার সাজিয়ে ধন-মানের
প্রসারে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের কথা ভান্ডারে কত কি কথার কথামালাই না সজ্জিত থাকে। ফায়দা
লুটতে সেগুলোর যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে তারা সদা তৎপর। মিষ্টিকথা, ধর্মকথা,
হিতকথা, রসের কথা, এগুলো দিয়ে কার্যোদ্ধার না হলে অকথা, কুকথা,
কটুকথা, ক্যাঁটক্যাটে
কথা ইত্যাদি প্রয়োগ করে। তাতেও নিজের কোলে ঝোল টানতে না পারলে শোরগোল, হট্টগোল,
হাঁকডাক, হুংকারের মত উচ্চনিনাদ
সম্পন্ন বাক্যবাণে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে ফেলে।
তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে
গুলের ব্যবহার বেশ প্রচলিত। গুলকে মাজনরূপে ব্যবহার করে যেমন অনেকে মশগুল হয়ে যায় তেমনি
নানান কিসিমের কথার মধ্যে গুল জাতীয় কথার সুকৌশল প্রয়োগে মজলিশ গুলজার হয়ে ওঠে। তাই
অনেক প্রেমিককেই দেখা যায় গুলের গুলতানিতে তারা প্রেমিকার গুলবদনে গুলশান গড়ে তুলছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন