বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫

টকশো

সময়ের সাফ কথা....
টকশো

সংলাপ ॥ বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুম কুমারী দাশ। যিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন, সেই কবে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ তখন ছিল ব্রিটিশ আমল। পরাধীন বাংলা তথা ভারতবর্ষে তখন মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক যেমন ছিল তেমনি ব্রিটিশদের চাটুকার, তোষামোদকারীদের সংখ্যাও নিশ্চয়ই কম ছিল না যারা খয়ের খাঁ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর তা না হলে কুসুম কুমারী দাশের মুখ দিয়ে এমন কথা বের হতো না। আবার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (ডিএল রায়) ‘নন্দলাল’ চরিত্রটিও আমাদেরকে ভীরু-কাপুরুষদের সম্পর্কে সচেতন রাখে সব সময়। ডিএল রায়ের কবিতার অংশটুকু ছিল অনেকটা এরকম-‘নন্দের ভাই কলেরায় মরে দেখিবে তাহারে কেবা/সকলে বলিল ‘যাও না নন্দ কর না ভাইয়ের সেবা/নন্দ বলিল, ভাইয়ের জন্য জীবনটা যদি দেই অভাগা দেশের হইবে কি/তখন সকলে বলিল বাহ্‌বা বাহ্‌বা ঠিক।’
দেখা যাচ্ছে, ভাই কলেরায় মারা গেলেও তার সেবায় এগিয়ে আসতে নন্দলালের অনেক যুক্তি ও ওজর আপত্তি। আজকের দিনে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে (ইলেক্‌ট্রনিক মিডিয়ায়) ‘টক শো’ নামের নতুন ধরনের অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে সাধারণ ও সচেতন দর্শক-শ্রোতার কাছেও কোন কোন সময় নন্দলালের চেহারাটিই ভেসে উঠে। দর্শক-শ্রোতার মনে প্রশ্ন জাগে, যারা গণমাধ্যমের পর্দায় নিজের চেহারাটুকু প্রদর্শনের সুযোগ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে থাকেন তাদের মধ্যে কয়জন নিজের ব্যক্তি জীবন ও কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ কথায় না হলেও কাজে বড়ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন? নাকি তারা নিজের জীবনে বড়ত্বের প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে শুধুমাত্র মিডিয়ার পর্দার ওপর ভরসা করে সর্ব ব্যর্থতার মাশুল দিয়ে যাচ্ছেন - নিরীহ নিরুপায় সাধারণ দর্শক-শ্রোতার ওপর চড়াও হয়ে। ভাবখানা এরকমই যে, বোকা দর্শক টিভির পর্দা খুলে আমাদের কথা না শুনে যাবে কোথায়? অবশ্য জনগণকে যারা বোকা ভাবেন, নিজেদেরকে বিশেষজ্ঞ, পণ্ডিত বা বিদ্বান মনে করে অনবরত কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের মনে হয় থামবার সময় এসেছে।
বর্তমানে দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে এসব ‘টক শো’র আবেদন দিন দিন ভয়াবহভাবে কমে যেতে শুরু করেছে। দর্শক-শ্রোতাদেরও তো একটা চিন্তা-চেতনার স্তর নিশ্চয়ই আছে। জরুরি অবস্থার সময়, মানুষের তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন থাকার সময় এই অনুষ্ঠানটিতে কত বিশিষ্টজনকেই কত বড় বড় কথা বলতে শোনা গেছে। আর ওই সময়টাই সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে। এত এত ‘টক শো’ এসব সমস্যার কোন সমাধানই দিতে পারেনি। সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, কামাল লোহানী ও ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বা ড. আরেফিন সিদ্দিকের মতো বিবেকবান ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গকে এতসব ‘টক শোতে’ ওই সময় দেখা যায়নি বললেই চলে। তবে তারা ঠিকই ছিলেন এবং আছেন জনতার চিন্তাচেতনার সাথে, মানুষের মুক্তির মিছিলে। ‘টক শো’র জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক তো বলেই ফেলেছিলেন ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না’ - বাণিজ্যিক গণমাধ্যম বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলো ওয়াহিদুল হককে একদিনের জন্যও তাদের ‘টক শো’তে উপসি'ত করাতে পারেননি।

ওয়াহিদুল হক আজ আর নেই। তিনি এখন বেঁচে থাকলে কী লিখতেন জানি না। তবে সাধারণ দর্শক-শ্রোতারা এখন ‘টক শো’ সম্পর্কে তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না। তবু ‘টক শো’ চলছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফ ইসলাম ‘টক শো’ সম্পর্কে দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ‘টক শো’তে কে কি বলছেন সে সম্পর্কে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না, আগ্রহটা শুধু কে বা কারা ‘টক শো’তে এসেছেন এবং তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই ঔৎসুক্য সবার। তাই সময় এসেছে ‘টক শো’ থেকে সাবধান থাকার। কথায় যেমন চিড়া ভিজে না মুখে বড় বড় কথা বলে সাধারণ মানুষের ভালবাসা-শ্রদ্ধা পাওয়ার দিনও যে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আর সৎ চিন্তা ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ‘টক শো’তে যারা যান টিভির পর্দায় তাদেরও সাবধান হওয়া উচিত তাদেরকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করছে কিনা, কোন অশুভ শক্তির ক্রীড়নক হয়ে যাচ্ছেন কি না। দর্শক-শ্রোতা মানুষ যে এখন আগের চাইতে অনেক সচেতন! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন