বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি!
সংলাপ
॥ আন্তঃদেশীয় পরিস্থিতিতে ও বহির্বিশ্বের নেক নজরে বাংলাদেশ নিকট অতীতে যেভাবে দুর্নীতিতে
পুনঃ পুনঃ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং যে মাধ্যম ও মিথ্যাচার বিদ্যার সংমিশ্রণে ষোলকলা পূর্ণ
করে দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বারবার করা হয়েছে এবং হচ্ছে এবং জাতিকে দুর্নীতিবাজ
ও সন্ত্রাসী হবার সূক্ষ্ম কারিগর শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশের কার্যকরী বিদ্যার নাম
‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’! একজন চোরকে ধরতে স্বয়ং চোরই যখন আমজনতার কাতারে মিশে দৌঁড়ায়
তখন কে চোর আর কে সাধু দিনরাত খুঁজলেও তার কুল-কিনারা যেমন মিলবে না ঠিক তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক
দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়নে পড়ে জাতি দিশেহারা। উত্তরণের পথ পেয়েও হাটতে পারছে না।
পুকুরচুরি
কিংবা অন্যের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করার পর যখন তা ঘরে এনে গচ্ছিত করা হয় তখন তা হয় দুর্নীতি।
আর এই অর্থ সম্পত্তিই যখন বুদ্ধি খাটিয়ে কলমের খোঁচায় দেশ-বিদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে
পাচার করা হয়, তখন তা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত! একটি দেশের আপাদমস্তক যখন
এই ধরনের মানসম্পন্ন দুর্নীতির চক্রজালে ফেঁসে যায়, তখন অতি দ্রুত ওই দেশ স্থবির দশায়
উপনীত হয়।
সরকারী
আর্থিক অব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম, অদক্ষ ও দুর্বল জনপ্রশাসন এবং
নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্যের কারণে সর্বোপরি রাজনীতিকদের অসচেতনতাই এর পেছনের মূল কারণ
বলে অভিজ্ঞ মহল চিহ্নিত করে।
গণতন্ত্র
একটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে জাতির চলমান প্রক্রিয়া যার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো এই বুদ্ধিবৃত্তিক
দুর্নীতি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বিক
অঙ্গনে যখন অর্থনৈতিক দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিন্তু
বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক আন্দোলন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ
করা সম্ভব নয়। কাজেই এইরকম বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিসমূহ চিহ্নিত করার কৌশল ও দমন পদ্ধতি
রাজনীতিকদের সাধারণ জনতাকেই সঙ্গে নিয়ে করার জন্য বুদ্ধিমান হতে হবে। নয়তো ওইসব দুর্নীতিবাজদের
নিষ্পেশনে তারাই হবেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের দরিদ্র জনগণের শ্রম ও ঘামের টাকায়
একটি দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন এ দেশের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে
আসছে (তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাঘববোয়ালদের নয়, বরং চুনোপুটি গোছের দুর্নীতিবাজদের)
এবং আইনজীবী ও আদালত খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে যেভাবে এক একটি মামলা দায়ের করেছে অতঃপর
সেসব মামলার প্রায় সবই যখন উচ্চ আদালতের নির্দেশে
স্থগিত হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিবাজ খুঁজে বের করা সরকারের কাছে
খুব কঠিন।
বর্তমানে
অধিকাংশ সচিবালয়ের ছোট বড়ো সচিব সাহেবরা দুর্নীতির সংজ্ঞা, অর্থ সব পাল্টে ফেলছেন।
এখানে তাদের ‘নিয়ম বহির্ভূত’ বা ‘অনিয়ম’ কথাটিই বাংলাদেশে এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ নীতি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ওপেন সিক্রেট কি বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আওতাভুক্ত নয়?
এ
দেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসের রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিকরা অধিকাংশই ছিলেন সৎ ও মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত
সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের কেউ কেউ ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী বিশেষ করে আইনজীবী। এখন বিত্তশালীরাই
সমাজের নেতা ও রাজনীতিক। তাদের কার্যক্রমের আড়ালে আছে সীমাহীন দুর্নীতি এবং তা হজম
করার অসামান্য শক্তিই হচ্ছে ধর্মকে হাতিয়ার করা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির মাধ্যমে। এই
প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞ হলেন তথাকথিত ইসলামপন্থী রাজনীতিকরা এবং ধর্মজীবী ধর্মবেত্তারা।
সাম্প্রতিক
কালে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির সবচেয়ে ভয়াবহ আখড়া হচ্ছে বিভিন্ন অঙ্গনে রাজনৈতিক দলীয়
দালালরা। ক্ষমতা কুক্ষীগত করে পাহাড় পরিমাণ সম্পত্তি আত্মসাত করার জন্য এইসব দালালরা
যেন এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
শিক্ষাই
জাতির মেরুদণ্ড অথচ এ দেশে বর্তমানে সবচেয়ে নীতিবর্জিত উপেক্ষিত খাত হচ্ছে শিক্ষাখাত।
দেশের মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠলে কাদের ক্ষতি তা বর্তমান সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। ইতোমধ্যে শিক্ষা খাত সংস্কারের নামে বিপুল অর্থ লুটপাটের
খবর ফাঁস হয়েছে। তারপর আছে গোদের উপর বিষফোঁড়া যেখানে দেশে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর উন্নয়নে
ও কল্যাণখাতে ব্যয় নেই বললেই চলে, সেখানে তথাকথিত প্রকল্প পরামর্শকদের ফি বাবদ কোটি
কোটি এবং শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের নামে ব্যয়বহুল বিদেশ ভ্রমণেই
কোটি কোটি টাকার উপরে খরচ করা হয়েছে।
দীর্ঘকাল
যাবৎ এ দেশের পশু চিকিৎসা খাতে বিনামূল্যে বিতরণের নামে দুর্মূল্যের ঔষধ এবং চিকিৎসা
সেবা পান না খামারীরা। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির ভেলকিবাজিতে সব পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য
কোনো দেশে যেখানে দুর্নীতিবাজদের পরবর্তী বংশধরেরা পুনর্বাসিত হচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা
দেশে রাজনীতি করছে অদৃশ্য দুর্নীতির কালো থাবা আরো সম্প্রসারিত করতে। জনগণ ও সরকারকে
সম্মিলিতভাবে তাদের এই কূটচাল প্রতিহত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
সময়
এসেছে এ দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী, বুদ্ধিবৃত্তিক সকল দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দিয়ে
দেশ ও জাতিকে প্রগতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেয়া। বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকরা
অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে সামনে সত্যের পথ ধরে এগিয়ে চলুক এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন