বৃহস্পতিবার, ৭ মে, ২০১৫

লাঠি-কাঠি

তারিফ হোসেনের সত্য....
লাঠি-কাঠি

লাঠি শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নানা অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ এসে যায়। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর উপস্থিতি, অবস্থিতি ও পরিস্থিতির বিষয়টি একাধারে যেমন নৈমিত্তিক তেমনি অনৈমিত্তিকও বটে। কোথায় নেই লাঠি? এ নিয়ে কথা কাটাকাটির পাশাপাশি লাঠালাঠি হলেও প্রশ্নটি কিন্তু খাঁটি। পুরান থেকে কুরআন, শ্মশান থেকে ময়দান অব্দি লাঠির অবদান। লাঠির ব্যবহারের বিষয়টি যদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় তবে আপনার চক্ষু হতে পারে চড়কগাছ, ছানাবড়া, স্থির বা অস্থির। লাঠি আপনি ব্যবহার করতে পারেন আবার আপনার ওপরও ব্যবহৃত হতে পারে। আক্রমণে-প্রতিরক্ষায়, প্রহারে-সংহারে, বাঁচতে-বাঁচাতে, হাঁটতে-হটাতে, রাখতে-রুখতে, আহারে-বিহারে, গালি ঠেকাতে, খুলি ফাটাতে, পেটাতে-পটাতে এইভাবে নানা কর্মকাণ্ডে আমরা লাঠির ব্যবহার দেখে আসছি। লাঠির ব্যবহার যেমন বিচিত্র এর ব্যবহারকারীদের মধ্যেও তেমন বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। মজুর-মেজোর, মহাজন-দুর্জন, মন্ত্রী-সান্ত্রী, পতি-নৃপতি, বুড়া-খোঁড়া, দৃষ্টিহীন-শক্তিহীন ইত্যাদি শ্রেণীর কাছে হাতির চেয়েও বিশ্বস- হাতিয়ার হাতের লাঠি। লাঠি তার নিজস্ব ধারে-ভারে-ব্যবহারে পৌঁছে গেছে আমজনতার ঘরে ঘরে। এর প্রতীকি ব্যঞ্জনা আনতে তাই অবস্থা-ব্যবস্থা-সংস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশব্দ ব্যবহার করি। ছন্নছাড়াকে ঠিক করতে তার মাথার ওপর ঘোরানো হয় ছড়ি। নবজাতকের যষ্টি তার মাতা; আর সেটা যে লাঠি ছাড়া ছুটতে পারে না তা তো বাংলাভাষী মাত্রই জানেন। ‘তেরে মেরে ডাণ্ডা করে দেব ঠাণ্ডা’- সুকুমার রায়ের এই ডাণ্ডা ছড়া সাহিত্যে অনন-কাল ঝাণ্ডা তুলে যাবে। দণ্ডধারী পেয়াদার আধুনিক সংস্করণ অস্ত্রধারী সৈনিক। শব্দতত্ত্বের ভাঙচুরের খেলায় লাঠি সামান্য দুমড়ে-মুচড়ে প্রথমে লড়ি তারপর নড়ি। ইংরেজ নিয়ে এল বেটন, ব্রিটিশ উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী করতে ভারতবাসীকে দিল পেটন। ব্যাটেলিয়ান, বেটন নিয়ে ইংরেজ চলে গেলেও দুশো বছরের রাজত্বকালে তারা পেটানোর সংস্কৃতি পাকাপোক্ত করে যায়। পাকিস্তানি আমলের মতো স্বাধীন বাংলাদেশেও পুলিশের হাতের লাঠি সাধারণ নাগরিকের পরিচর্যার চেয়ে তাদের চার্জ করার কাজে বেশি ব্যস্ত থাকে। তাই বলতে পারি পেটুক ধন্য আহারে, পুলিশ ধন্য প্রহারে। প্রচলিত-অপ্রচলিত বিভিন্ন ধারায় লাঠির ব্যবহারকে আরও সমৃদ্ধ করেছে বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচনের ক্ষেত্র। লোড যদি হয় ফ্লেঙি তবে তা বলবৎ রাখতে বাবাজিরা বাজি ধরতেও রাজি। এ জন্যই মোবাইল কোম্পানির ফ্লেঙিলোড অপশনটি হালে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শর্ত যত আঁটা গ্রাহক তত ঠ্যাটা অন্যদিকে শর্ত যত নমনীয় গ্রাহক তত কমনীয়। দাতা-গ্রহীতার চিরকালীন চাওয়া-পাওয়ার গড়মিল থেকেই তৈরি হয়েছে এই অন্যমিল প্রবচনটি-‘আঁটাআঁটি হলেই লাঠালাঠি’। ‘দশের লাঠি একের বোঝা’-কথাটি শুনতে বুঝতে কান-মন খুবই অভ্যস্ত। কিন্তু যদি বলা হয় ‘একের লাঠি দশের বোঝা’-তবে তা বোঝা কি সোজা? কথাটি বুঝতে একটু বিশেষ আখ্যা অর্থাৎ ব্যাখ্যার প্রয়োজন। দুনিয়ার শীর্ষধনীদের অন্যতম বিলগেটস একলক্ষ ডলার  খাওয়ার বিল দিলে তার তবিলে কোনো টান পড়েনা, কিন্তু সমপরিমাণ অর্থ যোগান দিতে গেলে আমাদের দেশের সত্তরজন মাঝারি চাকুরিজীবীর গোটা বছরের আয় এক জাগায় করতে হবে। তাহলে বিলগেটসের কাছে যা লাঠি তিনকুড়ি দশজনের কাছে তা কী বোঝা হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। ওজর-আপত্তি তুলতে দক্ষ বলিয়েদের লক্ষও থাকে লাঠির ওপর। বাকযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে নির্বাক করে দিয়ে বাগ্মীরা যেমন নিষ্প্রাণে প্রাণসঞ্চার করতে পারদর্শী তেমনি সজীবকে নির্জীব করাটাও ওদের কাছে শুধুই নস্যি।
অবস্থা বিশেষে কখন করতে হবে যোজন আর কখনই বা বিয়োজন সে ব্যাপারে তারা নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞজন। এজন্যই তৈরি হয়েছে এই বিশেষ প্রবচন- ‘কাকা আর আমি একা, চোর আর লাঠি দুজন।’
এবারে ধাঁধার আসরে ঘাপটিমেরে-থাকা লাট্‌ঠি নিয়ে কথা বলব দুচারটি। আধা পরিমাণ ধাঁধাবলা দাদারাও যে ধাঁধাটি বলে অন্যকে গাধা বানাতে গিয়ে নিজেরাই গর্দভ সেজে পায়না পালানোর পথ সেটি হল- ‘আল্লাহর কী কুদরত লাঠির ভেতর শরবত।’ একই হেঁয়ালি আমরা অন্যভাবে বলি এবং উত্তরটা ভালই জানি- ‘আল্লাহর কী মেহেরবানী লাঠির ভিতর মিঠাপানি।’ উক্ত লাঠি আমাদের চোখে আখের ছবি এঁকে দিতে সময় নেয়না যেহেতু এই ধাঁধা আপাদমস্তক সাদাসিধা। ‘খুললে ঘর বন্ধ করলে লাঠি-’ এই ধাঁধাটি ধন্দ সৃষ্টি করার জন্য মন্দ নয়। উত্তর খুঁজতে গিয়ে মাতাল হতে হতে দেখবেন এক সময় ধান্ধার লাঠিটি আপনার মাথায় প্রায় মাথাল হয়ে বসে মুখরক্ষার পাশাপাশি আপনার ঊর্ধ্বাঙ্গও রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে। যত্রতত্র ছত্রের পর ছত্র লিখে যে ছাতাকেই বোঝাচ্ছি তা এতক্ষণে ছাত্র-অছাত্র নির্বিশেষে সবারই বোধগম্য হয়েছে আশা করি।
আপাতত লাঠিকে লাটে তুলে কাঠির খুঁটিনাটি দেখে নিই। কাষ্ঠিকা মেদ হারিয়ে কাঠি আবার লাঠি রোগা হয়ে কাঠি হতে পারে।

লাঠির প্রকার-আকার যদি হয় কতক তবে কাঠির ক্ষেত্রে তা শতক। কৃষিসভ্যতার সূচনায় যখন কোনও কৃষিযন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়নি তখন মজলুম মানুষেরা জুম চাষ করে কিছু খাদ্যশস্য ফলাত আর একাজে কাঠিই ছিল তাদের সবেধন নীলমনি। কাঠির উন্নত সংস্করণ লাঙল, হাল, ট্রাক্টর হলেও ব্যবহার উপযোগিতায় কাঠি আজ অব্দি একটা ফ্যাক্টর। নিবারণ- নিয়ন্ত্রণে কলকাঠি, চাবিকাঠি। বয়নে ক্রুশকাঠি, ভোজনে জোড়াকাঠি (চপষ্টিক), খননে সিঁদকাঠি। অচেতন করতে মরণকাঠি, সচেতন করতে জীবনকাঠি, জাগাতে সোনারকাঠি, ঘুমপাড়াতে  রূপারকাঠি, ভেলকি লাগাতে জাদুকাঠি, পরিমাপে গজকাঠি, জ্বালানি হিসাবে পাঠকাঠি, খুলনা অঞ্চলে যা ফোলাকাঠি সাজতে গুঁজিকাঠি, সৌরভ বিলাতে ধূপকাঠি। এছাড়া আছে দেশলাই বা ম্যাচের কাঠি যা ফসকাঠি নামেও পরিচতি। ব্যক্তি যখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে তখন সে আড়কাঠি। আর তিনি যদি একানন্তই হাড়জিরজিরে হয় তবে সে খ্যাংড়াকাঠি। উচু শক্তজমিতে ধানের চারা রোপণের জন্য গর্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয় ভূঁইকাঠি। আরও এক ধরনের কাঠি আছে যা হুঁকোর মধ্যম অংশের নল উত্তমরূপে সাফাই করার কাজটির শুলুক সন্ধান করে বলে এটির নাম শুলুক কাঠি। প্রসঙ্গটা এখন হুঁকো থেকে ঢেঁকিমুখো করছি। এ থেকে আঁচ করা যায় কাঠি কীভাবে ঢেকির  ভেতরে ঢুকে আছে। যে শলাকা দারুণ মমতা দিয়ে ঢেকির সমতা রক্ষা করে তার নাম অক্ষশলা। স্থাননামেও কাঠির অবস্থান বেশ পরিপাটি-স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি, চূড়ামনকাঠি তার জ্বলন্ত  উদাহরণ। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন