বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫

আধিপত্যবাদী হাতিয়ার যুগে যুগে পাল্টাচ্ছে !

আধিপত্যবাদীহাতিয়ার
যুগে যুগে পাল্টাচ্ছে !

সংলাপ ॥ প্রচারমাধ্যমে আধিপত্যবাদী কলাকৌশল যে অনেক ফলপ্রসূ সেটি স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে লজ্জার ও দোষের কিছু নেই বরং চিন্তাবিদদের জন্য সেখান থেকে সত্যটা অন্বেষণ করা সহজ হয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুঁজিবাদী  মিথ্যাচার ও শোষণের ধরন যেমন পাল্টে পাল্টে অব্যাহত থেকেছে, ঠিক তেমনিভাবে পুঁজিবাদী প্রচার পদ্ধতিও পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়ে আধিপত্যবাদী প্রচার এসেছে। যদিও এই প্রচারের উদ্দেশ্য একই থেকেছে এবং আছে। একবিংশ শতকের প্রচারের পদ্ধতিটা তো আর পুরনো দিনের মতো হতে পারে না। উদ্দেশ্যর সহজ কথাটা লুকিয়ে রেখে বলার কথাটি জটিল করে উপস্থাপিত না করলে আজকের পোস্ট মডার্ন যুগের মানুষের কাছে আধিপত্যবাদী মিথ্যা প্রচারের আকর্ষণ যে থাকবে না সে কথা আজকের বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ ভাল করেই জানে। অনেক শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে পুঁজিবাদী প্রচারের এই ক্রমপরিবর্তনের ধারাটিকে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু তাতে পাঠকেরধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কা থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘মিথ্যে কথা গুছিয়ে বলাটাই’ ছিল আধিপত্যবাদী প্রচারের মূল কায়দা যার ছোঁয়ায় বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল অসুস্থ।বিংশ শতকের প্রথমার্ধের পুঁজিবাদী প্রচার পদ্ধতির প্রধান পুরোহিত ছিল গোয়েবলস। তার বক্তব্য ছিল, মিথ্যে কথা শুধু গুছিয়ে বললেই হবে না, সেটি বারে বারে বলতে হবে - বলে যেতেই হবে - বলে যেতেই হবে। গোয়েবলস এর কথা লোকে কেন যে এত বলে কে জানে! আমাদের রাজনৈতিক কথামালায় জনগণের নামে মিথ্যাকে সত্য বলে তুলে ধরার (যেমন ভারত বিদ্বেষ) বানানোর গল্পগুলো এমন কিছু খারাপ নয়। ক্রমাগত অসত্য কথা বলার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেন যে বস্তাপঁচা গোয়েবলসীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে! জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা অথচ একেবারে আবে জমজমের পানিতে ধোয়া সত্য কথার মতো শোনাবে এখন আরও কত নতুন টেকনিক বেরিয়েছে। সেগুলো এখনও জেনে নিতে না পারার দায়টা অবশ্যই আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের খামতি ও বর্তমান ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যেতেই পারে।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রচারের বিষয়টি কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিশেষজ্ঞদের হাতে চলে যায়।এই বিশেষজ্ঞদের মতে প্রচারের বিষয়টি, ওপর থেকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দিলে আর চলবে না। তাদের মতে মিথ্যা প্রচারের বিষয়টি গণ মানুষকে জড়িয়ে নিয়ে মানুষের ভেতর থেকে তুলে আনতে হবে। তাই আর প্রোপাগান্ডা বা পাবলিসিটি নয়, যা করতে হবে তার নাম মার্কেটিং। পণ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন ধ্যানধারণারও মার্কেটিং। এ সম্পর্কে হাজার কাহিনী কাছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক জুতোর কোম্পানি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ব্যাপক প্রচারও চালিয়েও যখন জুতোর ব্যবসা বাড়াতে পারছিল না তখন তারা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে একজন মার্কেটিং ম্যানেজার পাঠাল। দায়িত্ব নিয়েই মার্কেটিং ম্যানেজার প্রথমে জুতোর যত অ্যাডভার্টাইজমেন্ট আর পাবলিসিটি  মেটিরিয়াল ছিল সব বাজার থেকে তুলে নিল। তার তরফ থেকে  নির্দেশ দেয়া হল কোম্পানির জুতোর প্রচারে আর একটিও কথা নয়। পরিবর্তে তৃতীয় বিশ্বের অস্বাস্থ্যকর দেশগুলিতে মানুষের কেন সব সময় জুতো পরে থাকা উচিত, জুতো না পরলে স্বাস্থ্যের, সৌন্দর্যের কি কি  হানি হতে পারে ইত্যাদি নিয়ে সেমিনার, গ্রুপ মিটিং, ছোট-বড় জনসভা শুরু করে দিল। এর কিছুদিনের মধ্যে উক্ত কোম্পানির জুতো বিক্রির বহর আকাশছোঁয়া হয়ে গেল। তা এই হল গণমানুষকে জড়িয়ে নিয়ে মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা মিথ্যা প্রচারের মাহাত্ম্য। বাংলাদেশে সার্বিক দুর্দশা ও দুর্গতি নিরসনের ও সর্ববিধ উন্নতির জন্য ‘পরিবর্তনের’ বর্তমান ধারাটি ভারতমুখী বলে বিরোধী দলের পন্ডিত তথা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের এবং রাজনীতিকদের একটি বিশেষ ‘ধারণা’-র মার্কেটিং। এর জন্য বিভিন্ন চ্যানেলে টকশো, সেমিনার আর বহুল প্রচারিত পত্রপত্রিকার লেখালেখি কম হচ্ছে না। যাই হোক, এই প্রচার পদ্ধতিগুলোও পুরনো হয়ে যাচ্ছে বা গেছেই বলা যায়।সাধারণ মানুষ এখন এই ধরনের প্রচারে ক্লান্ত বোধ করে, বিরক্ত হয়। একবিংশ শতকে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের প্রচারে তাই নতুন পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটেছে। বহুবিধ উপাদানের মিশ্রণে প্রচারের বিষয়বস্থটিতৈরি। তবে এটি কখনও সম্পূর্ণভাবে একসঙ্গে লিখিত-পড়িত আকারে কোথাও পাওয়া যাবে না। এর বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করলেই শরীরে-মনে কেমন যেন শিহরন জাগে! প্রচারের বিষয়টির মধ্যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের সওয়াল আছে, সমাজের সকলের উন্নয়নের দাবি আছে, সামাজিক অচলায়তন ভেঙে ফেলার কথা আছে,দৈনন্দিন জীবনের চলে আসা রীতিনীতি, অনুশাসন অগ্রাহ্য করার পরামর্শ আছে, আছে ব্যাপক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, এমনকি মানব মুক্তির কথাও। ‘না পড়লে, না দেখলে পিছিয়ে পড়তে হয়’ এমন সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে এই বিষয়গুলি থেকে থেকে, কিছুদিন বাদে বাদে উপস্থাপিত করা হয়। ব্যাপক সাধারণ মানুষকে কখনও জানানো হয় যে ইচ্ছে করলেই প্রতিটি মানুষ এখন পৃথিবীর যাবতীয় খোঁজখবর জ্ঞানগম্যি উন্নততর নানাধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে জোগাড় করে সমৃদ্ধ হতে পারে, পরিচয়ের পরিধি বাড়িয়ে অন্য মানুষদের সঙ্গে, বিভিন্ন চিন্তাভাবনার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে এবং এইভাবে হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব নাগরিক (এই কথাগুলো নিয়ে অবশ্য দ্বিমতের কোনও সুযোগ নেই)। আবার একইভাবে অন্য কোনও সময় বলা হয় যে পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য প্রত্যেককে তার পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত এবং সর্বোপরি শ্রেণীগত পরিচয় গ্রাহ্য করে নিরপেক্ষএকক মানুষ হিসাবে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। একমাত্র তা হলেই রাজনীতির কলুষমুক্ত দলহীন গণতন্ত্রের নাগরিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। একইভাবে গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে আবার কখনও কোথাও ব্যবস্থাপত্র দেয়া হচ্ছে যে, কি কি খাবার খেলে, কি ধরনের পরিধেয় পরলে, কি প্রসাধনী মাখলে, কিভাবে ঘরবাড়ি সাজালে, কি ভাবে চুল-দাড়ি কাটলে, কি ধরনের গাড়িতে চড়লে নিজের আলাদা পরিচিতি ও ব্যক্তিত্ব মুসলমানের মতো প্রকাশ পাবে। কখনও জানানো হয় যে মূল্যবোধ দিয়ে কিছু হয় না।
জীবনে সবই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বিনিময়মূল্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। কখনও ফিসফিসিয়ে শোনানো হয় ব্যক্তি জীবনে নরনারীর কামনা-বাসনা যেহেতু ক্ষুধাতৃষ্ণার মতোই স্বাভাবিক সেই হেতু তাকে সারা জীবনের জন্য পবিত্রতার পূর্বশর্তে জড়িয়ে ফেলার প্রবণতা। এমন আরও অনেক বক্তব্য, উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায়। কিন' তার প্রয়োজন নেই। এখন মানুষের মস্তিষ্ক  বিভিন্ন সূত্র থেকে আহৃত, সাদৃশ্য আছে এমন বা অনুরূপ, তথ্য নিজের মতো করে সংশ্লেষ ঘটিয়ে একটা চেতনার জন্ম দেয়। আহৃত উপাদানগুলো যেখানে যে রকম, সংশ্লেষিত চেতনা সেখানে সে রকম হতে পারে সেটি সহজেই অনুমেয়। এমন চেতনায়সমৃদ্ধ হয়ে মানুষ হয়ে ওঠে নিরালম্ব, অসংবেদনশীল, উগ্র, স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর। বিশ্বায়িত আধিপত্যবাদ মুনাফা এবং একমাত্র মুনাফার স্বার্থে ঠিক এটাই চায়। একবিংশ শতকের আধিপত্যবাদী মিথ্যা প্রচার এই লক্ষ্য নিয়েই ঘোরাফেরা করে চলেছে বিশ্বজুড়ে।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত গণমাধ্যম বলতে বোঝাত সংবাদপত্র ও বিভিন্ন গোত্রের পত্রপত্রিকা (তখনও টেলিভিশন ও আনুষঙ্গিক প্রযুক্তির এত প্রসার ঘটেনি)। সে সময় পর্যন্ত বড় বড় সংবাদপত্র (ফোর্থ স্টেট হিসাবে) সাধারণ মানুষের কাছে সম্ভ্রম আদায় করতে সক্ষম হত। তখনও পর্যন্ত অনুসন্ধানী, সাংবাদিকতা, সংবাদভাষ্য ইত্যাদির আলাদা একটা মর্যাদা ছিল - সেগুলিকে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির সহায়ক বলে মনে করা হত। তার পরে হঠাৎ করেই সবকিছু পাল্টে গেল। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে বিশ্বব্যাপী  লগ্নিপুঁজির দৌরাত্ম্য শুরু হল। আর পাঁচটা দেশের মতো আমাদের দেশের বেশিরভাগ বড় বড় সংবাদপত্র ও আনুষঙ্গিক পত্রপত্রিকা স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে নির্দিষ্ট লগ্নিপুঁজির স্বার্থরক্ষায় মিথ্যাচারে নিজেদের নিয়োজিত করে ফেলল। এতদিন পর্যন্ত যেগুলি ছিল প্রচারের মাধ্যম, এ বারে সেগুলিই বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মুখপত্রের ভূমিকায় আসরে অবতীর্ণ হল। প্রচার মাধ্যমের আদর্শ ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে শুরু হল মাধ্যমের প্রচার - কিছু পরে ইলেকট্রনিক মিডিয়া  তার সঙ্গে যুক্ত হল। সেই প্রচারের তীব্রতা ও ব্যাপকতা আজ এমনি যে বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র ও চ্যানেল কোন কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচার চালাচ্ছে সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। প্রচারিত বক্তব্যের ক্ষেত্রে সত্য, অর্ধসত্য ও মিথ্যা সংবাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বিপদের কথা হল এই যে, আধিপত্যবাদী প্রচার পদ্ধতি এই কাজ করতে গিয়ে গণ-মানুষের বিশ্বাস করার স্বাভাবিক প্রবণতাটি নষ্ট করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। মানুষ আজ কী বিশ্বাস করবে আর কোনটা করবে না  তার ভিত্তিটাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। বিচার বিবেচনার জন্য ব্যাপক মানুষকে কিছু জানানোর প্রক্রিয়াটিকেই অবাস্তব করে তুলেছে। প্রচার পদ্ধতি আজ শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের সমর্থনে সহমত গড়ে তোলার একটি আধিপত্যবাদী হাতিয়ার মাত্র।

ব্যাপক সাধারণ মানুষের কাছে বর্তমান সরকারের সার্বিক বক্তব্য আজকের প্রেক্ষিতে নিয়ে যাওয়া  কতখানি দুরূহ করে তুলেছে বিরোধীদলগুলো সেটা দেখানোর উদ্দেশ্যেই প্রচার পদ্ধতির এই আলোচনা। বর্তমান সরকারের তরফে অবশ্য পাল্টা প্রচারের এই কাজটি সুসম্পন্ন করার  কোনও গত্যন্তর নেই বলে দূরদর্শী চিন্তাবিদদের অভিমত। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন