বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৫

সময়ের তাগিদঃ রাজাকারদের তালিকা

সময়ের তাগিদঃ রাজাকারদের তালিকা

সংলাপ ॥ মুক্তিযোদ্ধাদের আবারো তালিকা করছে সরকার। যার দ্বারা নির্ণীত হবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা এবং চিহ্নিত হবে কারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা! স্বাধীনতা উত্তর গত প্রায় ৪৪ বছরে ক্ষমতায় এসে বিভিন্ন সরকার এই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রস্তুতের কাজটি করে আসছে সরকারের একটি ‘রুটিন ওয়ার্ক’ হিসেবে! মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ ইতোপূর্বে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে একবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রস্তুত করেছিল। এবার আবারো একই উদ্যোগ চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করাটা কি জরুরি? অস্ত্র হাতে যারা জীবন দিয়েছিল বা লড়াই করেছিল রণাঙ্গনে, তারাই কি কেবল মুক্তিযোদ্ধা? যুদ্ধটা কি কেবল ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল?
১৯৭১ সালে ৩ মার্চ জাতীয় সংসদ আহ্বান করে তা স্থগিত ঘোষণার পর থেকে সারা বাংলাদেশে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল ধারাবাহিকভাবে, তা অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে এবং এরই পরিণতিতে সারা দেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত যারা জীবন দিয়েছিল তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নয়? নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর ভাষায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী শেখ মুজিবকে’ ভোটে জয়যুক্ত করার অপরাধে যে সাধারণ বাঙালিদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নয়?
জীবনের ঝুকি নিয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিল, খাদ্য যুগিয়ে ছিল নিজেদের জীবন বিপন্ন করে কিংবা পাক সেনাদের গতিবিধির সংবাদ পৌঁছে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, এমনকি এ অপরাধে যাদের বাড়িঘর ভষ্মিভূত হয়েছিল, জীবন দিতে হয়েছিল নিরস্ত্রভাবে, তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নয়? আসলে মুষ্ঠিমেয় রাজাকার, আলবদর, আলসামস্‌ ও শান্তি বাহিনীর সদস্য তথা স্বাধীনতা বিরোধী জামাত ইসলামি, মুসলিম লীগ নেজামী ইসলামির মতো গণবিরোধী দলগুলো ছাড়া বাকি তখনকার প্রায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালিই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। তাহলে কেন এই উদ্যোগ? এ উদ্যোগ তো কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত করে বিচ্ছিন্ন একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতেই পরিণত করে।
দেখা যায়, ’৭৫ পূর্ব আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা যেখানে যুদ্ধের পরে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিতরণ করেন ৩৩ লাখের মতো সেখানে অভিযোগ আসে এর ৩০ লাখই নাকি ছিল ভুয়া। ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্ব এ অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামানের এক লেখায়। এতে তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সোয়া দুই লক্ষের উপরে হতে পারে না বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের করা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকেও দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধার পরিসংখ্যানে চরম বিভ্রান্তি। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে লেঃ জেঃ (অব:) নুরুদ্দীন জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন দেশে যাচাইকৃত ও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ১৮ হাজার ৫ জন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে মুক্তিযোদ্ধাদের যে পরিসংখ্যান দেন তাতে দেখা যায় তার শাসন আমলেই করা নতুন তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩৬ হাজার বেড়ে গিয়ে মোট পরিমাণটি দাঁড়িয়েছিল এক লাখ ৫৪ হাজারে।
সুতরাং এবারও সরকার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করছে এবং সেই তালিকা মুক্তিযোদ্ধার পরিসংখ্যান বিভ্রান্তির দিকে যে ঠেলে দেবে তা অনুমান করাটা মোটেও অসংগত হবে কি?
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী, এবারে নির্বাচিত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নিকট দেশবাসীর এ নিয়ে ন্যায় সংগত দাবি একটাই: তা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আর নয়, রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকাতৈরি করুন। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এক্ষেত্রে ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর  দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত একটি সংবাদের উদ্ধৃতি দেয়া হলো - ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজাকারদের একটি তালিকা প্রণীত হলেও রহস্যজনক কারণে সেই তালিকা পরে ভষ্মিভূত হয়ে যায়। অনুসন্ধানে দেখা যায় ১৯৭১ সালে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৫০,০০০ রাজাকার সংগ্রহ ও তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ। ট্রাস্টের কাছে ৫০,০০০ রাজাকারের তালিকা ছিল। ট্রাস্টের-ই একজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তার নেতৃত্বে ওই তালিকাটি ভষ্মিভূত করা হয় বলে ট্রাস্টের একটি সূত্রে জানা যায়।

সুতরাং আজ অনেক অনেক বিলম্বে হলেও জরুরি হয়ে পড়েছে এলাকা ধরে ধরে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদর, আলসামস্‌ এবং তাদের সহযোগীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা। স্বাধীনতা বিরোধী এই গণ দুশমনদের বর্বরতার শিকার, আর প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী প্রজন্মটি পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আগেই এই কাজটি সম্পন্ন করা অতি জরুরি। স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নিজের এবং তার সরকারের জন্য এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন