বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৫

সময়ের সাফ কথা ....গণতন্ত্রের এপিঠ-ওপিঠ

সময়ের সাফকথা ....
গণতন্ত্রের এপিঠ-ওপিঠ

সংলাপ ॥ বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক দু’টি মাত্রাতেই এখন ইউরোপে জার্মানি আর সুইজারল্যান্ডের অবস্থান শীর্ষে। সামগ্রিকভাবে আমেরিকা এখন ইউরোপের নিচে চলে এসেছে। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এশিয়া ও আফ্রিকায়। বিশেষ করে এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়।
ইউরোপের বড় ও সমৃদ্ধ দেশ জার্মানির গণতন্ত্র বা জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারক-বাহক রাজনীতিকরা ও জনপ্রতিনিধিরা ওই দেশ থেকে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা নিজ দেশের কাজে লাগাতে পারেন।
দুঃশাসন, গণতন্ত্রের চর্চার অভাব ও উগ্র রাজনীতির শিকার বাংলাদেশের সিংহভাগ সাধারণ মানুষ। যে কোন একজন পেশাদার কর্মজীবী বা সাংবাদিক বা মুক্তমনা এই অন্ধকার দিকটির শিকার হতে পারে। অনেক যন্ত্রণা আর নিপীড়নের পর তারা বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূল তিনটি ভিত্তি। এগুলো হলো আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ আর প্রশাসন। একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল। পরস্পর পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করেই গণতন্ত্র সচল থাকে। তিন বিভাগকেই একই উদ্দেশ্যে, একই লৰ্যে কাজ করে যেতে হয়। সেটি হল, জনকল্যাণ এবং জনসেবা। একটি বিভাগ আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর এই তিনটি উপাদানকে যথাযথ ভাবে চালানোর মূল দায়িত্বটি থাকে, রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিকদের ওপর। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাজনীতিকরাই গণতন্ত্রের ধারক, বাহক ও রক্ষক।
গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণ তখনই পাবেন যখন উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতি সঠিকভাবে চলবে বা কার্যকর থাকবে। কিন্তু এই উপমহাদেশে বিশেষত: বাংলাদেশে এর একটিও যথাযথ কার্যকর আছে বলে জনগণ বুঝতে পারছেন না। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের জন্য এখনও মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। রাজনৈতিক হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ রয়েছে।
জনগণের স্বার্থ ও দেশের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখতে শেখেনি সব রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা।
জার্মান বা ইউরোপে একজন রাজনীতিক নেতা, মন্ত্রী এবং একজন সাধারণ মানুষ, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ওখানে রাজনীতিকদের মধ্যে বা সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে ক্ষমতার কোন বাহাদুরী নেই। জনগণকে ওখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। জনগণের চাওয়া-পাওয়া বা সুবিধা-অসুবিধার প্রতি রাজনীতিকদের থাকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি। বাংলাদেশে ঠিক তার উল্টো। কখনই জনগণের কোন মতামতের তোয়াক্কা করেন না শুধুমাত্র ভোটের সময় ছাড়া।
আইন প্রণেতা বা এমপিদের কাজ বাংলাদেশ, জার্মানি বা অন্যান্য দেশে সর্বত্রই মোটামুটি এক। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ নির্মাণ, জনকল্যাণ, সামাজিক কাজকর্ম, উন্নয়ন, সংস্কার, আইন প্রণয়ন এসবই এমপিদের মূলত: প্রধান কাজ। জার্মানিতে কোন আইন পাশের আগে জনগণের মতামত অপরিহার্য্য। সংসদে কোন আইন প্রণয়ন বিষয়ে আলোচনা উঠলে সাথে সাথে এমপি তার নির্বাচনী এলাকায় চলে যান। আইনটি সম্পর্কে সভা সমিতি ও দেখা সাক্ষাত করে তার ভোটারদের ব্যক্তিগত ভাবে বিস্তারিত জানান।
জনগণ যখন বলেন যে আইনটি ভাল বা মঙ্গলজনক, তখন তারা তার পক্ষে মত দেন। আর যদি মনে করেন এই আইনটি জনকল্যাণমূলক (অন্তত: তাদের এলাকার জন্য) নয় তাহলে তারা বিপরীতে মতামত জানান। জনগণ না চাইলে একজন এমপি তার পার্টির সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও দাঁড়িয়ে যান।
পার্লামেন্টে তিনি তার এলাকার ভোটারদের দাবির কথা মনে রেখে নিজের দলের বিরুদ্ধে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ভোটদান করেন বা নিরপেক্ষ থাকেন। এটাই পাশ্চাত্যের রাজনীতির সংস্কৃতি। এর জন্য দলীয়ভাবে তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয় না। তার দায়বদ্ধতা আগে জনগণের কাছে, পরে আসে তার রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে আদর্শিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি কবে গড়ে উঠবে তা নিয়ে চিন্তাবিদদের ভাবনার শেষ নেই। জার্মান পার্লামেন্টে বিভিন্ন কমিশন আছে। এই ধরনের কমিশন বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই আছে। জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কমিশন হলো সংসদ সদস্যদের আর্থিক বিষয়াদি যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত, দেশরক্ষা এবং গোয়েন্দা বিভাগ। ওইসব কমিশনের প্রধান বা সভাপতি নির্বাচন করা হয় বিরোধী দল থেকে। ফলে সরকারি দলের নয় ছয় করার কোন সুযোগ নেই। অবশ্য ওখানে কেউ নয় ছয় করেনও না। বাংলাদেশে এমনটা লক্ষ্য করা যায় না। বাংলাদেশে বিরোধী দলের সংসদ সদস্য কোন কমিশনের প্রধান হলেও দুর্নীতি বা অনিয়মের বেলায় শুধুমাত্র একজন অপরজনের গা চাটছে। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ এবং জনকল্যাণ ও নীতি, এ দুটি বিষয়ের মধ্যে রাজনীতিকরা কখনই পার্থক্য করতে পারছেন না। জার্মানে একজন দাগী অপরাধীকে আপনি করে বলা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভদ্রভাবে ও শান্ত মসিৱষ্কে প্রশ্ন করা হয়। ডিটেনশনকালে তার ব্যক্তিগত চাহিদাগুলোও যথাসম্ভব মিটানো হয়। নির্যাতনের তো প্রশ্নই উঠে না। বাংলাদেশে এই চিত্রটি দুঃসহ এবং ভয়াবহ। এটা বাঙালি মাত্রেই ভালভাবে জানেন। জার্মানির জনপ্রতিনিধিরা মানবাধিকার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন এবং জ্ঞান রাখেন। এ বিষয়ে তাদের আছে অনেক পড়াশোনাও। বাংলাদেশের ক’জন জনপ্রতিনিধির মানবাধিকার জানা আছে তা বলা মুশ্‌কিল। আবার মানবাধিকার জানা থাকলেও ক’জনই বা তার বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন? এর জবাব জনগণ জানেন।
সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন সর্বত্রই বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের জন্য আছে এক অসহনীয় অবস্থা। অথচ মন্ত্রি, কূটনৈতিক বা এমপি পাড়ায় কিন্তু বিদ্যুৎ থাকছে ২৪ ঘণ্টাই। ইউরোপ বা জার্মানিতে এমনটা ভাবাও যায় না। ওখানে কোনবৈষম্য লক্ষ্য করা যায় না। একজন এমপি আর একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে কেন পার্থক্য থাকবে? মন্ত্রীরাই বা জনগণ থেকে স্বতন্ত্র থাকবেন কেন? ওখানকার মন্ত্রীরা অনেকেই সাধারণ আবাসিক এলাকায় বাড়ি নিয়ে থাকেন। গেট পার হবার সময় ভেতরে দু’একজন সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বিভাগের লোক দেখা যায়। আর আমাদের দেশে একটি মন্ত্রীভবনকে পাঁচশ/হাজার গজ দূর থেকেই নানা বাধা নিষেধের বেড়াজালে জনগণ থেকে আলাদা করে রাখা হয়।

সপ্তাহান্তে বেশিরভাগ মন্ত্রী নিয়মিত তাদের (প্রদেশের) রাজধানীর প্রাদেশিক মন্ত্রীভবন থেকে নিজস্ব শহরে তাদের নিজস্ব বাড়িতে যান সপরিবারে। মূল উদ্দেশ্য, ভোটারদের সাথে নিয়মিত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখা। মন্ত্রীরা প্রায়ই একাই যান। দেহরৰী সাথে নিয়ে কখনো কখনো তাদের শহরে কোথাও যান। মাঝে মাঝে সাথে তাদের স্ত্রী বা সন্তান থাকে। এলাকার কোন লোকের অসুখের কথা শুনলে এক ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রী মহোদয় ফুলের তোড়া নিয়ে সপরিবারে হন হাজির। দ্রুত আরোগ্য - কামনাটি ব্যক্তিগতভাবে জানানোর জন্য। বাংলাদেশে মন্ত্রী তো আকাশের চাঁদ, দেখা যায়, ধরা যায় না! বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে জনগণই হলো দেশের মালিক। আবার বলা হয়, জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস। তাহলে জনগণ কেন এত দুর্ভোগ, কষ্ট পেয়ে জীবন যাপন করছেন। এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? গণমানুষের জানা নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন