বৈশাখ তুমি নেমে এসো মাঠে
সংলাপ
॥ নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে একটা মধ্যপন্থায় আমরা আছি, আমরা ছিলাম এবং আরো বহুদিন হয়তো আমরা
থাকবো। ধারাবাহিকতায় আমাদের জন্ম বাংলার মাটিতে, আমরা কথা বলি বাংলায়, নামাজ পড়ি আরবীতে
আর পোশাকে ইংরেজ সাহেব, নয়তো আরাবিয়ান। একি অসঙ্গতি না কি বৈচিত্র্যতা? জবাব দেবে ভবিষ্যৎ।
যে কোন জাতিসত্তারই একটা শিকড় আছে। অতীতের গৌরব গাঁথা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই নির্মাণ
করতে হয় ভবিষ্যৎ। কিন' আমাদেরটা দ্বিমুখী। একদিকে আমরা অতীত তুলে ধরার নামে শিকড়ের
সন্ধান করার নামে আদিতে ফিরে যাওয়ার নামে ক্রমশ আদিম হয়ে যাচ্ছি। স্মরণ রাখতেই হবে
যে নিশ্চয়ই আদিম হয়ে যাওয়া সভ্যতার দাবি হতে পারে না। অন্য একটি অংশ অতীত বিচ্ছিন্ন
এক পরগাছা মানসিক কাঠামো থেকে উগ্র আধুনিকতার নামে ভিন্নরূপের আদিমতার চর্চা করছি।
এই দুটোই অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে বর্বরতা। বাঙালি ললনাদের তাই বোরখাধারা এবং স্লীভলেস
ব্লাউজধারা দুই’ই পরিত্যাজ্য।
গ্রাম
বাংলার মাটির ঘরের মধ্যে বা টিনের মধ্যে, কাঁথার মধ্যে নানাবিধ নকশী অংকিত অবস্থা আজো
দৃশ্যমান। আমাদের ওই নকশী থেকে আমাদের শিল্প কর্মের আঙ্গিক তৈরি করতে হবে এটা ঠিক কিন্তু
ওই নকশী সম্বলিত জীবন চর্চায় লীন হওয়া যাবে না। আবার যারা ওই নকশী এবং স্থাপত্য কলার
দিকে মনোযোগ না দিয়ে পাশ্চাত্য থেকে ধার করা স্থাপত্য কলায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও
আশপাশের ভবন নির্মাণ করলেন তাদের ফলটা দেখা গেল বর্ষায় বৃষ্টির তোড় তাদের স্থাপত্যকে
এফোড় ওফোড় করে দিল। ওরাও ছিন্নমূল। পাশ্চাত্যের ধার করা সংস্কৃতি ও স্থাপত্যকলায় বহুদূর
যাওয়া যাবে না।
বাংলা
সঙ্গীতের কথা যদি বলা যায় তবে আমরা দেখবো পুঁথি থেকে ভাটিয়ালী পর্যন্ত আমাদের সঙ্গীতের
যে ধারা যে ধারার ভিত্তিভূমি রচনা করেছে এবং লালন করে চলেছে তাকে বারে বারে ধ্বংস করার
জন্য হায়েনার ছোবল এসেছে। প্রাক স্বাধীনতা সময়ে ওই ধারার মধ্যে হাম্দ এবং নাত্ চাপিয়ে
দেয়া হলো; কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং ধারাটির সাবলীল বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার গত
কয়েক যুগ যাবৎ আধুনিকতা এবং গণসঙ্গীতের নামে ওই ধারার মধ্যে ভাবলেশহীন কিছু বক্তব্য
চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারা মনে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে যে সঙ্গীত
শুধু কতকগুলো প্রচারপত্রের মত কথা নয়। তার মধ্যে আছে প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্রের গভীরতম
অখন্ড ভাব। সেই ভাবের ভেদ বোঝারও চেষ্টা করেনি তথাকথিত উগ্র আধুনিকতা বন্দিরা। ফল যা
হবার তাই হয়েছে। নদী যখন আপন স্বচ্ছন্দ গতি হারায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তখন তা নানা বাঁকা
পথ অবলম্বন করে এগিয়ে যায়। সংস্কৃতি হলো স্রোতস্বিনী। একে চাপাতে গেলে আটকাতে গেলে
নিজের সত্ত্বা হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে। সে ভুলের খেসারত আজ আমাদের দিতে হচ্ছে। আমাদের
যুবসমাজকে দিতে হচ্ছে। আমাদের নেতৃত্ব মরমী লালন জালালদের নিয়ে চিন্তা চর্চা না করে
হাই সাহেবদের দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনার চেষ্টা করেছিলেন বলেই এখানে হাম্দ কিংবা
নাত্ কিংবা তাদের ডিজাইনের অন্যকিছু বিকাশ লাভ না করে আমাদের যুব সমাজ চলে গিয়েছে
পপ্ নামক সঙ্গীতে।
সমস্ত
দেশ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই আমরা আমাদের ঘরানার অমূল্য সম্পদ ত্যাগ করে তথাকথিত
পপ্ কালচারে ঢুকে গেলাম। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার পরও আমাদের নেতৃত্ব
নিজেদের নিয়ে এতো বেশি ব্যস্ত থাকলো যে আমাদের সঙ্গীতের যারা দিকপাল মানুষ তাদের চেতনা,
তাদের লোকজ দৃষ্টিভঙ্গি এগুলোকে তুলে ধরা দরকার বোধ করলো না। আমরা শ্লোগান দিলাম এক নেতার এক দেশ বঙ্গবন্ধুর
বাংলাদেশ। ওই এক নেতা যে শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হানদেরও যোগফল, আবার তারা যে কাজী
নজরুল ইসলাম থেকে গোবিন্দদাস পর্যন্ত সকলের যোগফল তা কিন্তু কোন আলোচনায় আচার অনুষ্ঠানে
এলো না। দেখা গেল নজরুল যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন গান লিখে উঠতে পারেননি তাই তার
সঙ্গীতের কদর না পেয়ে কদর পেল প্রচারপত্র ধর্মী কতক সঙ্গীত।
লোবান-আতরের
গন্ধ বিশিষ্ট পোশাক পরিহিত লোকেরা শিল্পকলার ইজারা নিয়ে নিল। তারা একবারও কুষ্টিয়ার
ছেউড়িয়াতে সাঁইজীর স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন কিনা সন্দেহ। আব্বাস আলী থেকে আঃ আলিম পর্যন্ত
যে ধারা তা বিকশিত না হয়ে সঙ্গীত কতকগুলো লাগামহীন মধ্যবিত্ত তরুণের বিষয়বস্তুতে পরিণত
হয়। তারা কালক্রমে তথাকথিত পপ্ সঙ্গীতের বিকাশ ঘটাতে ঘটাতে পুরো পাশ্চাত্য ঢং এর এ্যাবা,
বনিয়াম কিংবা মাইকেল জ্যাকসন সংস্কৃতির চর্চার লীলাভূমিতে পরিণত করছে দেশকে। এখন যে
ডিস সংস্কৃতি, এখন যে মেট্রোপলিটান সংস্কৃতি তার সারকথা হলো পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে
যাও। ফ্রিজ থেকে বার করা পান্তা ভাত খাও। কাঁচা মরিচ না থাকলে প্রাইভেট কারের ড্রাইভার
পাঠিয়ে আমিন বাজার থেকে ২০০ টাকার অকটেন পুড়িয়ে দুই টাকার কাঁচা মরিচ নিয়ে এসো। ব্যাস
পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে গেলাম। পরদিন থেকে সবকিছু পাশ্চাত্যের আদলে করবো, কনসার্ট করবো
সব ঠিক থাকবে তবুও বাঙালি হবো। এ এক নিরবিচ্ছিন্ন বেহায়াপনা। এ পসরা সাজানোর কি দরকার।
বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের জন্য তাই ছায়ানটের মত মধ্যবিত্ত বেহায়াপনার বৃত্ত থেকে বের
হয়ে গ্রামের কৃষকের মধ্যে সঙ্গীত খুঁজতে হবে। ধান লাগানো বা ধান কাঁটার সময় তারা যে
বদুর গান জারি গান করে তার মধ্যে থেকে বাঙালির সঙ্গীতের আঙ্গিক তৈরি হতে হবে।
কলকাতার
বাবুদের মত ঢাকায় একটা বাবু ক্লাসের তৈরি কালচার কনসার্ট সংস্কৃতি থেকে দেশ বাঁচতে
পারবে না। নাটক মহিলা সমিতি থেকে রাস্তায় নামাতে হবে যা কিনা ইতিমধ্যে কিছুটা নেমেছে।
অনুরূপ বর্ষবরণকে বটমূল থেকে বস্তিতে যেতে হবে, গ্রামে যেতে হবে। নদীর মাঝির জীবনের
সুর থেকে সঙ্গীত খুঁজে পেতে হবে। এটাই হোক বাংলা নববর্ষের প্রত্যাশা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন