শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৫

১৪২২: উৎস সন্ধানে

১৪২২: উৎস সন্ধানে

সংলাপ ॥ ‘বিপুলা এ পৃথিবী’। অন্তহীন কালের প্রবাহ অসীমকে সীমার মাঝে, অস্পৃশ্যকে স্পর্শের ভিতরে মানুষই টেনে আনে তার নিজের তাগিদে। আর এই তাগিদ ক্রমশ একদিন আবেগকে আশ্রয় করে, হয়ে ওঠে তার চেতনার প্রতীক। তার সত্তাভূত। এ কারণেই সে সীমানা টেনে খাটো করে নিয়েছে ব্যক্তিমাপে; কাল্‌কে আয়ত্তে এনেছে কাল্‌ পরিমাণে। এই কাল্‌ পরিমাপের ক্ষেত্রেও সে এড়িয়ে যেতে পারেনি তার জাতীয়তাবোধ। পারা যায় না। কাল্‌ সাক্ষী। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকেই কাল্‌ পরিমাপের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ষ গণনার প্রচলন ঘটেছে বিভিন্ন রূপে। মূলত এ পর্যন্ত তিনটি রীতি অনুসরণ করেই বর্ষ গণনা হয়েছে। যথা - (১) সৌর বর্ষ (২) চন্দ্র বর্ষ ও (৩) নাক্ষত্র বর্ষ।
সৌর বর্ষ নির্নীত হয়েছে সূর্যের বার্ষিক গতি অনুসারে। এক সৌর বর্ষ সমান ৩৬৫ দিন। চন্দ্রের গতি অনুসারে চন্দ্র বর্ষ গণনা করা হয়। এক চন্দ্র বর্ষ ধরা হয় চন্দ্রের সংক্রমণ প্রাতঃকালে হলে ৩৫৪ দিনে এবং রাত্রিকালে সংক্রমণ হলে ৩৫৫ দিনে। নাক্ষত্র বর্ষ গণনা করা হয় নক্ষত্র অনুসারে। ৩৬০ নক্ষত্র দিনে এক নাক্ষত্র বর্ষ। আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অব্দ প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে কয়েকটির প্রচলন এখনো অব্যাহত থাকলেও কোন কোন অব্দ হারিয়ে গেছে কালের অতলে। আমাদের দেশে প্রচলিত অব্দের মধ্যে খ্রীষ্টাব্দ, হিজরী অব্দ, শকাব্দ, বঙ্গাব্দ উল্লেখযোগ্য। খ্রিষ্টাব্দ সৌর বর্ষ। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের তিন বছর পর থেকে খ্রীষ্টাব্দ গণনা করা হয়। খ্রিষ্টাব্দ একটি আন্তর্জাতিক অব্দ। হিজরী অব্দ চন্দ্র বর্ষ অনুসারে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাস (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে এই অব্দ গণনা করা হয়। হযরত ওমর (রাঃ) হিজরী সন প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশে মুসলিম বিজয়ের পর হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয়। শকাব্দ প্রচলন কে করেন সে সম্পর্কে কোন সি'র সিদ্ধান্ত নেই। অনেকের মতে শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর পর থেকে শকাব্দের সূচনা হয়। বঙ্গাব্দ গণনা করা হয় সৌর বর্ষ অনুসারে। সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তখন ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সন প্রচলিত ছিল। যার অধিকাংশ ছিল চন্দ্র বর্ষ অনুসারে। শাহী লেনদেন এবং প্রজা সাধারণের সুবিধার্থ তিনি সৌর সন প্রবর্তনের প্রয়োজনেই এই নতুন অব্দের ফরমান জারি করেন। মোগল সমাজের আর্যাবর্তে ও দাক্ষিণাত্যে নতুন সনটি ‘ফসলী সন’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে এটি বঙ্গাব্দ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। বঙ্গাব্দ বা ফসলী সনের মূল ভিত্তি হিজরী সাল। সম্রাট আকবরের সিংহাসনের আরোহণের বছর ৯৬৩ হিজরী থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। হিজরী ৯৬৩ সনই বঙ্গাব্দের ৯৬৩ সন বলে নির্দেশিত হয়। মজার ব্যাপার বাংলা সনের শুরুতে ১ বৈশাখ, ১ বঙ্গাব্দ বলে কোন বছর ছিল না। এর মূল পরিকল্পনায় ছিলেন সম্রাট আকবরের অন্যতম পরামর্শক ও সভা জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ পন্ডিত আমির ফতে উল্লাহ সিরাজী। বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের সময় ও প্রবর্তক নিয়ে মতভেদান্তরে পাই বাংলার প্রথম স্বাধীন নরপতি শশাঙ্ক (৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ-৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দ), আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্‌ (১৪৯৩-  ১৫১৯) ; বল্লাল সেনকে। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের অভাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
বঙ্গাব্দ বা ফসলী সন প্রবর্তনের সাথে সাথে তৎকালে প্রচলিত স্থানীয় চন্দ্র মাস গুলোকেও সৌর মাসে পরিণত করা হয়। ফলে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি নামও বঙ্গাব্দের বিভিন্ন মাসের নামরূপে গৃহীত হয়। এই উপমহাদেশের অন্যান্য অনেক সনে আজ পর্যন্ত এ সকল মাসের নাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাসের এই নামগুলোর নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রের নামে। নক্ষত্র - বিশাখা>বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠা>জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া>আষাঢ়, শ্রবণা>শ্রাবণ, চিত্রা-চৈত্র প্রভৃতি। এক সময় অগ্রহায়ণ {অগ্র+হায়ন (বৎসর)} ছিল বছর শুরুর মাস।
সঙ্গত কারণেই অতীত ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করা এবং ভবিষ্যতের জন্য তারিখ গননার উপলক্ষে দিনের নাম দেওয়ার বাস্তব উদ্দেশ্যে সময়ের হিসেব রাখার পদ্ধতি, বিষ্ণুব ও অয়নসহ বিভিন্ন ঋতুর মধ্য দিয়ে সূর্যের কালচক্র এবং চন্দ্রকলার হ্রাস বৃদ্ধির পৌনঃপুনিক ঘটনা প্রভৃতি সাধারণ ও সহজে লক্ষণীয় প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর ভিত্তিতে প্রস'ত হলো পঞ্জিকা। বর্তমানে পশ্চিমা খ্রীষ্টান জগতে পঞ্জিকা রচনার যে পদ্ধতি, তা মিসরীয়দের কাছে থেকে পাওয়া। জুলিয়াস সিজার যখন পনটিফেক্‌স্‌ ম্যাকসিমসি হন তখন পঞ্জিকা এতোই অবনত হয় যে, জানুয়ারি পড়ে শরৎকালে। এ অবস্থায় রোমানদের জন্য মিসরীয় পঞ্জিকা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। জুলিয়ান বৎসর (৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা) সৌর বৎসরের চাইতে কিছু বেশি দীর্ঘ হওয়ায় পোপ ১৩ গ্রেগরি এর সংশোধন করেন এবং বর্তমানে এটিই চালু রয়েছে। ইহুদিদের পঞ্জিকা চন্দ্র ও সৌর বৎসরের সামঞ্জস্য করে রচিত। মুসলিম পঞ্জিকাই একমাত্র বিশুদ্ধ চান্দ্র পঞ্জিকা। এর বৎসর ৩৫৪ থেকে ৩৫৫ দিনে হয়। এই জন্য ঋতু ও মাসের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। প্রায় ৩৩টি মুসলিম বৎসরের সমান ৩২টি গ্রেগরিয়ান বৎসর। অন্যান্য পঞ্জিকার মধ্যে ফরাসী বিপ্লবের পঞ্জিকাই সমধিক প্রসিদ্ধ।
বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের পঞ্জিকা সৌরবর্ষ অনুসারে গননা করে প্রতি বর্ষের জন্য আলাদাভাবে নির্নীত হয়। ইংরেজি সনের গননা পদ্ধতির মত প্রচলিত বাংলা সনের প্রতি মাসের দিন সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য কোন নির্ধারিত নিয়ম-পদ্ধতি নেই, অর্থাৎ বাংলা মাসের দিন সংখ্যা কোনো মাসের জন্যই সকল বর্ষের জন্য সাধারণত একই রূপ হয় না। এই অসুবিধা দূর করবার জন্য বাংলা একাডেমীর একটি উপসংঘ সহজ পদ্ধতিতে বাংলা সনের বিভিন্ন মাসের দিন সংখ্যা নির্ধারণের নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো পেশ করেনঃ
(১) মোগল আমলে বাদশাহ আকবরের সময়ে হিজরী সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে যে বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয় (যা আজও প্রচলিত) তা থেকেই বৎসর গননা করা হবে (বাংলা সনের সাথে ৫৯৩ বা ৫৯৪ যোগ দিলেই ইংরেজি সন পাওয়া যায়।
(২) ইংরেজি মাস ২৮, ৩০ কিংবা ৩১ দিনে হয় ; কিন্তু উপসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা মাস গননার সুবিধার জন্য বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এই পাঁচ মাসের প্রতি মাস ৩১ দিন হিসেবে এবং আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র - এই বাকি সাত মাসের প্রতি মাস ৩০ দিন হিসেবে গননা করা হবে।
(৩) অতিবর্ষে চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। ৪ দ্বারা যে সাল বিভাজ্য তা’ই অতিবর্ষ বলে পরিগণিত হবে। এই সুপারিশ অনুযায়ী বাংলা একাডেমী জনসাধারণের বিবেচনা ও মতামতের জন্য ১৩৭৩ সাল থেকে বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে চলেছে।

নতুন বর্ষের নতুন পঞ্জিকা নতুন সাজে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে বারে বারে ঘুরে ঘুরে কড়া নাড়ে প্রতিটি দরজায়। ১৪২১ পেরিয়ে ১৪২২ এলো জাতীয় জীবনের নব নির্মণের পরিণত ইঙ্গিত নিয়ে। বিগত দিনের অর্জিত ব্যর্থতার গ্লানি ভোলাতে ১৪২২ সময়ের হিসেবে সময়ের বিকাশে পা রাখলো গুচ্ছ গুচ্ছ নাক্ষত্রিক সুষমায়। খেরো খাতায় উৎসবের ঢেউ তুলে। এই ১৪২২ কি শুধু কাগুজে সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেয়েই স্তুতি গাইবে মানুষের তথা জাতির? আপামর জনসাধারণের সচেতন শৈল্পিকতায় সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ার প্রয়াসে একটি রক্ত-পুজহীন ঝকঝকে, বর্ষ উপহার দিতে পারে না ইতিহাসের পাতায়? উদ্দীপ্ত করতে পারে না প্রজন্মের অগ্রযাত্রায় স্বচ্ছ বোধে? 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন