শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৫

সাধের বাঙালি

সাধের বাঙালি

সংলাপ ॥ স্বাধীন দেশে বাস করে যেমন আমরা বলতে পারি না ‘আমরা মুক্ত’, তেমনি বাংলাদেশে বাসও করে সগর্বে বলতে পারি না ‘আমরা বাঙালি’।
সময় বড় নির্মম। গতিতেই করে তোলে জীবনময়। আসা-যাওয়ার মাঝে কোন নিষ্ঠুরতাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না তার। চলার ধর্মেই আরো একটা বছর চলে গেল বাংলাদেশের জীবন থেকে। সংখ্যায় আরো ‘এক’ যুক্ত হয়ে বাংলা সন হলো ১৪২২। নতুন বছর। নতুন বছরের কাছে আমরা নিবেদন করি। আবেদন জানাই। আবেদনে নিবেদনে আশার তরঙ্গে আমাদের নিত্য সাঁতার। ১৪২১ চলে গেছে যেভাবে যাওয়ার। আমাদের স্মৃতিতে এ সালের হিসাবে কিছু গরমিল থাকতেই পারে প্রত্যেকেরই। থাকবেই। এ নিয়ম লঙ্ঘনের নয়। আশা থাকলে আশাহত হতে হবে। কর্মেও হতে পারে ভুল। ভুল তো কর্মীর জীবনে উত্তরণের সিঁড়ি।প্রগতিতে ১৪২১ বাঙালি হতে পেরেছিল কি? হতে কি পারবে ১৪২২-তে ? বাঙালির ঘরে জন্ম বলেই বাংলা নববর্ষ এলেই আমাদের উৎসব মুখরতা তীব্র হয়ে ওঠে। উৎসবের উদ্দামতায় নিজের চেতনায় কতটা বাঙালি হতে পারলাম - এই চিন্তার স্থান দিই ক’জনা আমাদের মস্তিষ্কে? বাঙালির ঘরে জন্মালেই বাঙালি হওয়া যায় না। নিজেকে বাঙালি রূপে গড়ে তুলতে হয়। বাঙালি জাতীয়তাবোধ নিজের ভিতরে জাগ্রত রাখতে হবে সর্বক্ষণ। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ থাকতে হবে। স্বদেশ ও স্বভাষার প্রতি মমত্ববোধ অটুট থাকতে হবে। তবেই নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করবার অধিকার জন্মে। কার্যত আমরা কি তা পারছি ?
বলতে দ্বিধা নেই, প্রবাসী জীবন যাপন যারা করেন তাদের অনেকেই নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেন। তারা ভাবেন বাঙালি পরিচয় দিলেই তিনি চিহ্নিত হবেন একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একজন হিসেবে। ভিখিরী, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিগ্রস্ত জাত হিসেবে। যত দ্রুত সম্ভব তারা সম্পর্ক ছেদ করেন স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বভাষার সাথে। কেন এই সংকীর্ণতা? কোনভাবেই কি তারা লুকাতে পারবে তাদের বাঙালি আকৃতি ও প্রকৃতি? পোশাক-পরিচ্ছেদ, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, উৎসবে-আয়োজনে যতই তারা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করুক না কেন, সে কোনদিনই পাশ্চাত্যের একজন হতে পারবে না। এ দেশে বসবাস করেও অনেকে একই ভাবধারা পোষণ করেন। কথায় কথায় তারা অবজ্ঞার সুরে প্রায় বলে থাকেন - ‘দেখতে হবে না, এতো বাঙালি জাত’। অথবা ‘বাঙালিরে হাইকোর্ট দেখান’ অথবা ‘এই দেশে কি মানুষ থাকে?’ বাঙালি হয়ে জন্মানোটাই যেন তাদের কাছে আজন্মের পাপ বলে মনে হয়। অজ্ঞাতে ছুঁড়ে দেয়া থুথু তারপর তারা যে নিজেরাই নিজেদের মুখে লেপ্টে দিচ্ছে এই বোধ কি কোন কালেই জাগবে না?
চেতনার ঘরে যতই তালা মারা থাকুক না কেন, তারা কিন' ঠিকই বিচরণ করছে ধর্মান্ধতা, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি নিয়ে পর্দার অন্তরালে অন্ধকার রাজত্বে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের  হাতে বেজে উঠছে বিভেদের ঘন্টা ধ্বনি। অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যে অথবা স্বার্থবাদী ধর্মের কলে অথবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বাঙালি বিরোধে জড়ায় বাঙালির সাথে। জাতীয়তাবোধে ফাটল ধরলে মানবিকতা সেখানে অনুপসি'ত থাকবেই। ভৌগলিকভাবে স্বাধীন দেশে বাস করে যেমন আমরা বলতে পারি না ‘আমরা মুক্ত’, তেমনি বাংলাদেশে বাসও করে সগর্বে বলতে পারি না ‘আমরা বাঙালি’। ‘আমরা বাঙালি’ না ‘আমরা বাংলাদেশী’-এই রাজনৈতিক বিতর্কে আমাদের বাঙালি জাতিকে জড়িয়ে ফেলেছে বাংলাদেশীর প্রবক্তরা পড়শী রাষ্ট্রের ধমক খেয়ে। কারণ দিল্লীরও ভয় ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকলে পশ্চিমবঙ্গকে হারাতে হতে পারে।  উত্তপ্ত রাজনীতির কেন্দ্রীয় লক্ষ্য যেহেতু ক্ষমতা দখল, সেহেতু দেশপ্রেমের প্রশ্নটা এখানে অবান্তর। ক্ষমতার গর্ত থেকে চোখ তুলে ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা সময় পায় না জাতির বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকাবার। কর্তা ব্যক্তির পদলেহনে এরা ব্যস্ত। ক্ষমতা-অর্থ-সম্পত্তি-প্রতিপত্তির পূজা-অর্চনা করতে গিয়ে এরা কখনো সচেতনভাবে কখনো অচেতনভাবে উপেক্ষা করে নিজের ভেতরকার জাতিসত্তাকে, নিজের অস্তিত্বকে, নিজের ধর্মকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের স্বীকৃতি পেতেও তাই আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। কিন' বাংলা সনের সরকারী ব্যবহার এখনো সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সরকারী মসনদে যারা এসেছেন এবং যারা আছেন, তারা কি বাঙালি নন? কোন্‌ কারণে তবে সরকারিভাবে সর্বত্র বাংলা সনের ব্যবহার এতো উপেক্ষিত?

প্রতি বছরই ১লা বৈশাখকে বরণ করে নিচ্ছি বাহারী উৎসবে। এই একদিনে আমরা আপাদমস্তক বাঙালি সাজবার দুর্নিবার সাধনায় মত্ত হয়ে উঠি। পোশাকে, খাবারে, গানে, বক্তৃতায় তথা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আমরা এদিন পুরোদস্তুর বাঙালি। ১ বৈশাখ এলেই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, গ্রামে-গঞ্জে বর্ষবরণ উৎসব জমে ওঠে। বৈশাখী মেলায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলার গ্রাম ও শহরগুলো। সামর্থ বিশেষে সকলেই অন্তরে লুকায়িত বাঙালিত্বে আলোড়িত হয়। কিন্তু দিন ফুরোলেই আবার ফিরে যায় পুরাতন বৃত্তে। এই যে পহেলা বৈশাখে ‘বাঙালি’ সাজবার হুলস্থুল কান্ড। একবার সাজ গ্রহণ আবার খুলে ফেলা। এ যেন সাধ করে বাঙালি সাজা। সাধের এই সাজ মানেই কৃত্রিমতা। ‘আসল’ বা ‘মৌলিক’ তথা ‘মূলসত্তা’কে আড়াল করে দিয়ে যে ‘সাজ-সজ্জা’ সে তো আরো ভয়ংকর। ‘সাজসজ্জা অজান্তে জাগায় অহংকার। ওই অহংকার তখন কারণ হয় ধ্বংসের। একজন বাঙালি হয়ে কীভাবে নিজ জাতির ধ্বংস কামনা করতে পারি আমরা? নতুন বর্ষে কোনো নতুন বৈশাখী ঝড় আমাদের চেতনার ভিতর কেন জাতীয়তাবোধকে জাগাতে পারছে না? কি লাভ শুধু একদিনে বর্ষবরণের উৎসবে মেতে থাকা? কি লাভ একদিনের কৃত্রিম বাঙালি সেজে? শিক্ষিত সমাজের কি ভেবে দেখার সময় এখনো হয়নি? তবুও শেষে বলতে হয় ‘মন্দের ভালো’। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন