অজ্ঞতাই সকল ভুলের মূল
সংলাপ ॥ অজ্ঞতার
জন্য ধর্ম নিয়ে তর্কের শেষ নেই। ভুল বুঝাবুঝির শেষ নেই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক
সকল ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব অপরিসীম। ধর্ম মানুষের জীবন চলার পথে এক প্রক্রিয়ার নাম।
ধর্মে বিশ্বাস যেমন খুব গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ধর্মচর্চা ও চর্যা করেনা এমন মানুষের জন্যেও
ধর্ম সমানভাবে গুরুত্ব বহন করে। ধর্মে বিশ্বাসী এবং ধর্মচর্চায় একনিষ্ঠ মানুষ অন্য
মানুষের শুভ কামনা করে, অন্যের প্রতি ভদ্র আচরণ করে এবং নিজে সবদিক থেকে পবিত্র থাকে।
রাজনৈতিক ধর্ম ও উগ্রবাদিতা অন্য মানুষের ক্ষতি করে এবং নিজেকে অপবিত্র রাখে। ওই ধর্মাবলম্বীরা
মানুষকে ভালোবাসে না এবং অন্য মানুষের ক্ষতি করে।
পৃথিবীতে ভাল-মন্দের
বিচার করা কঠিন নয়। এক দেশের আইনে মন্দ বলে যা বলা আছে, তা অন্য দেশের আইনেও মন্দ বলা
হয়েছে। মানুষকে হত্যা করা কোন দেশেই ভাল কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়নি। যা ভাল তা সকল দেশেই
ভাল আর যা মন্দ তা সকল দেশেই মন্দ। ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে ক্রমশ হ্রাস
পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের দেশগুলোতে ধর্মে বিশ্বাসী
মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এসব দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একসময় ধর্মের যে বিশেষ
ভূমিকা ছিল তা আজ আর নেই এখন আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোটি কোটি মানুষ আজ
এসব দেশে প্রকাশ্যে ধর্মের উগ্রবাদী ভূমিকাকে ঘৃণা করে। এসব মানুষ ধর্মের উগ্রবাদিতার
বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করছে এবং প্রকাশ্যে তা ঘোষণা করছে। এদের সংখ্যাই বর্তমানে
উন্নত দেশগুলোতে বেশি।
উন্নত দেশগুলোর
বেশিরভাগ মানুষকেই সমাজে পাওয়া যায় পরোপকারী মানুষ হিসেবে। আইন মান্য করা, সত্য বলা,
মানুষের ক্ষতি না করা, মানুষ ও জীবকে ভালবাসা, মানবতার এই গুণাবলী উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ
মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। ধর্মের বাঁধনে বা শাসনে নয় বরং সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেই নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে এসব দেশের মানুষ কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ ও প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বন্ধু
হিসাবে এই মানুষগুলো সামাজিক বিচারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দাবি করার উপযোগিতা লাভ করেছে।
মানুষ ও জীবের সেবা করে এরা ধর্মের মূল কাজটিই সম্পাদন করছে উগ্রবাদী ধর্মকে অস্বীকার
করেও। আফ্রিকা, এশিয়া, এবং মধ্যপ্রাচ্যে অনুন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে উগ্রবাদী ধর্মের প্রভাব অনেক বেশি। রাষ্ট্র, সমাজ,
পরিবার, এবং ব্যক্তিগত জীবন এখানে পরিচালিত হয় ধর্মীয় মূল্যবোধ ছেড়ে ধর্মের বিধানের
অনুকরণে। বেশ কয়েকটি দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় সকল কাজে ইসলাম
ধর্মের নামে গোত্রীয় বাদশাহী ধর্ম সমাজ
ও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা রাখছে। উন্নত দেশে না হলেও এসব উন্নয়নশীল বা অনুন্নত
দেশে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর জন্য দেশের আইন ও বিধি-বিধানও রচিত হয় বাদশাহী ধর্মের অনুশাসনের উপর লক্ষ্য রেখে। এসব দেশের মূল অংশই ধর্মে
অন্ধ বিশ্বাসী, গোঁড়া এবং আনুষ্ঠানিকতায় নিবেদিত। এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অংশে মূলতঃ
মানুষ এবং রাষ্ট্র, পরিবার এবং সমাজ সবকিছুই আবর্তিত হয় রাজনৈতিক ধর্মের অনুপ্রেরণায়
এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায়।
রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতার
ধর্ম সফলতার পরিবর্তে বর্তমান বিশ্বে বিফলতার পরিচয় দিচ্ছে। ওই ধর্ম মানুষকে একত্রিত
করার পরিবর্তে বিভক্ত করছে। অন্যদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুসারীরা মানবতার বাণীতে ‘মানুষ
মানুষের জন্যে’ এই শ্লোগানে সকলে এক জায়গায় একত্রিত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকতা ও রাজনৈতিক
ধর্মের চাপে অজ্ঞতার কারণে মুসলমান খুঁজছে মুসলমানকে, হিন্দু খুঁজে হিন্দুকে, খ্রীষ্টান
সাহায্য করছে খ্রীষ্টানকে এবং বৌদ্ধ এগিয়ে যাচ্ছে বৌদ্ধের অনুসারীদের পাশে। সকল মানুষ
এক ও অভিন্ন এবং ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই জীবনাদর্শ শ্রেণীধর্মের আঘাতে হুমকির মুখে।
অজ্ঞতার কারণে উগ্রবাদী ধর্মের কাছে বিশ্ব মানবতা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। সকল ধর্মেই উপদেশ,
নির্দেশ ও নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক উগ্রবাদী শ্রেণীধর্ম মানুষকে বিশালত্বের পরিবর্তে
ধর্মীয় মূল্যবোধহীন ধর্মীয় গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টায় রত।
সকল ধর্মে স্রষ্টার
বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলেও ধর্মীয় মূল্যবোধহীন শ্রেণীধর্মের মানুষ নিজ নিজ ভঙ্গিতে
স্রষ্টাকে স্বীকার করছে ও চিহ্নিত করছে। বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করছে। মূল্যবোধের ধর্ম
তাই সকল মানুষকে তার ধর্মীয় চেতনায় এক পতাকাতলে আনয়ন করতে পারছে না। অন্যদিকে দারিদ্র্য
ও অজ্ঞতা মানুষকে ধর্মের বিভিন্নতায় বিভক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছে। ধর্মীয় মানবতার
পতাকাতলে পৃথিবীর সকল চৈতন্যশীল মানুষ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
ধর্মে বিশ্বাসী,
অবিশ্বাসী, আস্থাশীল সকল মানুষেরই শুধু একটি পরিচয়ে পৃথিবীতে চিহ্নিত হওয়ার সময় এসেছে
এবং সেই পরিচয় হচ্ছে মানুষ-মানবতা। মানবতা মানুষকে নিয়ে, কোন বিশেষ শ্রেণী ধর্মকে নিয়ে
নয়। বিশ্ব মানবতায় সকল ধর্মের স্থান সমান।
ধর্ম ব্যক্তিগত
বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মের বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী কারও জন্যেই মানবতার পতাকাতলে অবস্থান
নিতে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় না। পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে সকল মানুষের কল্যাণে, সকল মানুষকে
একত্রিত করার জন্যে এবং সকল মানুষকে শৃঙ্খলার জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যে। হাজার হাজার
বছর অতিক্রমের পর আজ অনুধাবনের সময় এসেছে রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতার উগ্রবাদী ধর্ম বৃহত্তর
মানুষের কল্যাণে সঠিক ভূমিকা রাখতে কতটুকু সমর্থ হচ্ছে তাই নিয়ে।
বর্তমানে উগ্রবাদীরা
মানুষকে বিভক্ত করার ভূমিকা গ্রহণ করছে, তাই ধর্মের কারণে মনুষের অখন্ডতা নীতি হুমকির
মুখে পড়ছে। ধর্মের মূল্যবোধ বিষয়ে মানুষের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিশ্বে ধর্ম বিশ্বাসীর
সংখ্যা আরও হ্রাস পেতে থাকবে। অন্ধভাবে নয়, ধর্মকে জানতে হবে মূল্যবোধের চর্চা ও চর্যা
করে সত্যের ভিত্তিতে। মানুষকে সেবা করার মধ্যেই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। বিশ্ব মানবতার স্বার্থে
ধর্মের মূল্যবোধগুলোতে আমাদেরকে প্রভাবিত করার জন্য রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতার উগ্রবাদী
ধর্মের কবল হতে বের হয়ে আসার বিশ্বজুড়ে এখনই সময় নচেৎ মূল্যবোধের ধর্ম-মানবতার ধর্মের
মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে এবং আরো হবে।
ধর্মের অন্যতম
কাজ তার অনুসারীদের সত্যের পথে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। মানুষে মানুষে হানাহানি, উচ্ছৃংখল
জীবনযাপন এবং মানুষের বিভক্তিকরণ রোধ করতেই মানুষ একদিন ধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল। অন্ধকার
থেকে আলোর পথ দেখাতেই আজ সময় এসেছে মূল্যবোধ অনুধাবনের, সময় এসেছে আত্মবিশ্লেষণের-ধর্ম
মানবতার জন্য প্রমাণ করতে। রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতায় ব্যক্তি স্বার্থের বা গোষ্ঠী স্বার্থের
বা উগ্রবাদীতার ধর্ম নয়।
ধর্ম অন্ধ বিশ্বাস
নয় বরং আধুনিক বৈজ্ঞানিক সত্যের
দিসারী এবং মানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ হিসেবে সকলের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সামনের
দিকে অগ্রসরমান। ধর্ম মানুষের জীবন চলার পথে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং ধর্মপরায়ন
মানুষ ধর্মকে ব্যক্তি জীবনের দৈনন্দিন
জীবনযাত্রায় সত্যপ্রতিষ্ঠার অস্ত্র হিসাবে গণ্য করুক এটাই সময়ের দাবী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন