বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বপ্ন !


স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বপ্ন !

 
সংলাপ ॥ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সিপাহসালার, এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি মেহনতি কৃষক-শ্রমিক মজলুম জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের আপোষহীন সংগ্রামের সাহসী অগ্রনায়ক যুব সমাজ।

যুব সমাজ যে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন জাদরেল দেশি-বিদেশি সামন্তবাদী, ফ্যাসীবাদী, স্বৈরশাসক-শোষক গোষ্ঠির রক্তচক্ষু, বোমা-বন্দুক ভ্রুক্ষেপ না করে, ভয়-ভীতির প্রতিবন্ধকতার পাহাড় ডিঙিয়ে, জেল-জুলুমের স্টিম রোলার উপেক্ষা করে সভা-সমাবেশ সম্মেলনে যে সব বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে এদেশের বৃহত্তর জনশক্তি, উৎপাদনের উৎস শক্তি, চির অবহেলিত, বঞ্চিত, অবচেতন অসংগঠিত মজলুম শ্রমজীবী মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুব্ধ করেছিলেন, কঠোর সাধনা করে এদেশের স্বাধীনতা ও গণআন্দোলনে বাধভাঙা জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন সে লক্ষ্য কি আদৌ পূরণ হয়েছে?

এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য শোষণ, জুলুম ও আধিপত্যমুক্ত সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার লক্ষ্যে যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে জীবনপণ সংগ্রাম ও সাধনা করেছেন সে লক্ষ্য কি আদৌ সফল হয়েছে? দেশের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতি অবস্থার দিকে তাকালে যে দৃশ্য লক্ষ্য করা যায় তাতে এদেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের তুলনামূলকভাবে কোন সুখ, শান্তি, কোন উন্নতি, অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বলার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আজো সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, গোলামী যুগের ধারা বহন করে দেশের মাথাধারী ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা বহাল রাখা, দেশের কৃষক শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ প্রক্রিয়া মজবুত করার লক্ষ্যে দেশের সহায় সম্পদকে কতিপয় মধ্যস্বত্ব ও সুবিধাভোগীদের একচেটিয়া করার মানসে যেসব বিধি-বিধান করা দরকার উহা কেবল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে সোনার হরিণ দেখিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে।

জ্বলন্ত প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ঋণ খেলাপীর মত অমার্জনীয় অপরাধ ও নাশকতামূলক ভয়ংকর দেশদ্রোহীতার জন্য কোন মামলা দায়ের করা হচ্ছে না।

দুর্নীতিবাজ এসব দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জন নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হয় না। বরং শাসক-শোষক চক্রের অন্যায়-অবিচারের সমালোচনা করার জন্য গ্রেফতার করা হচ্ছে।

পরিতাপের বিষয় যে, চিহ্নিত গণদুশমনদের বিরুদ্ধে কোন রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে না। কোন বিক্ষোভ মিছিল করে না। এসব ঘাতক গণদুশমনদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোন বর্হিপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় না। কোন পোস্টার, প্রচারপত্র বের হয় না। এসব ঘাতকদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কোন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজও দেশের শতকরা ৬০/৭০ ভাগ মানুষ ভূমিহীন। ঠিকানাবিহীন, গৃহহীন। ভাসমান যুবক-যুবতীদের বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত। লক্ষ লক্ষ  মানুষ  কর্মসংস্থান ও খাদ্যের অভাবে শহরগুলোতে ধাবমান হয়ে, বস্তিবাসী হয়ে, রেল লাইনের পাশে, ঝড় বাদলের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে স্ত্রী-শিশুপুত্র কন্যা নিয়ে দুর্বিষহ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে এবং চরম হতাশা-নিরাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কাল যাপন করছে। বিপদগামী হচ্ছে। অপরদিকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দেশের  বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য যেখানে প্রাথমিকভাবে জরুরি প্রয়োজন ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপন করা, উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদনী শক্তি ৬৮ হাজার পল্লী গ্রামের মেহনতি মানুষের হাতে তুলে দেয়ার বিধি-বিধান করা হচ্ছে না।

যেদেশের বেশির ভাগ মানুষ দুবেলা ঠিক মতো খেতে পায় না, ঠিক মতো বস্ত্র পায় না, মাথা গোজার ঠাঁই পায় না, ন্যূনতম চিকিৎসা-শিক্ষা পায়না, সে দেশকে কোনক্রমেই স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে গণ্য করা যায় না। যে দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক শক্তি হচ্ছে কতিপয় লুটেরা, দুর্নীতিবাজ আমলা, কালোটাকার মালিক, চোরাচালানী, টাউট-বাটপার সে দেশকে কোনক্রমেই স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ বলা যায় না। যে দেশে ভাত কাপড়ের অভাবে লক্ষ লক্ষ মা-বোনের রাস্তায় নামতে হচ্ছে সে দেশকে কোনক্রমেই সভ্য, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ বলা যায় না। যে দেশে আজও একটি ট্যাবলেট, এক ফোঁটা ওষুধের অভাবে লক্ষ লক্ষ লোককে প্রতিবছর অকাল মৃত্যু বরণ করতে হয় সে             দেশকে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ বলা যায় না।

দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে নির্বাচন করে সরকার দখল করা হয় বটে, কিন্তু সেই বিশাল ব্যয় বহুল নির্বাচনে কালো টাকার মালিক-মোক্তার ছাড়া সাধারণ মানুষ সরল-সোজা দুর্নীতিমুক্ত সমাজসেবী মানুষের পক্ষে অংশগ্রহণ করা আদৌ সম্ভব নয়। এহেন প্রহসন প্রতারণামূলক নির্বাচনে কেবলমাত্র কালো টাকার ও অস্ত্রে দৌরাত্ম্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা যায়। এহেন নির্বাচিত সরকারগুলো বিদেশি শোষক-শাসক চক্রের মত নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, উৎপাদনের উপকরণসমূহে মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণের উপর শোষণের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে, সেই দেশে সরকারগুলোকে স্বাধীন চেতনা সমৃদ্ধ সরকার বলা যায় না। এসব নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারগুলো কার্যত কালোটাকার মালিক অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই আজ জনগণ এহেন কৃত্রিম নির্বাচনের প্রতি মোটেই আস্থাশীল নয়। গণতন্ত্র আজ মহাসংকটে বিপন্ন। গণতন্ত্র আজ কালোটাকা ও অস্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে।

দেশে বিরাজমান এহেন প্রহসন ও প্রতারণামূলক স্বাধীনতা-গণতন্ত্রএদেশের জনগণের কাম্য ছিল না। এহেন প্রতারণা সর্বস্ব স্বাধীনতা-গণতন্ত্রের জন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। এধরনের কোন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এদেশের কোন মানুষের ছিল না। বাংলাদেশটাকে শোষকদের চারণক্ষেত্রে পরিণত করার জন্য এদেশে কোন মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। বাংলাদেশকে চোরাচালানী, চোরাকারবারী, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, ধর্ষণের স্বর্গরাজ্য বানানোর জন্য রক্ত দেয়নি। এধরনের আহাম্মকের স্বর্গরাজ্য কায়েমের স্বপ্ন-চেতনা কোন মুক্তিযোদ্ধার ছিল না এবং আজো নেই।?মুক্তিযোদ্ধা যুব সমাজের এধরনের কোন স্বপ্ন, কোন সাধনা, কোন লক্ষ্য ছিল না। এদেশের মুক্তিপাগল মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি শোষণ বৈষম্য ও নির্যাতনমূলক শাসন, বিধি-বিধান বহাল রাখার জন্য কিংবা শোষক বদলের জন্য এদেশের কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। দেশের কেবলমাত্র দশ ভাগ মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য একতলা দালানকে দশ তলা করা, ১টা গাড়ির স্থলে ৫টা গাড়ির মালিক, ১ কোটি টাকার বদলে শত কোটি টাকার মালিক বানানোর জন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। হোটেল, বার বানানোর জন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। ধান, পাট, ইক্ষু, তামাকের ন্যায়সঙ্গত মূল্যদানের ব্যবস্থা না করে কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার গঠন করে এমপি, আমলাদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি, বিদেশে ভ্রমণ বিলাস করার জন্য লাল পাসপোর্ট, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির ব্যবসা চালাবার সুযোগ করে দেয়ার জন্য এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি, দেশের ভূমিহীন, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঠিকানাবিহীন বস্তিবাসী করার জন্য, বাংলাদেশকে বিদেশী অপসংস্কৃতি,  নতুন প্রজন্মের যুবক-যুবতীদের চরিত্র হননের জন্য, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানুষ তৈরি না করে মাস্তানদের ট্রেনিং সেন্টারে পরিণত করার জন্য একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। এদেশের বেশির ভাগ মানুষকে অভুক্ত, আধপেটা, ক্ষুধার্ত রেখে, বস্তির মধ্যে, রাস্তার ফুটপাতে মানবেতর অবস্থায় রেখে মন্ত্রি, নেতা-নেত্রীদের সংবর্ধনায় তাদের ছেলে নাতিদের বিবাহ ও খাতনায় লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করার নাম স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র হতে পারে না। এ ধরনের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করার স্বপ্ন সাধনা কোন মুক্তিযোদ্ধার ছিল না। বঞ্চিত শোষিত নিগৃহীত নিপীড়িত মানুষের, এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের আর্থ-সামাজিক শোষণ ও ক্ষুধা মুক্তিই ছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মৌলিক রূপরেখা স্বপ্ন-সাধনা ও চিন্তা-চেতনা। সে হিসেবে এদেশে বাস্তবে প্রকৃত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন করে সংগ্রামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন অভিযান শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব আজ নীতি আদর্শের চরম সংকট সাগরে নিমজ্জিত। অর্থ-অস্ত্র, কালো টাকা আর সন্ত্রাসের উপর নির্ভরশীল রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব দিয়ে দেশের মানুষের কোন কল্যাণ হতে পারে না। বিশ্বের প্রচলিত সকল ইজমনীতি আদর্শে গঠিত রাজনৈতিক দল নেতা-নেত্রীদের আচার-আচরণ গতি প্রকৃতি ও চরম ব্যর্থতার আলোকে যে শ্বাশত হককথাটি আছে তা হল দেশের সকল পেশাজীবী মানুষকে শোষণ, জুলুম, আধিপত্য ও ক্ষুধামুক্ত সমৃদ্ধি লাভের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ ও গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করার জন্য  সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। মানুষকে অভুক্ত রেখে নৈতিক অবক্ষয়ের গতিরোধ করা যায় না। মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান কল্পে জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনে সত্যের সাথে?একাত্মসফল সার্থক আদর্শ বলে প্রমাণিত হয়েছে। আল কুরআনের দর্শন অনুযায়ী কোন মানুষ যেমন গরিব থাকতে পারে না তেমনি কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে না। এই আল কুরআনের দর্শন সকল সম্প্রদায় মানুষের জন্য সর্বোত্তম বিধান বলে বিবেচিত। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ও শান্তি (ইসলাম) ধর্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলে, জাতির স্বপ্ন এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন-সাধ বাস্তবে প্রস্ফুটিত হবেই।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন