বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৩

দারিদ্র্য-মানবাধিকার-মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্য!


দারিদ্র্য-মানবাধিকার-মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্য!

 
সংলাপ ॥ দারিদ্র্য বিমোচনের শ্ল্লোগান নিয়ে দেশের প্রতিটি উপজেলায় - ইউনিয়নে সক্রিয় রয়েছে শত শত, হাজারো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা - যাদের পরিচয় এনজিও হিসাবে। গত ৪২ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, এখনও হচ্ছে এ খাতে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে দেশের সিংহভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে অথবা দারিদ্র্যের সঙ্গে নিত্য বসবাস করছে। কেন? এ প্রশ্ন বহুল উচ্চারিত। উত্তরও জানা। আসলে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে চলে এনজিও সংগঠকদের (ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই!) বিলাস আর ভোগ-লালসা পূরণ। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন হয়ে ওঠে না, যা হয় - হচ্ছে তা হলো দারিদ্র্য বিমোচনের নামে বাণিজ্য। ঠিক তেমনি মানবাধিকারের নামেও এ দেশে একইভাবে চলে মানবাধিকার-বাণিজ্য। ৪২ বছর বয়সী স্বাধীন দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা শোনা যায়, তখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি এটি মুক্তিযুদ্ধ-বাণিজ্য? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে তাকাতে হবে মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গজিয়ে ওঠা সংগঠনসমূহের পরিসংখ্যানের দিকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবাধ বাণিজ্যে রাশ টানার জন্যই হোক কিংবা একচেটিয়া বাণিজ্যের রাস্তা পরিষ্কার করে দিতেই হোক, বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট সংগঠন-প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিবন্ধনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়। এতে দেখা যায়, নিবন্ধন ফরম সংগ্রহ করে ২৯০টি সংগঠন। পরে অবশ্য নিবন্ধন শর্তের চাপের ফলে ফরম জমা দিতে দেখা যায় তাও ২৭টি সংগঠনকে (সূত্র - দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ অক্টোবর ২০০২)! একইভাবে প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামেও কি এখনো চলছে যুদ্ধাপরাধী বিচার-বাণিজ্য? এর উত্তর খুঁজে পেতে চাইলে আগে জেনে নিতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে যারা সোচ্চার হয়ে উঠছেন, তারা কারা? মুক্তিযুদ্ধের ভুলুন্ঠিত চেতনার জন্য যারা কথা বলছেন এবং চিৎকার করেছেন - এদের অতীত কি? এবং গত ৪২ বছরে এরা কোথায় ছিলেন? মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ফেলে আসা বছরগুলোতে সরকারের এদের অবদান!

‘বস্তুত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধারা আজ যে পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে এটা সূত্রগতভাবেই অবধারিত এবং ইতিহাস সম্মত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক পটভূমি অর্থাৎ যে চেতনা ও সংকল্প একটা মুক্তিযুদ্ধকে সম্ভাবিত করে তোলে তার অভাব ছিলো স্বাধীনতার গোড়া থেকেই। যুদ্ধের জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যুদ্ধটা ছিলো আমাদের উপর আরোপিত। ’৭১-এর ২৫ মার্চে পাক আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছিলো একটা রাজনৈতিক সমাধানেরই পক্ষপাতি। ..... যে নেতার নেতৃত্বে সংগ্রাম, তিনি শুরুতেই ধরা পড়েন শত্রুর হাতে, আর তার সহযোগীরা নিরস্ত্র জাতিকে প্রথমে অনিশ্চয়তায় রেখে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। ..... আকস্মিকতার এই মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণের পক্ষে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে ওঠার সুযোগ  হয়নি। তার উপর যুদ্ধের নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিলো তাদেরও মধ্যে ছিলো কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক।

নেতৃত্ব অপ্রস্তুত হলে কি হবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া হানাদাররা কিন্তু সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নিরস্ত্র বাঙালির উপর। ওদের চোখ ছিলো সোনা-ফলা বাংলার মাটির উপর আর বন্দুকের নল ছিলো বাঙালির বুকে। এ অবস্থায় প্রতিরোধে নামে বাঙালি -  যারা স্বতপ্রণোদিতভাবে শ্লোগান তুলেছিলো ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো - বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। এই অকুতোভয় প্রতিরোধ লড়াইটা যুদ্ধের মাঠে কারা করেছিলো? মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যারা লড়াই করেন তাদের বিপুল অংশই ছিলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। স্বদেশপ্রেম, দেশের ও জনগণের লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আকাঙ্খা এমনকি আত্মরক্ষার তাগিদেও অনেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বেচ্ছাসেবকের মনোভাব নিয়েই তারা এগিয়ে আসেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কিশোর যুবক বিচ্ছিন্নভাবে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। .....প্রকৃতপক্ষে নয় মাসে আগাগোড়া যারা যুদ্ধ করেছে তাদের অধিকাংশই ছিলো সাধারণ স্তরের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষহীন সন্তান’।

স্বাধীনতা উত্তরকালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস পরিচালিত জরিপেও দেখা যায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীর মধ্যে শতকরা ৫০ জন কৃষক, শতকরা ৩০ জন ছাত্র এবং শতকরা ২০ জন বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য।

এটাই সত্য যে ১৯৭১ সালে মাঠে-ময়দানে, জলে-জঙ্গলে যারা যুদ্ধটা করলো তারা এর সুফলটা পেলো না। ‘যুদ্ধ করেছি’ - একথা বলে মঞ্চে উঠে বড়াই করার সুযোগটাও জুটলো না সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিরাট অংশই স্বেচ্ছাসেবী ছিলো, সেহেতু যুদ্ধের পরই তারা অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। এদের শক্তি ছিলো কিন্তু কোনো সংগঠন ছিলো না। বাংলার বিশাল জনসমুদ্র থেকে এসে তারা আবার জনসমুদ্রেই মিশে যায়।’

জনসমুদ্রে মিশে গিয়ে জীবনযুদ্ধে ডুবে যাওয়া এই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যখন অনাহার, অর্ধাহার আর অনিশ্চয়তার সঙ্গে অন্তহীন লড়াই-এ রত, তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড়াইটা করলো কারা? ‘বাংলাদেশে প্রথম থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত যাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনা যায় তাদের মধ্যে গ্রামের গরীবদের   সন্তান ও কারখানার শ্রমিকদের মুক্তিযুদ্ধের কথা যে কোথাও ঠাঁই পাবে না, এটাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধের রক্তঝরা ফসলের একচ্ছত্র ভোগদখল আর ভাগিদারশূন্য বড়াই নিশ্চিত করার প্রয়োজনে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেয়ার ঘটনাটাও বুঝি তাই ছিলো খুবই স্বাভাবিক! এখন সময় এসেছে নিজেদের ভাগ্য নিজেদের গড়ার। পেশাজীবীরা এক্ষেত্রে মাঠে নামুক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করুক এটাই সময়ের দাবী। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তির জন্য আবার গর্জে উঠে নেতৃত্ব দিক এটাই জনগণের প্রত্যাশা। ‘সত্যের জয় হোক আর মিথ্যা নিপাত যাক’ এটাই বাংলার আপামর মানুষের স্বপ্ন বর্তমান সময়ে। যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারবে কি রাজনীতিক সমাজ !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন