বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

মুবাহালা


মুবাহালা

 
মুবাহালা-প্রতিযোগিতার আহবান। মিথ্যা অবলম্বনকারীর উপর আল্লাহ্‌র অভিশাপ চাহিয়া পক্ষ-প্রতিপক্ষ উভয়েই প্রার্থনা করিয়া উহার ফলাফল দ্বারা সত্য নির্ণয় করা। ইয়েমেন প্রদেশের নজরান নামক স্থানে একদল খ্রীষ্টান ধর্মযাজক পন্ডিত, তাহাদের দলীয় লোকজনসহ, পাদরি সূরাহবীলের নেতৃত্বে মদিনায় আসিয়াছিলেন খ্রীষ্ট ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বলিয়া প্রমাণ করিবার জন্য এবং কর দান করা হইতে মুক্ত হওয়ার জন্য। অনেক কথাবার্তার পরও যখন তাহাদের পান্ডিত্য রসুল পাকের নবুয়তকে সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারিল না তখন এই বিষয়ের মীমাংসার ব্যবস্থা স্বরূপ মুবাহালা বাক্য নাজেল হইল ঃ

সুতরাং আপনার নিকট এই বিষয়ে জ্ঞানের কথা (অহিরূপে) আসিবার পরেও যাহারা আপনার সঙ্গে বিতর্ক করে তাহদিগকে বলিয়া দিনঃ আস, আমরা ডাকিয়া লই আমাদের সন্তানগণকে এবং তোমাদের সন্তানগণকে এবং আমাদের নারীগণকে এবং তোমাদের নারীগণকে এবং আমাদের নফসসমূহকে এবং তোমাদের নফসসমূহকে। অতপর বিবেচনার জন্য আল্লাহর নিকট আমরা প্রার্থনা জানাই মিথ্যাবাদীগণের উপর আল্লাহর লানত হওয়ার জন্য।’ (:৬১)। নিশ্চয় ইহা সত্য বৃত্তান্ত, ইলাহ হইতে নাই কিছু আল্লাহ ব্যতীত (অর্থাৎ আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোন ইলাহ নাই) এবং নিশ্চয় আল্লাহ্‌ হইলেন তিনি যিনি সর্বশক্তিমান এবং বিজ্ঞানময় বিচারক।’ (:৬২)।

এই বাক্যের নির্দেশ অনুসারে বলা হইলঃ আমরা আমাদের পুত্রগণকে  লইয়া আসি আর তোমরা তোমাদের পুত্রগণকে লইয়া আস; আমরা আমাদের নারীগণকে আর তোমরা তোমাদের নারীগণকে লইয়া আস, আমরা আমাদের নফসগণকে আর তোমরা তোমাদের নফসগণকে লইয়া আস। উন্মুক্ত মাঠে উভয় দল প্রার্থনা জানাই - যেন এই বিষয়ে অসত্য আরোপকারীর উপর আল্লাহর লানত নাজেল হয়। প্রার্থনা পেশ করিবার সময় নির্ধারিত হইয়াছিল পরবর্তী দিবসের প্রভাতকাল। উহা ছিল দশ হিজরির ২৪ জিলহজ্ব, শুক্রবার।

ইহা ছিল উভয় পক্ষের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি ফয়সালার ব্যবস্থা। সেইজন্য পুরুষ জাতির প্রতিনিধি, নারী জাতির প্রতিনিধি এবং শিশু ও কিশোর দলের প্রতিনিধি এবং পন্ডিত দলের প্রতিনিধি একত্র করা হইল। অর্থাৎ সবরকম লোকদের পক্ষ হইতে প্রতিনিধি লইয়া আল্লাহর কাছে আবেদন করা, যাহাতে মিথ্যাবাদীগণের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়। অর্থাৎ নবূয়তের দাবি মিথ্যা অথবা তাহাদের দ্বারা তাঁহার নবুয়তের অস্বীকৃতি মিথ্যা।

রাসুলুল্লাহ্‌ (সাঃ) সালমান ফারসীকে নির্ধারিত মাঠে শামিয়ানা টানাইয়া; নিজেদের আশ্রয়ের জন্য ব্যবস্থা করিতে বলিলেন। তাহাই করা হইল। (প্রকাশ থাকে যে নবী এবং ইমামগণের কাজের এন্তেজাম দেয়ার জন্য আহলে বাইতগণই যোগ্যতম ব্যক্তি)।

খ্রীষ্টান প্রতিনিধি দলের উপস্থিতির আগেই রসুল পাক তাঁহার দল হিসাবে (আবনায়ে রসুল)অর্থাৎ রসুল সন্তান ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আঃ), নেছায়ে রসুল ফাতেমা তুজ জোহরা এবং নফসে রসুল আলী (আঃ) কে সঙ্গে লইয়া যথাস্থানে আসন উপস্থিত হইয়া আসন গ্রহণ করিলেন।

অপরপক্ষে খ্রীষ্টান প্রতিনিধিবৃন্দ কিছুদূর হইতে তাহাদিগকে দেখিয়া দাড়াইয়া রহিলেন এবং দলপতি সুরাহবীল এইমর্মে দলীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘ভাতৃবৃন্দআমার দৃষ্টিতে আমি তাঁহার এবং তাঁহার দলীয় ব্যক্তিগণের মধ্যে ঐশী জ্যোতির চরমরূপ দেখিতে পাইতেছি। তাঁহারা যদি এই পাহাড়কে সরিয়া যাইতে বলে তাহা হইলে পাহাড় নিজ স্থান হইতে সরিয়া যাইবে। এমতাবস্থায় যদি আমরা মুবাহালার কথা অনুযায়ী স্রষ্টার নিকট সম্মিলিত প্রার্থনা জানাই তাহা হইলে নিশ্চিত জানিয়ে রাখ অভিসম্পাত আমাদের উপরেই পতিত হইবে। শুধু আমরাই নয় বরং গোটা খ্রীষ্টান জাতি আমাদের কারণে অভিসম্পাতে নিপতিত হইবে।এই বলিয়া খ্রীষ্টান দলপতি পাদরী সাহেব রাসুলপাকের নিকট অগ্রসর হইয়া সবিনয়ে বলেলেন আমি সাক্ষ্য দির্তেছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর সত্য নবী। এইরূপে খ্রীষ্টান মোমিনগণ সত্যকে অস্বীকার করিলেন কিন্তু তাহারা নিজ ধর্ম ত্যাগ করিতে রাজি হইলেন না। যেহেতু তাহারা নজরানের সমগ্র খ্রীষ্টানগণের প্রতিনিধি হিসাবে আসিয়াছেন সেইহেতু তাহাদের তাৎক্ষণিক ধর্মান্তর সারাদেশের ধর্মান্তরের শামিল হইয়া পড়ে। অবশ্য পরবর্তীকালে তাহাদের অধিকাংশই মোহাম্মদী ধর্মে দাখিল হইয়াছিলেন। তাহারা নবীর রাষ্ট্রের আনুগত্য গ্রহণের প্রতীক স্বরূপ কর দানে সম্মত হইলে রাসুল্লাহ (সাঃ) তাহাদিগকে আলী (আঃ) এর সাথে চুক্তিপত্র সম্পাদনের নির্দেশ দিলেন। চুক্তি বিষয়ে খ্রিষ্টানগণের সহিত  সদয় আচরণ করা হইল এবং বিরোধিতা না করিয়া যতকাল তাহারা শান্তিপূর্ণ আচরণ করিবে ততকাল তাহাদিগকে তাহাদের আপন ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দেয়া হইল। এইরূপে তাহারা কর প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

মুবাহালার এই ঘটনা হইতে একটা কথা বিশেষভাবে প্রমাতি হইল যে, বৈষয়িক বুদ্ধিমত্তা রুহানী শক্তির নিকট সব সময়ই পরাজিত হইয়া থাকে। ইহা সর্বকালীন সত্য। এইজন্য পার্থিব বুদ্ধিমত্তা আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সত্যের বিরুদ্ধে তাহার পাশবিক শক্তি চিরকালই ব্যবহার করিতে অভ্যস্ত, কারণ ইহা ছাড়া তাহার অস্তিত্ব রক্ষা করার অন্য উপায় থাকে না।

এই প্রসিদ্ধ ঘটনাটি বিশেষ একটি প্রমাণ বহন করে যে, দ্বীনে মোহাম্মদী খ্রীষ্ট ধর্ম হইতে উচ্চমানের ধর্ম। ঘটনাটির গুরুত্ব হইল এই যে, ইহা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মোমিনগণের দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এঁর নবুয়তের সাক্ষ্য দানের ব্যাপার। এক নবীর উম্মতগণ অন্য নবীকে নবীরূপে একযোগে প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষ্য দানের একটি মহান ঘটনা।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এই ঘটনার উপর করা যাইতে পারে খ্রীষ্টান প্রতিনিধিদল প্রথম সাক্ষাতেই নবুয়তের সাক্ষ্য দিতে পারিতেন, কিন্তু আল্লাহপাকের এইরূপ ব্যবস্থার একটি গভীর রহস্য রহিয়াছে। এই ঘটনা দ্বারা শুধু অন্য ধর্মাবলম্বীর নিকট নবীর নবুয়ত প্রকাশ করার উদ্দেশ্য ছিল না,  তাহা হইলে উহা প্রথম পর্যায়েই ঐরূপ করিয়া দেখাইতে পারিতেন, বরং তাহাদের অনুসারী আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্য এলমে এলাহীর এহা একটি রহস্যপূর্ণ ব্যবস্থা বিশেয়। ইহা এইরূপ ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ঘটান হইয়াছিল, ইহা হইতে উম্মতে মোহাম্মদীর বিশেষ প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য, যাহাতে তাহারা রসুল বংশের গুরুত্ব ভুলিয়া না যায়। এই উদ্দেশ্য না থাকিলে প্রথম দিনেই নবী তাঁর নবুয়তকে তাহাদের নিকট প্রকাশ করিতে পারিতেন যেহেতু তাহারা ছিল বিশ্বাসী।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পরিচালনার ক্ষেত্রে মুবাহালার ঘটনা কোন দিকনির্দেশনা দিতে পারবে কিনা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। তবে দার্শনিকের দৃষ্টি ভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের সমাজের প্রতি স্তরে এর প্রয়োগ একেবারে অসম্ভব নয়। হানাহানির পথ পরিত্যাগকরে ধৈর্যের সাথে মুখোমুখি বসে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এবং সর্বস্তরে সত্য প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন