মানুষের ধর্ম - মানবতার জন্য
হোক -১
শাহ্ আনোয়ারা বেগম ॥ ধর্ম সমাজের প্রতিটি স্তরের
মানুষকেই প্রভাবিত করে, তাই ধর্ম একটা কঠিন
গবেষণার বিষয়। জন্ম, মৃত্যু বা ভালোবাসার
মতো বিশ্বজনীন এবং সর্বজনগ্রাহ্য বিষয় হিসেবেই ধর্মকে দেখার প্রয়াস চলছে বিশ্বব্যাপী।
আমরা প্রায়শই দেখি ধর্মবিষয়ক আলোচনা হয় গবেষণামূলক, কিছুটা উপদেশমূলক। ভাষাও হয় সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার
বাইরে। এই দুর্বোধ্যতায় ধর্মতত্ত্ব সাধারণের চোখে রহস্যময় হয়ে ওঠে। ধর্মবেত্তাদের করে
দেয় অতিমানব। ধর্মপুস্তক হতে অংশবিশেষ পড়ার মাধ্যমে আলো-আঁধারি যে ধর্মীয় বাতাবরণ তৈরি
করে, তাতে সাধারণ মানুষের মনে যে
ভয়-ভক্তির সঞ্চার হয়, তার অনেকটাই না বুঝার
কারণে। সাধারণ মানুষ একটা বিষয়কে ভালো করে জানে না, বুঝে না বলেই সেটাতে আকৃষ্ট হয়। এই কারণে আকৃষ্ট হওয়াটাতেই যুক্তিবাদী
আধুনিক মানুষের আপত্তি। এখানেই বিরোধ। একেকটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রচলিত আরবী যদি সোজা
বাংলায় অনুবাদ করে পড়ে যাওয়া যায় - তাহলেই তার সব রহস্যময়তা ঘুচে যেতো। তখন তার মধ্যে
মিথ্যার প্রতি আকর্ষণ কমে যেতো। অনেক সময় কিছুটা হাস্যকর ও অপ্রাসঙ্গিকও মনে হতে পারে।
আবার তার মধ্যে কিছু চিরন্তন সত্যও পাওয়া যায়। আর সেটা জেনে বেছে নেয়ার জন্যেই দরকার
আগে বুঝে নেয়া। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অপ্রয়োজনীয় বাহ্যিক রীতিনীতিকে বাদ দিতে
হলে তাই প্রথমে ধর্ম কি ও কেন এটা সহজভাবে বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষ বর্তমান সামাজিক
অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যে ভূমিকা তাতে যে খুব খুশি তা তো নয়-ই বরং অবশ্যই সত্যটা কি তা জানার জন্য
কিছু পরিবর্তন ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা চাইছে,
চাইছে
যুক্তিবোধ ও ন্যায়বিচার।
ধর্ম কথাটার অর্থ কি? বাংলা অভিধানে এর মানে করা হয়েছে সৎকর্ম, সদাচার,
পূণ্যকর্ম, কর্তব্যকর্ম, সমাজহিতকর বিধি। আরেকটি অর্থ হলো - পরম্পরাগত সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, প্রার্থনা পদ্ধতি, সংস্কার রীতিনীতি এবং পরকাল ইত্যাদি বিষয়ক মতামত।
তৃতীয় অর্থে বস্তু বা ব্যক্তি নির্বিশেষে - স্বভাব, গুণ বা শক্তি।
এই শেষ সংজ্ঞাটি বস্তুর উপর যেভাবে প্রযোজ্য অর্থাৎ
পদার্থের ধর্ম, আগুনের ধর্ম, তরল বা মৌলিক পদার্থের ধর্ম, সেই অর্থে মানুষের উপর প্রয়োগ করলে পাওয়া যায় মানুষের
বিশেষ স্বভাব বা গুণ। যদিও আমরা জানি মানুষের গুণের সঙ্গে মেলা দোষও থাকতে পারে - আমরা
তাকে ধর্ম বলবো না। ধর্ম বলবো সেই সব বিশেষত্বকে যা আদর্শ মানুষের গুণাবলী, যা মানুষকে সভ্যতার পথে এতদূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে
- মানুষকে মানুষ করেছে শান্তির লক্ষ্যে। প্রথম সংজ্ঞানুযায়ী সৎকর্ম, সদাচার,
কর্তব্যকর্ম
সমাজহিতকারিতা ইত্যাদি।
ধর্মের এই বিস্তৃত সংজ্ঞা থেকে এসেছে দ্বিতীয় সংজ্ঞা।
এটা স্থান কাল ভেদে পাল্টেছে, পাল্টাচ্ছে। বিভিন্ন
ধর্মের উপাসনা পদ্ধতি আচার অনুষ্ঠান কতটা আলাদা তা তো আমরা জানি, ঈশ্বর,
ভগবান
ও আল্লাহ্ সম্পর্কে মতও হরেকরকম। বৌদ্ধধর্মে ঈশ্বর নেই। আমরা পাচ্ছি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক
ধর্মের রূপগুলো। অথচ ‘সমাজহিতকর পূণ্যকর্ম
বা কর্তব্যকর্ম’ সংজ্ঞাটি কিন্তু বিশ্বজনীন
রূপ নিতে পারতো - হতে পারতো সকলের জন্য এক ধর্ম। কিন্তু তা তো হয়নি। স্থান কাল ভেদে
আচার অনুষ্ঠান, পরম্পরাগত বিশ্বাস
পাল্টে গেছে। প্রতিটি আলাদা গোষ্ঠীপতি বা রাষ্ট্র যেমন তার নিজের মতো করে নিয়মাবলী
তৈরি করে, ধর্মের প্রবর্তকরাও তাই করেছে।
প্রতিষ্ঠাতার রচনায় ও প্রচারে তাই পৃথক পৃথক রূপ নিলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো। নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হলো প্রচারকরা ও তাদের অনুসরণকারীরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। প্রতিটি ধর্মবেত্তা তাই
আজও সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা ও উদার প্রগতিবাদী কথার ফাঁকে ফাঁকে নিজের ধর্মমতটির শ্রেষ্ঠত্বের
কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না। অনুগামীরা ক্রমশই ভুলে যেতে থাকলো ধর্মের আসল সমাজহিতকর
উদ্দেশ্য। প্রকট হতে থাকলো আচার বিচার প্রকরণ পদ্ধতি। মাঝে মাঝে প্রতীকী সমাজ সেবা
করে পূণ্যার্জন করার মধ্যে আবদ্ধ রইলো তাদের সদাচার। বাড়তে লাগলো বিভেদ। শুরু হলো ধর্মীয়
উগ্রবাদীদের তান্ডব বিশ্বজুড়ে। উগ্রবাদীরা প্রমাণ করতে চাইছে তারা ধার্মিক। অতিমাত্রায়
ধার্মিক।
এখন পৃথিবী পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট গোষ্ঠীতে
বিভক্ত নয়। তাই আলাদা আলাদা নিয়মকানুনগুলো সমন্বয়ের চেয়ে বিভিন্ন রকমের সংঘর্ষের কারণ
হয়ে উঠেছে স্বাভাবিকভাবেই।
সব ধর্মেই ভালোবাসার কথা, সহনশীলতার কথা বলা হয়েছে - তাহলে ধর্ম কি দোষ করলো? থাকছে না প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো মিলেমিশে। তারপর
একটু গভীরে গেলেই উদারতার মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে আসল চেহারা। তখন দেখা যায় প্রতিটি
ধর্মভীরু মানুষই কি মমতায় আঁকড়ে থাকে বাপ দাদার ধর্মটিকে, কি সযত্নে এড়িয়ে যায় বা ভুলে যায় জন্মসূত্রে পাওয়া
ধর্মটির দোষত্রুটিগুলোকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্ল্লেষণ করে পরধর্মের ত্রুটি বা ভ্রান্তবিশ্বাসকে।
ভুলে যায় তার ধর্মটি সে নেহায়তই উত্তারাধিকারসূত্রে পেয়েছে - দেখেশুনে বেছে নেয়নি।
বিরোধ যত তা সবই মূলত আচার-অনুষ্ঠান, উপাসনা পদ্ধতি, ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহ্
সম্পর্কিত মতামতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মিল যেখানে তা হলো ন্যায়বোধ, কর্তব্যকর্ম, সৎগুণ, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি
বিষয়ে। তাহলে আজ এই বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে আমরা কেন ভুলে যাবো ধর্মের আসল উদ্দেশ্য? কেন আচার-অনুষ্ঠান, বাহ্যিক পদ্ধতি প্রকরণকে ছেঁটে ফেলতে পারবো না? কেন মেনে নেবো না মানবিক গুণকেই ধর্ম বলে?
ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মগুরুদের আদেশকে অভ্রান্ত বলে
পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে মেনে নিলে এবং সমাজবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞানে যা পরীক্ষিত সত্য তা নিয়ে খোলা
মনে পড়াশোনা করে নিলেই পারা যাবে ন্যায়-অন্যায়ের, ঠিক ভুলের বিচার করতে। বেরিয়ে আসতে পারা যাবে ভয় ও অজ্ঞতাজনিত
ধর্মীয় ভীতির গন্ডি থেকে। সত্যকে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে জানার চেষ্টাই সঠিক ধর্মাচরণ।
এই জানার চেষ্টাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।
১৯৮১ সালের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে জাতিসংঘ ঘোষণা
করেছে - ‘প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা
আছে ব্যক্তিগতভাবে বা সংঘবদ্ধ ভাবে নিজের পছন্দ
মতো বিশ্বাস বা ধর্মকে অনুসরণ করার।’ অর্থাৎ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তার নিজের পছন্দ মতো ধর্মমত
বা বিশ্বাস গ্রহণ করতেই পারেন। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন