মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৩

সরকারের মধ্যে দুষ্ট চক্র!

সরকারের মধ্যে দুষ্ট চক্র!

শেখ উল্লাস ॥ স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার ও স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে শাহাদাৎ বরণকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মী-নেতা-সংস্কৃতিকর্মী-ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষক-সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষের সংখ্যাটিও লাখের কোঠা হয়তো পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। অবশ্য এই শাহাদাৎ বরণকারীদেরও মধ্যে একটা বিশেষ সংখ্যা হবে সেইসব ছাত্র-যুবক যাদের বিভ্রান্ত করা হয়েছিলো। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাঙালির ইতিহাস তথা ওই সময়ের বাংলাদেশকে নিয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। লাখো লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের যে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করার পরিকল্পনা তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি - একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সমাজের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ স্বাধীনতার বদৌলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়, সরকারী-বেসরকারী চাকরিতে, ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা বিদেশে পাড়ি ঢাউস ঢাউস উন্নত অগ্রগতি সাধন করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিন্তু অমানবিক অবস্থাতেই দিন কাটাচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে তাদের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। তাদের এই অমানবিক বা মানবেতর অবস্থার মাপকাঠি অর্থনৈতিক অবস্থাই শুধু নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রেও এই দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সংগঠক বলতে স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত প্রগতিশীল, সমাজসেবী, দেশ ও জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক একটি বিশেষ ব্যক্তিত্বকে বুঝাতো। অথচ আজ রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রী বলতেই আওয়ামী-বিএনপি- শেখ হাসিনা - খালেদা জিয়া ছাড়া  রাজনীতিক ও কর্মীরা যেন অন্য কিছু বুঝে না, বুঝতেও চায় না। বুঝার মতো মেধা শ্রম-সময় খরচ করার প্রয়োজনও তাদের নেই। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই দেখা যাবে, ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ দেশে চালু হওয়া অদুরদর্শী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফাঁক ফোকর দিয়ে বিশেষ একটি সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী চক্র রাষ্ট্রীয় ও সরকারী সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সর্বত্র আসন গেড়ে বসেছে। আর এই সময়ে বিশ্বায়নের প্রভাব, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং রাজনীতি-সরকার ও প্রশাসনে প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিরা একজোট হয়ে দেশে নগদ কালো টাকার যে অবাধ প্রবাহ তৈরি করে দিয়েছেন তাতে ভেসে যাচ্ছে আবহমান বাঙালির এযাবৎ কালের যাবতীয় মূল্যবোধ ও জীবনবোধ এবং সুস্থ-সুন্দর চিন্তাচেতনার ধারা।
সবকিছুর উপরে স্থান করে নিয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও নগদ অর্থ-ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর প্রাণপণ দৌঁড়ঝাপ। আর এই দৌঁড়ঝাপে পদপিষ্ঠ হয়ে সাধারণ মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়ে পড়েছে নিঃস্ব, অসহায়।
বিদেশী সাহায্যের নামে, সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের নামে যেসব নগদ অর্থ আসে তাও নিয়ে যায় বা চলে যায় সেই সুবিধাভোগী চক্রের হাতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দিন যতই যাচ্ছে ততই হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান সরকারের সময়ে এই ক্রয়ক্ষমতার মান ধরে রাখতে পারছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যে দেশের রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সরকারী প্রশাসনযন্ত্র আওয়ামীলীগ-বিএনপি-জামাতের মতো প্রচলিত দলগুলোর মদদপুষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ইঙ্গিতে পরিচালিত, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থ বড় করে দেখা হবে এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। 
এসব দলের নেতারাও জোর গলায় একথা বলতে পারবে না, তারা জনগণের পক্ষে, মুখে মুখে মাঠে-ময়দানে যতই বলুক। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় সহায় ও আপনজন এই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি ও তার সরকার জনগণের কল্যাণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে, কৃষিখাতে ভর্তুকি দিয়ে, তা বাংলার ইতিহাসে লেখা থাকবে। কিন্তু সে তো ছিলো সাময়িক। ক্ষমতার বছর তিনেকের মধ্যেই তার কাছের মানুষদের অনেকে, যারা প্রভাবশালীওর্ ছিলেন, তাদের ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও উচ্চাভিলাষের কাছে আবারও কপাল পুড়তে শুরু করে বাংলার মানুষের। ষড়যন্ত্র তো ছিলোই, যে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত ফল ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচন। বিএনপি জামাত জোটের সরকারের শাসনে পরবর্তী ৫টি বছর বাংলার জনগণের ওপর যে শাসন-শোষণ চালিয়ে দেয়া হলো, তার সাথে কোন ‘শাসন’ ব্যবস্থার তুলনা করা যায় না। সেই শাসন বাংলার জনগণের জীবনে দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি আজও বিদ্যমান।
বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দিকে তাকালে আজ নির্মম পরিহাসের অনেক চিত্রই শুধু চোখে পড়ে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষে সত্য কথা বলার মাধ্যম-উপায়ও আজ তেমন কিছু নেই। বিচারের বাণী যেখানে নিরবে নিভৃতে কাঁদে, সেখানে কথা বলার দায়িত্ব যার সেই গণমাধ্যম যার আজ প্রায় সবটুকুই অজানা উৎস থেকে আসা অর্থ-সম্পদের মালিক ও তাদের তল্পিবাহদেও দখলে এক একটা সিন্ডিকেট।
আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলটির আমলেও এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দুর্ভাগ্য হলো আন্দোলন-সংগ্রামের ফল তারা ভোগ করতে পারেনি। এর সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে বলা যায়, স্বধীনতার পর থেকে জাতীয় জীবনে বিভিন্ন সঙ্কট ও সম্ভাবনার চোরাবালিতে দলটির ভেতর আস্তানা গেড়েছে ভয়াবহ দুষ্ট চক্র; যারা দলের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নামকে ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করছে। এর ফলে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা এবং এমনকি প্রধান বিরোধী দলে থেকেও দুষ্টচক্র ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে।
শেখ হাসিনা ওই দুষ্টচক্রের খপ্পর থেকে বের হতে না পারলে ওদের কাছ থেকে দেশ ও জারি সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ আশা করা যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষ আজ চিন্তিত। দুই নেত্রীর কতটুকু সুযোগ ও সময় আছে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দুঃখ, শোক, সুখ, শান্তির খবর নেয়ার? তাদের এবং তাদের আশপাশে যারা সবসময় থাকেন তাদের সবার লক্ষ্য ইউরোপ-আমেরিকা ও কানাডা বা মালয়েশিয়া। অবস্থাদৃষ্টে তো তাই মনে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও ব্যাক্তি জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় তার দায়বদ্ধতা ছিলো এই দেশ ও এই দেশের জনগণের প্রতি। বিএনপি ও খালেদা জিয়া থেকে তা মানুষ আশাও করে না। কেননা দলটির জন্মই একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। রাজনীতিতে জিয়া বা খালেদার আগমনের পিছনেও এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিলো না; কিন্তু আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আগমন ছিলো একটা আদর্শ ও মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। আজ কেন শেখ হাসিনা ব্যর্থ হবেন? জনগণের প্রত্যাশা কেন অপূরণ থেকে যাবে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার অতি কাছের যেসব ব্যক্তি ও  নেতা আখের গুছানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বা দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করছেন দলের বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে তারা দল ও দেশের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সদস্য হিসাবে বিবেচিত হবে রাজনৈতিক ইতিহাসে, বাংলার মানুষ দীর্ঘ পঞ্চাশটি বছরেরও বেশি সময় ধরে অনেক শ্রম-ঘাম দিয়ে, ভোট দিয়ে দলটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা এই বিষয়েটি অনুধাবন করতে না পারলে দেশে মুঢ়, মূক ও ভগ্নবুকের মানুষদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। নিজেকে শুদ্ধ করতে না পারলে অশুদ্ধতার জন্য অন্যকে দায়ী করে লাভ হবে না। মানুষের দুর্ভোগ তাতে শুধু বাড়তেই থাকবে। ভেস্তে যাবে উন্নতির ক্রমবিকাশ এবং বাঙালির সকল অর্জন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন