বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৩

গণমুখী রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা


গণমুখী রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা

 
বর্ষা ॥ ‘দেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে’- কথাটা এদেশে বেশ পুরোনো হলেও স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে আজকের দিনেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। দেশ এখন বাস্তবিক অর্থেই স্তরে স্তরে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে করে চলছে। পারিপার্শ্বিকতা ও পরিস্থিতির  পরিবর্তন ঘটছে। হাজারো সংকট মোকাবেলা করেই দেশ ও  দেশের মানুষ এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। রাজনীতি ও ধর্মের নামে দেশে শত মিথ্যাচার, সহিংসতা, হানাহানির মধ্যেও সময় বসে নেই। গত ২০ জুন বৃহষ্পতিবার রাজধানীতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের উপস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য হ্রাসে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই অর্জন করবে বাংলাদেশ। ২০১৫  সালের মধ্যে এমডিজি অর্জনের কথা ছিল।

সেই সাফল্য দেখাবে বাংলাদেশ ২০১৩ সালের মধ্যেই। বাংলাদেশের এ অর্জনকে ‘বিরল’ ও উল্লেখযোগ্য’ বলে আখ্যা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দুই-ই কমেছে। বিশ্বব্যাংক গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময় ধরে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশের এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে এ কথাটিও স্মরণ করে দিয়েছে যে, এখনো বাংলাদেশের চার কোটি ৭০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে যার মধ্যে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দুই কোটি ৬০ লাখ এবং এ চরম দরিদ্র মানুষগুলো বাস করে গ্রামাঞ্চলে। বিগত ১০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে দারিদ্র্য কমেছে ২৬ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রকাশিত এসব তথ্যে স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি চিত্রই ফুটে উঠেছে যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যদিও এদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু যে প্রশ্নটা এখন আবারও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো কোন্‌ পথে এগোবে বাংলাদেশ?  ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা ও সন্ত্রাস, পশ্চাদপদতা ও গোঁড়ামীর অন্ধকার গলিতে বাংলাদেশ কি পথ চলবে? যেখানে দারিদ্র্য আর দুর্নীতিকে পুঁজি করে কায়েম হওয়ার আশঙ্কা থাকছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর রাজত্ব? সবচেয়ে বেশি ব্যথিত চোখে দেখতে হয়-  বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সময়ও এদেশের সর্বত্র শত শত মাদ্রাসা গড়ে উঠে যেখান থেকে পড়াশোনা করে আধুনিক সমাজের একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না কোনো  ধর্মান্ধ জঙ্গী হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। এমনকি এ দলটির অনেক নেতাকর্মী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে এই ধারণা পোষণ করে যে, মাদ্রাসা করা মানেই  আল্লাহ-রাসুলের কাজ করা। মাতৃভাষা বাংলার চর্চা এখানে নেই বললেই চলে। এই সব মাদ্রাসা থেকে পাশ করে কেউ দেশের শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না, এ কথাটি তারা জেনেও ভোটের লোভে করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বিগত বছরগুলোতে জামাত ও বিএনপি নেতাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় ভুমিকা রেখে চলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। এভাবে দেশের একদিকে চলছে ধর্মের নামে মাদ্রাসাগুলোতে অবৈজ্ঞানিক ও আরবী শিক্ষা, অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষার নামেও চলছে দেশের নতুন প্রজন্মকে শেকড়চ্যুত করার এক লাগামহীন তৎপরতা। আর এসব শিক্ষার ফলে দেশে উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার মানুষদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং অসাম্প্রদায়িক মানুষ যারা আছেন তাঁরাও হয়ে পড়ছেন হতাশাগ্রস্ত। এ থেকে বর্তমান সরকারের অনেক শিক্ষা নেয়ার এবং সাবধান হওয়ার দরকার আছে।

এদেশের মানুষ হাজার বছর ধরে শান্তি (ইসলাম)তে বসবাস করে আসছে। অসংখ্য সূফীসাধক, দরবেশ, আউলিয়া, গাউস-কুতুবের সংস্পর্শে এদেশের মানুষ একদিন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। সেই ইসলাম কোনো রাজনৈতিক ইসলাম ছিল না। আমেরিকা, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসকবর্গের মদদে জামাতে ইসলাম, নেজামী ইসলাম, মুসলিম লীগ এদেশে যে নিজেদের গড়া বিভিন্ন পদ্ধতির  ইসলাম চালু করতে চেয়েছিল তা সম্পূর্ণ অর্থে রাজনৈতিক ছিল বলেই দেশে সৃষ্টি হয়েছিল এত সংঘাত, হানাহানি এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে। এই ধর্মকে ব্যবহার করে দেশের মোট জনসংখ্যার কিছু কিছু লোক ও গোষ্ঠী অঢেল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে ঠিক, কিন্তু সমাজে বৈষম্য ও বঞ্চনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পবিত্র ধর্ম ইসলামের এমন ভিন্ন পথে রাজনীতিকীকরণের কারণে দেশ ও সমাজ যে পিছিয়ে রয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মের এই অপব্যবহার আছে বলেই সমাজের একটি অংশ দুর্নীতি ও দেশের সম্পদ লুপটপাট করে অর্থবিত্তের মালিক হয়, মক্কায় গিয়ে হজ্জ্ব করে নিজের নামের সাথে আলহাজ্জ্ব লাগিয়ে আরও বেশি বেশি ভোগলিপ্সায় জড়িত হয়, হালআমলে এরাই আবার রাজনৈতিক অঙ্গনেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ত্যাগের মহিমা তাদের মধ্যে থাকে না। জনগণের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর শেষ পর্যন্ত জনগণের শত দুঃখ-কষ্টও তাদের চিন্তার মধ্যে কোনো রেখাপাত করে না। মানুষও হয়ে উঠছে ভীতু, রাজনীতিবিমুখ ও অসচেতন। এ সুযোগের ব্যবহার করছে ধর্মজীবী রাজনৈতিক তথাকথিত ইসলামপন্থীরা।  

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা এখন সময়ের দাবি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চকে  কেন্দ্র করে বহু বছর পর সাধারণ মানুষ সচেতনভাবে রাজনীতিমুখী হয়ে উঠেছে। গণজাগরণ মঞ্চকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনটি গণমুখী ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটি বড় উদাহরণ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনটিকে গণমানুষের স্বার্থে ব্যবহার করতে এগিয়ে এলে কল্যাণ হবে জাতির। গণজাগরণ মঞ্চের চেতনা সারা দেশের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে এবং সব শ্রেণীর মানুষকে বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলে ধর্মান্ধ, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা  তথা কায়েমী স্বার্থবাদীরা চোখে অন্ধকার দেখবে। দেশ এখন যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে এখানে  শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ নতুন প্রজন্মের জাগরণে এবং সার্বিক সহযোগিতা আরও বেশি বেশি দরকার বলেই বিশ্বাস সচেতন দেশবাসীর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন