জাতির
প্রত্যাশা হতে জিজ্ঞাসা
সংলাপ ॥ বাংলাদেশ অতি গরীব দেশ। এখানে রাজতন্ত্রের বিধান
নেই। গণতন্ত্রই এ দেশের প্রধান এবং মূল তন্ত্র। এ তন্ত্রকে একমাত্র তান্ত্রিক ব্যক্তিরাই
পোষণ, শোধন ও পরিচালন করে থাকেন। তান্ত্রিক জানা বিদগ্ধ জনেরাই এর যোগ্য ধারক-বাহক।
তাঁরা দেশপ্রেমিক ও দিকপাল। একমাত্র রাজনীতিই তাঁদের সার্বক্ষণিক চেতনার বিষয়। জীবন
এবং জীবনের সকল সাধ, আহ্লাদ, সুখ-শান্তি বিসর্জন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে সদা ব্রত
তাঁরা। এতেই তাঁরা সুখী হন, ধন্য এবং সার্থক মনে করেন নিজেকে। তাঁরা দেশ, মাটি ও মানুষের
সফল অগ্রগতিতে আনন্দ পান। নিজের পরিবার, পরিজন, গোষ্ঠী, মহল ও দলকে দেশ ও জাতির সার্বিক
সেবাকর্মে নিয়োজিত রাখতে ভালবাসেন। নিজেকে ভাবেন জাতির গোলাম। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, ব্যভিচারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাও
বলিষ্ঠ পদক্ষেপ তাঁদের। দেশ রক্ষায় দেশ নীতি অনুসরণ ও অনুকরণই তাঁদের মূল শ্লোগান।
তাঁরা দেশপ্রেমিক। জোর করে ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকা তাঁদের ধর্ম নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য,
উন্নয়ন, উৎপাদনে আইনগত পবিত্র ধারাবাহিকতা বজায় রাখা তাঁদের ব্যক্তিগত ও সাংবিধানিক
অঙ্গীকার। জীবনের সমুদয় জীবন-কাল জনস্বার্থে
ব্যয় করা পরম ধর্ম তাঁদের। তাঁদের স্রষ্টায়-সৃষ্টিতে আছে পরিপূর্ণ আস্থা। দেশ ও জাতি
শাসনে তাঁরাই যোগ্য ব্যক্তি, অন্যেরা নয়।
সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাশা হতে জিজ্ঞাসা দেশ-জাতির দায়িত্ব
ও শাসনভার এমন গুণধর যোগ্যতম ব্যক্তির হাতে কোনো সময়ে, কোনো কালে ছিলো কিনা? বর্তমানে
আছে কিনা? ভবিষ্যতে থাকবে কিনা? থাকলে কারা এবং কতজন?
জিজ্ঞাসার উত্তর সাধারণ?মানুষের কাছে ‘না’ হয়েই বিদ্যমান।
তাই বাংলাদেশের বর্তমান এবং নিকট অতীত হুমকির সম্মুখীন। কথিত গণতন্ত্রে, ঘোমটা পরা
রাজতন্ত্র কৌশলগতভাবে সংগোপনে জোরদার। ক্ষমতাসীনদের ঘরের লোকই ক্ষমতার স্টিয়ারিং চালনা
করে আসছে স্বাধীনতার পর হতে পর্যায়ক্রমে। যার পরিবর্তন ঘটাবার শিক্ষা ও ব্যাখ্যা সর্বাধিক সাধারণ জনগোষ্ঠীর জানা
নেই। এটাও ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক চতুরতা ও অপকৌশল হিসাবে বিবেচিত। কৃত্রিম আভিজাত্যিক
চাল-চলনে রাজনীতিকরা বর্তমানে সাধারণ গণমানুষের আতঙ্ক। বাংলাদেশে এ যাবৎ কোনো দলই ক্ষমতায়
যাবার আগে কথা দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে ন্যূনতম কথা রক্ষা করতে পারেনি। রক্ষা করেছে শুধু
আত্মীয় পোষা এবং ক্ষমতা প্রাপ্তি ও অর্থ সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি করার মতো গোপন অঙ্গীকার।
দেশবাসীর অসহনীয় বিদ্বেষ ও প্রতিকার-প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা চিন্তায় জাগলেও এবং রক্তে
প্রবাহিত হলেও পারছে না। ক্রমান্বয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে আবদ্ধ ক্ষমতা, দেশ ও
সাধারণ মানুষকে এমনিভাবেই পিষে মারছে।
এ ধরনের রাজনীতিকরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বারবার ভোগ করার লক্ষ্যে
অরাজনৈতিকদের দলে টেনে আনা শুরু করেছে বহু আগে থেকে। সরকারী আমলা নামে চিহ্নিত অবসরপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা (সংক্ষেপে অবঃ গং)-দের দলে টেনে আনা হয়েছে এবং হচ্ছে। এই অবঃরা সরকারের বিভিন্ন
মন্ত্রণালয়ের খুঁটিনাটি সমস্ত তথ্য সম্পর্কে জ্ঞাত। কারণে-অকারণে এসব তথ্যের প্রয়োগ
ঘটিয়ে চাকুরি জীবনে প্রচুর অর্থ কামিয়েছে তারা। দলে ভিড়ানোর পর কামানো অর্থে নির্বাচনী
চাহিদা মিটাচ্ছে এবং ক্ষমতায় যাবার পর তাদের অর্জিত দাপ্তরিক তথ্যের আগাম স্বাধীন ব্যবহার
করা সহজ হচ্ছে। অবঃদের দলে ভিড়ানোর ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত এবং আগের চেয়ে জোরদার ও
জমজমাট। স্বাধীনতার সূচনালগ্নে অবঃ গংদের অবশ্য রাজনীতিতে অনাগ্রহই ছিলো। অবসরে নির্ঝঞ্জাট
শান্তিপ্রিয় জীবনই ছিলো তাদের কাম্য। কিন্তু রাজীনীতিকরা দলভারীর মানসে তাদেরকে অনুপ্রেরণায়
উজ্জীবিত করেছে। ধীরে ধীরে তারাও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে প্রচলিত অবসর জীবনকে
পরিহার করে বেছে নিয়েছে রাজনীতির সুগম পথকে। পাশাপাশি আরো কয়েক স্তর থেকে নতুন করে
যারা রাজনীতিতে আসছে বা রাজনীতিকরা টেনে আনছে তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী মহল আজ সোচ্চার
- আমরাই দেশের মূল চালিকা শক্তি।
তারা বলছে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। বলা হচ্ছে
ব্যবসায়ীদের এই অত্যাবশ্যক দাবির কথা একেবারেই ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। কারণ ব্যবসায়ীদের
হাতে রাজনীতিকরা চাঁদা গ্রহণের দায়ে আগেই আটকা পড়ে আছে। এ দাবিকে উপেক্ষা করবে কি করে?
যদিও অনেক ব্যবসায়ীই কোটি কোটি টাকার ঋণ খেলাপী। চাঁদার দায়ে রাজনীতিকরা ক্ষমতায় গিয়ে
ব্যবসায়ীদের ইচ্ছা মাফিক ঋণ দিয়েছে। ঋণ পরিশোধ সুদূর পরাহত। এতে অবশ্য রাষ্ট্র এবং
জনগণের ব্যাপক ক্ষতি হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ খাজনার দুয়ার তো বন্ধ নয়। ভোগ
বিলাস ঠিকই চলছে।
উভয় পক্ষের এমনতর সমন্বয়, রাজনীতি ও অর্থ-সম্পদ ভাগাভাগির
মধ্য দিয়েই বয়ে চলেছে। তাই দেশের বর্তমান অবস্থা দেশ ও জাতির ভবিষ্যত একেবারে অন্ধকার
করে দেয়ার পূর্বাবস্থা বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। চাঁদা দেয়া-নেয়ার সম্পর্কযুক্ত
মেলামেশায় ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিকদের মধ্যে যেমন নতুন চুক্তির উন্মেষ ঘটেছে তেমনিভাবে
রাজনীতিকদের সন্তানেরা, দেহরক্ষী, তল্পীবাহক, আজ্ঞা বাহকরাও বসে নেই। তারাও নেতৃত্ব
এবং ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। নেতার নেতৃত্ব ও ক্ষমতার পাহারা দিয়ে যাচ্ছে ইতোমধ্যেই?
পাহারার মধ্য দিয়ে তারা নেতৃত্বের চতুরতা এবং মিথ্যাচারের কলা-কৌশল শিখেই ফেলেছে। নেতাও
বুদ্ধিবৃত্তিক দূর্নীতির কারণে?তাদের কাছে?দায়গ্রস্ত। কাজেই এ ক্ষেত্রেও নতুন শক্তির
পরিচয় ঘটেছে। সুযোগ তাদের দিতেই হচ্ছে।
তাই বাঙালি জাতির সাথে একজন আদর্শ নেতার পরিচয় ঘটবে কিনা
বলা মুশকিল। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী অরাজনৈতিক আমলা, ঋণ খেলাপী, মজুদদার, কালোবাজারী ব্যবসায়ী
এবং আজ্ঞা ও তল্পিবাহক নেতার পাহারাদাররা আজ রাজনৈতিক মাঠের সক্রিয় সদস্য।
বোমাবাজী, সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া আর সংঘাতময়
রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আগামী অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনৈতিক
দলগুলো। প্রতিটি দলেই যোগদানের পাইপলাইনে রয়েছে অবঃদের দল আর উচ্চাভিলাষী ব্যবসায়ী
নেতারা। দেশের স্বার্থে নয়, মানুষের কল্যাণে নয়, স্রেফ নিজেদের আখের গোছানের মতলবেই
এসব মৌসুমী রাজনীতিকদের আনাগোনা চলছে রাজনীতির মাঠে।
জাতির আগামী ভবিষ্যতকে তারাই হয়তো নেতৃত্ব দেবে, যারা অতীত
এবং বর্তমানেও ক্ষমতার দাপট কিংবা অপব্যবহার করে অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছে। জাতীয় জীবনে
সৃষ্টি করেছে অসংখ্য সমস্যাসহ সঠিক নেতৃত্বের শূন্যতা। যে কারণে দেশের সিংহভাগ দরিদ্র
মানুষ আরো দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এক শ্রেণী হচ্ছে ধনী থেকে ধনীতর। সঙ্গতিহীন
বিরাট ব্যবধান যখন আরো ব্যবধানে পরিণত হবে তখন এই স্বাধীন দেশ ও জাতির নিরাপত্তা বিধান
কতটুকু নিরাপদ থাকবে এখনই তা ভেবে দেখার বিষয়। ভেজাল রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা ও নেতারক্ষীদের
এক নাটকে সমন্বিত মহড়া দেখে কোনো লাভ নেই। ওদের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে
ওদের বাইরে সবাইকে ভবিষ্যত চিন্তায় ঐক্যবদ্ধ
হতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে পেশাজীবীদের। তাই দেশের স্বনামধন্য খ্যাতিমান আদর্শ পেশাজীবীরা
সর্বাগ্রে এগিয়ে আসুক দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এটাই দেশ ও জাতির কাম্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন